কর্মচারীদের আনুগত্য দিয়ে কি জনসেবা নিশ্চিত হবে
Published: 20th, June 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের চতুর্থ অধ্যায়ে জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের আচরণগত ও দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কার বিষয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন মনে করে, সরকারের নীতিগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কতগুলো পেশাগত মৌলিক মূল্যবোধ নিশ্চিত করা দরকার। কমিশন এ লক্ষ্যে একটি সিভিল সার্ভিস কোড প্রণয়নের সুপারিশ করেছে, যেখানে এই মৌলিক মূল্যবোধগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সুপারিশে উল্লেখিত মূল্যবোধগুলো হলো: জনগণকেন্দ্রিকতা, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, সততা, নেতৃত্ব ও উদ্ভাবন, সমতা, পেশাদারত্ব।
অন্তর্বর্তী সরকার এই সুপারিশ অনুযায়ী সিভিল সার্ভিস কোড প্রণয়ন করছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে সম্প্রতি সরকার সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ সংশোধন করে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে, যেখানে সরকারি কর্মচারীদের আনুগত্য নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই সংশোধনী সংস্কার কমিশনের মূল দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, কমিশন যেখানে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতাকে গুরুত্ব দিয়েছে, সেখানে নতুন অধ্যাদেশে একটি অস্পষ্ট ও সংজ্ঞাহীন ধারণা—‘অনানুগত্য’কে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
অধ্যাদেশের সরকারি কর্মচারীদের আচরণ ও দণ্ড–সংক্রান্ত বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য কোনো কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কাজে বাধা তৈরি করে, তাহলে সেটি হবে একটি অসদাচরণ। এমন অপরাধের জন্য পদ বা বেতন গ্রেড অবনমিতকরণ, চাকরি হতে অপসারণ, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে। সরকারি কর্মচারীরা আশঙ্কা করছেন, অধ্যাদেশটির কারণে সরকারি কর্মচারীরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অন্যায় আদেশও মানতে বাধ্য হবেন। আবার তা না মানলে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন। সম্প্রতি আন্দোলনের মুখে সরকার অধ্যাদেশটি পর্যালোচনার জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে।
অথচ সরকারি চাকরিজীবীরা যদি সরকারের আদেশ অমান্য করে বা দুর্নীতি করে বা কাজে অবহেলা করে, তাহলে বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা অনুসারেই শাস্তি দেওয়া সম্ভব। এখানে সমস্যা হলো এসব আইন ও বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ ও ধীরগতি নিয়ে। এ সমস্যার সমাধানে ‘অনানুগত্য’-এর মতো অসংজ্ঞায়িত ও বায়বীয় বিষয়ে শাস্তির বিধান রেখে নতুন অধ্যাদেশ জারি কী ভূমিকা রাখবে, সেটা স্পষ্ট নয়। ঘুষ, দুর্নীতি ছাড়াই দ্রুত জনসেবা প্রদানে সরকারি কর্মচারীদের বাধ্য করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অন্ধ আনুগত্য কেন প্রয়োজন, তা বোধগম্য নয়। সরকার গঠিত জনসংস্কার কমিশনের সুপারিশে সরকারি কর্মচারীদের অনিয়ম, দুর্নীতি, অবহেলা দূর করতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে, কিন্তু সেখানেও অনানুগত্যের জন্য চাকরি থেকে অপসারণের কোনো আইন করার সুপারিশ করা হয়নি।
বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী যেসব কারণে সরকারি চাকরিজীবীদের সাময়িক বহিষ্কার থেকে শুরু করে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার মতো গুরুতর শাস্তি দেওয়া যায়, তার মধ্যে ‘অসদাচরণ’ অন্যতম। এই বিধিমালায় ‘অসদাচরণ’ বলতে যা বোঝানো হয়েছে, তা হলো: ১) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনসংগত আদেশ অমান্য; ২) কর্তব্যে অবহেলা; ৩) আইনসংগত কারণ ব্যতিরেকে সরকারের আদেশ, পরিপত্র, নির্দেশ অবজ্ঞা; ৪) কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অসংগত, ভিত্তিহীন, হয়রানিমূলক, মিথ্যা অথবা তুচ্ছ অভিযোগ দাখিল; ৫) অন্য কোনো আইনে বা বিধিবিধানে যেসব কাজ অসদাচরণ হিসেবে গণ্য তেমন কাজ করা।
লক্ষণীয়, এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যেকোনো আদেশ অমান্যকে শাস্তিযোগ্য করা হয়নি, আইনসংগত আদেশ অমান্য করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নতুন অধ্যাদেশে অনানুগত্যকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, অথচ ‘অনানুগত্য’ বলতে কী বোঝায় এবং কার প্রতি অনানুগত্য—সরকার, রাষ্ট্র নাকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কোনো কিছুই বলা হয়নি।
আগের বিধিমালায় যেমন আইনসংগত আদেশ অমান্য করার কথা বলা আছে, নতুন অধ্যাদেশে এ রকম কোনো শর্তের উপস্থিতি নেই। ফলে অনানুগত্যের মতো অসংজ্ঞায়িত বিধান ব্যবহার করে সরকার বা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অধস্তন কর্মকর্তাকে যেকোনো কিছু করতে বাধ্য করার সুযোগ তৈরি হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের দিক থেকেও যেকোনো গুরুতর অন্যায় করার অজুহাত হিসেবে এই অনানুগত্যের বিধান ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হবে। সরকারি কর্মকর্তারা ভোট জালিয়াতির কাজে সহায়তা করলেও তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ, তাঁরা আনুগত্যের বিধানকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবেন। কিন্তু বিদ্যমান বিধিমালায় অসদাচরণের বিধানে আইনসংগত আদেশের কথা বলা থাকায়, ভোট জালিয়াতির মতো বেআইনি কাজে অংশগ্রহণের পক্ষে কোনো অজুহাত দেওয়া সম্ভব নয়।
নতুন অধ্যাদেশে শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধাপ—তদন্ত ও সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ—বাদ দেওয়া হয়েছে। আগের নিয়মে শাস্তির আগে তদন্ত ও কর্ম কমিশনের মতামত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও নতুন নিয়মে তা নেই, যা ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝুঁকি বাড়ায়। যদিও দীর্ঘসূত্রতা কমাতে কর্ম কমিশনে পাঠানোর ধাপ বাদ দেওয়া যেতে পারে, তবে তদন্তের ব্যবস্থা না থাকায় কোনো বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশে বা শত্রুতা থেকে কাউকে সহজেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবেন।
প্রয়োজনে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ সংশোধন করে কারণ দর্শানোর নোটিশ, জবাব, শুনানি, তদন্তের সময়—এগুলো আরও কম সময়ে করার বিধান করা যেতে পারে। কিন্তু এসব প্রক্রিয়াগত সুরক্ষা তুলে দিয়ে অনানুগত্যের মতো অসংজ্ঞায়িত আচরণের শাস্তির বিধান রাখা যথার্থ হবে না। দেশের জনপ্রশাসনের কাছ থেকে নাগরিকদের প্রত্যাশা হলো জনপ্রশাসন যেন রাজনৈতিক পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করে এবং ঘুষ ছাড়া সময়মতো জনসেবা দেয়। কাজেই সরকারের উচিত হবে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঘুষ, দুর্নীতি ছাড়াই সময়মতো জনসেবা প্রদান এবং জনপ্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
ঘুষ ছাড়াই সময়মতো সেবা নিশ্চিতের জন্য কমিশনের সুপারিশে রয়েছে সেবার মানদণ্ড নির্ধারণ, অনলাইন ট্র্যাকিং চালু, প্রক্রিয়া সরলীকরণ, টোকেনভিত্তিক সিস্টেম, সেবা প্রদানের সময় অনুসরণ, দক্ষতা মূল্যায়ন ইত্যাদি। এ ছাড়া ন্যায়পাল দপ্তর প্রতিষ্ঠার পর মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য দপ্তরে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। কমিউনিটিভিত্তিক মতামত সংগ্রহ ও সেবার সন্তুষ্টি মূল্যায়নের পাশাপাশি সেবাপ্রার্থীর হয়রানির জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও প্রস্তাবিত।
সরকারি কর্মীদের দক্ষতা মূল্যায়নে মূল কর্মক্ষমতা সূচক (কেপিআই) চালু ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের (এসিআর) পরিবর্তে বার্ষিক কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন (এপিই) চালুর কথা বলা হয়েছে। বছরের শুরুতে কাজের পরিকল্পনা দাখিল ও বছরের শেষে পারফরম্যান্স মূল্যায়ন হবে। পারফরম্যান্স অনুযায়ী আর্থিক সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা দেওয়া হবে।
জনপ্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে: পদোন্নতিতে রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই বাতিল, নিয়োগের পূর্বে শুধু ফৌজদারি মামলা যাচাই, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নিষেধাজ্ঞা, সিভিল সার্ভিসের বাইরে থেকে মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব নিয়োগ, জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপের সীমারেখা নির্ধারণ, লিখিত নির্দেশ ছাড়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি।
দেশে জনপ্রশাসন সংস্কারে গত ৫৩ বছরে ২৬টি কমিশন ও কমিটি গঠিত হয়েছে। এসব কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনিচ্ছা ও আমলাদের স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে। এবারও যেন একই ঘটনা না ঘটে, সে জন্য সরকারকে সব দিকে ভেবে দৃঢ়ভাবে এগোতে হবে। দুর্বল ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না, সেই সঙ্গে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের পক্ষে জনমত গঠন করতে হবে।
জনগণ একটি কার্যকর, পেশাদার ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন চায়। তার জন্য আনুগত্য নয়, দরকার নৈতিকতা, দক্ষতা ও জনসেবার অঙ্গীকার।
● কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
[email protected]
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত র ন শ চ ত কর স প র শ কর অসদ চরণ র জন ত ক সরক র র ব যবহ র য কর র অন য য় স ত কর র জন য তদন ত জনস ব
এছাড়াও পড়ুন:
কর্মচারীদের আনুগত্য দিয়ে কি জনসেবা নিশ্চিত হবে
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের চতুর্থ অধ্যায়ে জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের আচরণগত ও দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কার বিষয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশন মনে করে, সরকারের নীতিগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কতগুলো পেশাগত মৌলিক মূল্যবোধ নিশ্চিত করা দরকার। কমিশন এ লক্ষ্যে একটি সিভিল সার্ভিস কোড প্রণয়নের সুপারিশ করেছে, যেখানে এই মৌলিক মূল্যবোধগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সুপারিশে উল্লেখিত মূল্যবোধগুলো হলো: জনগণকেন্দ্রিকতা, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, সততা, নেতৃত্ব ও উদ্ভাবন, সমতা, পেশাদারত্ব।
অন্তর্বর্তী সরকার এই সুপারিশ অনুযায়ী সিভিল সার্ভিস কোড প্রণয়ন করছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে সম্প্রতি সরকার সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ সংশোধন করে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে, যেখানে সরকারি কর্মচারীদের আনুগত্য নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই সংশোধনী সংস্কার কমিশনের মূল দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, কমিশন যেখানে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতাকে গুরুত্ব দিয়েছে, সেখানে নতুন অধ্যাদেশে একটি অস্পষ্ট ও সংজ্ঞাহীন ধারণা—‘অনানুগত্য’কে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
অধ্যাদেশের সরকারি কর্মচারীদের আচরণ ও দণ্ড–সংক্রান্ত বিশেষ বিধানে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য কোনো কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কাজে বাধা তৈরি করে, তাহলে সেটি হবে একটি অসদাচরণ। এমন অপরাধের জন্য পদ বা বেতন গ্রেড অবনমিতকরণ, চাকরি হতে অপসারণ, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যাবে। সরকারি কর্মচারীরা আশঙ্কা করছেন, অধ্যাদেশটির কারণে সরকারি কর্মচারীরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অন্যায় আদেশও মানতে বাধ্য হবেন। আবার তা না মানলে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন। সম্প্রতি আন্দোলনের মুখে সরকার অধ্যাদেশটি পর্যালোচনার জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে।
অথচ সরকারি চাকরিজীবীরা যদি সরকারের আদেশ অমান্য করে বা দুর্নীতি করে বা কাজে অবহেলা করে, তাহলে বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা অনুসারেই শাস্তি দেওয়া সম্ভব। এখানে সমস্যা হলো এসব আইন ও বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ ও ধীরগতি নিয়ে। এ সমস্যার সমাধানে ‘অনানুগত্য’-এর মতো অসংজ্ঞায়িত ও বায়বীয় বিষয়ে শাস্তির বিধান রেখে নতুন অধ্যাদেশ জারি কী ভূমিকা রাখবে, সেটা স্পষ্ট নয়। ঘুষ, দুর্নীতি ছাড়াই দ্রুত জনসেবা প্রদানে সরকারি কর্মচারীদের বাধ্য করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অন্ধ আনুগত্য কেন প্রয়োজন, তা বোধগম্য নয়। সরকার গঠিত জনসংস্কার কমিশনের সুপারিশে সরকারি কর্মচারীদের অনিয়ম, দুর্নীতি, অবহেলা দূর করতে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে, কিন্তু সেখানেও অনানুগত্যের জন্য চাকরি থেকে অপসারণের কোনো আইন করার সুপারিশ করা হয়নি।
বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী যেসব কারণে সরকারি চাকরিজীবীদের সাময়িক বহিষ্কার থেকে শুরু করে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার মতো গুরুতর শাস্তি দেওয়া যায়, তার মধ্যে ‘অসদাচরণ’ অন্যতম। এই বিধিমালায় ‘অসদাচরণ’ বলতে যা বোঝানো হয়েছে, তা হলো: ১) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনসংগত আদেশ অমান্য; ২) কর্তব্যে অবহেলা; ৩) আইনসংগত কারণ ব্যতিরেকে সরকারের আদেশ, পরিপত্র, নির্দেশ অবজ্ঞা; ৪) কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অসংগত, ভিত্তিহীন, হয়রানিমূলক, মিথ্যা অথবা তুচ্ছ অভিযোগ দাখিল; ৫) অন্য কোনো আইনে বা বিধিবিধানে যেসব কাজ অসদাচরণ হিসেবে গণ্য তেমন কাজ করা।
লক্ষণীয়, এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যেকোনো আদেশ অমান্যকে শাস্তিযোগ্য করা হয়নি, আইনসংগত আদেশ অমান্য করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নতুন অধ্যাদেশে অনানুগত্যকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, অথচ ‘অনানুগত্য’ বলতে কী বোঝায় এবং কার প্রতি অনানুগত্য—সরকার, রাষ্ট্র নাকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কোনো কিছুই বলা হয়নি।
আগের বিধিমালায় যেমন আইনসংগত আদেশ অমান্য করার কথা বলা আছে, নতুন অধ্যাদেশে এ রকম কোনো শর্তের উপস্থিতি নেই। ফলে অনানুগত্যের মতো অসংজ্ঞায়িত বিধান ব্যবহার করে সরকার বা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অধস্তন কর্মকর্তাকে যেকোনো কিছু করতে বাধ্য করার সুযোগ তৈরি হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের দিক থেকেও যেকোনো গুরুতর অন্যায় করার অজুহাত হিসেবে এই অনানুগত্যের বিধান ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হবে। সরকারি কর্মকর্তারা ভোট জালিয়াতির কাজে সহায়তা করলেও তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ, তাঁরা আনুগত্যের বিধানকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবেন। কিন্তু বিদ্যমান বিধিমালায় অসদাচরণের বিধানে আইনসংগত আদেশের কথা বলা থাকায়, ভোট জালিয়াতির মতো বেআইনি কাজে অংশগ্রহণের পক্ষে কোনো অজুহাত দেওয়া সম্ভব নয়।
নতুন অধ্যাদেশে শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধাপ—তদন্ত ও সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ—বাদ দেওয়া হয়েছে। আগের নিয়মে শাস্তির আগে তদন্ত ও কর্ম কমিশনের মতামত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও নতুন নিয়মে তা নেই, যা ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝুঁকি বাড়ায়। যদিও দীর্ঘসূত্রতা কমাতে কর্ম কমিশনে পাঠানোর ধাপ বাদ দেওয়া যেতে পারে, তবে তদন্তের ব্যবস্থা না থাকায় কোনো বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশে বা শত্রুতা থেকে কাউকে সহজেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবেন।
প্রয়োজনে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ সংশোধন করে কারণ দর্শানোর নোটিশ, জবাব, শুনানি, তদন্তের সময়—এগুলো আরও কম সময়ে করার বিধান করা যেতে পারে। কিন্তু এসব প্রক্রিয়াগত সুরক্ষা তুলে দিয়ে অনানুগত্যের মতো অসংজ্ঞায়িত আচরণের শাস্তির বিধান রাখা যথার্থ হবে না। দেশের জনপ্রশাসনের কাছ থেকে নাগরিকদের প্রত্যাশা হলো জনপ্রশাসন যেন রাজনৈতিক পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করে এবং ঘুষ ছাড়া সময়মতো জনসেবা দেয়। কাজেই সরকারের উচিত হবে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঘুষ, দুর্নীতি ছাড়াই সময়মতো জনসেবা প্রদান এবং জনপ্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
ঘুষ ছাড়াই সময়মতো সেবা নিশ্চিতের জন্য কমিশনের সুপারিশে রয়েছে সেবার মানদণ্ড নির্ধারণ, অনলাইন ট্র্যাকিং চালু, প্রক্রিয়া সরলীকরণ, টোকেনভিত্তিক সিস্টেম, সেবা প্রদানের সময় অনুসরণ, দক্ষতা মূল্যায়ন ইত্যাদি। এ ছাড়া ন্যায়পাল দপ্তর প্রতিষ্ঠার পর মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য দপ্তরে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। কমিউনিটিভিত্তিক মতামত সংগ্রহ ও সেবার সন্তুষ্টি মূল্যায়নের পাশাপাশি সেবাপ্রার্থীর হয়রানির জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও প্রস্তাবিত।
সরকারি কর্মীদের দক্ষতা মূল্যায়নে মূল কর্মক্ষমতা সূচক (কেপিআই) চালু ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের (এসিআর) পরিবর্তে বার্ষিক কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন (এপিই) চালুর কথা বলা হয়েছে। বছরের শুরুতে কাজের পরিকল্পনা দাখিল ও বছরের শেষে পারফরম্যান্স মূল্যায়ন হবে। পারফরম্যান্স অনুযায়ী আর্থিক সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা দেওয়া হবে।
জনপ্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে: পদোন্নতিতে রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই বাতিল, নিয়োগের পূর্বে শুধু ফৌজদারি মামলা যাচাই, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নিষেধাজ্ঞা, সিভিল সার্ভিসের বাইরে থেকে মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব নিয়োগ, জনপ্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপের সীমারেখা নির্ধারণ, লিখিত নির্দেশ ছাড়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি।
দেশে জনপ্রশাসন সংস্কারে গত ৫৩ বছরে ২৬টি কমিশন ও কমিটি গঠিত হয়েছে। এসব কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনিচ্ছা ও আমলাদের স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে। এবারও যেন একই ঘটনা না ঘটে, সে জন্য সরকারকে সব দিকে ভেবে দৃঢ়ভাবে এগোতে হবে। দুর্বল ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না, সেই সঙ্গে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের পক্ষে জনমত গঠন করতে হবে।
জনগণ একটি কার্যকর, পেশাদার ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন চায়। তার জন্য আনুগত্য নয়, দরকার নৈতিকতা, দক্ষতা ও জনসেবার অঙ্গীকার।
● কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
[email protected]
* মতামত লেখকের নিজস্ব