সুরতহাল প্রতিবেদনে আঘাতের চিহ্ন, নির্যাতনের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলছে পুলিশ
Published: 20th, June 2025 GMT
কুমিল্লার মুরাদনগরে মাদকসেবনরত অবস্থায় ৭০টি ইয়াবা বড়িসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে শেখ জুয়েল (৪৫) নামে বিএনপির এক কর্মী পুলিশের হেফাজতে থাকতে মারা যান। স্বজনদের দাবি, পুলিশের নির্যাতনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে পরিবারের অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ দাবি করে পুলিশ বলছে, থানাহাজতে অবস্থানকালে বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারকে জানিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টা ১৫ মিনিটে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাকিব হাছান খান মুরাদনগর থানার পুলিশ কনস্টেবল মহসিনকে নিয়ে শেখ জুয়েলের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ পুলিশ শেখ জুয়েলের মরদেহে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই দাবি করলেও সুরতহাল প্রতিবেদনে কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন ও আঁচড় দেখতে পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে গুরুতর কোনো আঘাতের কথা সুরতহালে উল্লেখ ছিল না।
বৃহস্পতিবার বিকেলে বাঙ্গরা বাজার এলাকায় একটি ইটভাটার পাশে হেলালের বাড়ি থেকে জুয়েলসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে বাঙ্গরা বাজার থানা-পুলিশ। পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় সন্ধ্যায় ওই বিএনপি কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাত ৮টা ৫০ মিনিটে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
শেখ জুয়েল উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার বাঙ্গরা গ্রামের শেখবাড়ির প্রয়াত শেখ গোলাম সারোয়ারের ছেলে। তিনি স্থানীয় এলাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট–সংযোগ সরবরাহের ব্যবসা করতেন। পুলিশ হেফাজতে বিএনপির কর্মীর মৃত্যুর খবরে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বাঙ্গরা বাজার থানার সামনে বৃহস্পতিবার রাতে হট্টগোল ও বিক্ষোভ মিছিল করেন।
শেখ জুয়েলের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মরদেহে ডান গালের চোয়ালের দিকে সামান্য ফোলা ও হালকা আঘাতের চিহ্ন আছে। নাভি কালচে এবং বুকের ডান দিক থেকে বাঁ স্থান পর্যন্ত হালকা কালচে দাগ। ডান হাতের কবজির ওপরের দিকে আধা ইঞ্চি পরিমাণ আঁচড়ের দাগ আছে। পিঠের ডান দিকে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ আঘাতের চিহ্ন। কোমরের বাঁ পাশে তিন ইঞ্চি পরিমাণ আঁচড়ের চিহ্ন। বাঁ পায়ের মাঝবরাবর নতুন হালকা আঘাত ও আঁচড়ের চিহ্ন আছে।
জানতে চাইলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাকিব হাছান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির সময় ভালোভাবে যা যা দেখেছি, সেটাই উল্লেখ করেছি। তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
এর আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত মধ্যরাতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে শেখ জুয়েল নামের ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা হয়। আমরা তাঁকে মৃত অবস্থায় পেয়েছি। তাই কী কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, মন্তব্য করা যাচ্ছে না। তবে মরদেহে আমরা উল্লেখ করার মতো কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাইনি।’
এদিকে শুক্রবার সকালে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে শেখ জুয়েলের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। পরে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
শেখ জুয়েলের ছোট ভাই ও বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ শাহ পরান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাইকে নির্যাতন করে মারা হয়েছে। আমরা এ ঘটনার বিচার চাই। শিগগিরই এ নিয়ে আমরা আইনগত পদক্ষেপ নেব। পুলিশ আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মাদকের ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছে। তিনি মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন না।’
শেখ জুয়েলের মৃত্যুর পর তাঁর দলীয় পরিচয় নিয়ে ফেসবুকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একধরনের ‘টানাহেঁচড়া’ শুরু হয়। বিএনপির নেতা-কর্মীরা তাঁকে ‘বিএনপির কর্মী’ এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁকে ‘যুবলীগের নেতা’ বলে প্রচার করেন। এ বিষয়ে শেখ শাহ পরান বলেন, ‘আমার ভাই বিএনপির কর্মী ছিলেন। তবে দলীয় কোনো পদে ছিলেন না। মৃত্যুর পর অনেকে আমার ভাইয়ের দলীয় পরিচয় নিয়ে অপপ্রচার করছে। তিনি আওয়ামী লীগ বা যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না।’
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেখ জুয়েল বিএনপির একজন নিবেদিত কর্মী। আমরা তার মৃত্যুর বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করে দেখার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) এ কে এম কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শেখ জুয়েলসহ পাঁচজনকে মাদকসেবনরত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়। এলাকার সব মানুষ জানেন, জুয়েল একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী। বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে আনা থেকে রাতে জুয়েলকে হাসপাতালে নেওয়া পর্যন্ত সব দৃশ্য থানার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে রয়েছে। শেখ জুয়েলকে নির্যাতন তো দূরের কথা, একটি থাপ্পড়ও দেওয়া হয়নি। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক, উপস্থিত লোকজন সবাই দেখেছে তাঁর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। যেসব সামান্য কালো দাগ ও আঁচড়ের কথা বলা হয়েছে সুরতহাল প্রতিবেদনে, সেগুলো গ্রেপ্তার হওয়ার আগে হতে পারে। এ ছাড়া তাঁকে হাসপাতালে নেওয়াসহ ওঠানো-নামানোর সময় হাতের চাপেও এমনটা হতে পারে। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, তাঁর ওপর কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি।’
এ কে এম কামরুজ্জামান আরও বলেন, শেখ জুয়েলের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেই মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁরা ভিত্তিহীন অভিযোগ করছেন।
জেলা পুলিশের বিজ্ঞপ্তি
পুলিশের হেফাজতে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজেদের বক্তব্য স্পষ্ট করেছে জেলা পুলিশ। শুক্রবার বিকেলে কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতকাল বিকেলে বাঙ্গরা বাজার থানার উত্তরপাড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে আসামি শেখ জুয়েল বৃহস্পতিবার রাত আনুমানিক আটটায় থানাহাজতে অবস্থানকালে বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর পরিবারকে জানিয়ে থানা-পুলিশের সহযোগিতায় মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত আটটা ৫০ মিনিটে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ সুপার উল্লেখ করেন, ‘শেখ জুয়েলের দীর্ঘদিন ধরে হার্টের সমস্যা ছিল বলে পারিবারিকভাবে জানা যায় এবং ইতিপূর্বে তিনি স্ট্রোক করেছিলেন বলেও জানা যায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে পুলিশি নির্যাতনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে মর্মে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে, যা একেবারেই ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট। ইতিমধ্যে তাঁর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাওয়া গেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’ প্রকৃত সত্য না জেনে এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা সম্পর্কে কোনো ধরনের অপপ্রচার না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
আরও পড়ুনইয়াবাসহ গ্রেপ্তার বিএনপি কর্মীর পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতনে হত্যার অভিযোগ পরিবারের১১ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স শ খ জ য় ল র মরদ হ ন প রথম আল ক ময়ন তদন ত ম র দনগর আম র ভ ই পর ব র র চ ক ৎসক ব এনপ র অবস থ য় কর ম র আ চড় র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার বিএনপি কর্মীর পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতনে হত্যার অভিযোগ পরিবারের
কুমিল্লার মুরাদনগরে গতকাল বৃহস্পতিবার ৭০টি ইয়াবাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে শেখ জুয়েল (৪৫) নামে একজন পুলিশ হেফাজতে মারা গেছেন।
নিহত জুয়েল উপজেলার বাঙ্গরা গ্রামের শেখ বাড়ির প্রয়াত শেখ গোলাম সারোয়ারের ছেলে। তাঁর ওই এলাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার ব্যবসা ছিল। তিনি বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে জানিয়েছেন মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন অঞ্জন। তাঁর ভাই বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের নির্যাতনে জুয়েলের মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলার বাঙ্গরা এলাকা থেকে পাঁচজনকে মাদক সেবনের সময় গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে ৭০টি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। পরে তাঁদের থানায় নেওয়া হয়। থানায় আনার পর শেখ জুয়েল অসুস্থবোধ করলে তাঁকে রাত ৮টা ৫০ মিনিটে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানেই তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘শেখ জুয়েলকে আমরা মৃত অবস্থায় পেয়েছি। তাঁর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না।’
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) এ কে এম কামরুজ্জামান বলেন, শেখ জুয়েল একজন চিহ্নিত মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী। তাঁর মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রয়োজন। তবে তাঁর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।
শেখ জুয়েলের চাচাতো ভাই ও স্থানীয় বিএনপি নেতা শেখ সফিকুল ইসলাম বলেন, বাঙ্গরা বাজার থানার এসআই আল-আমিনের নেতৃত্বে জুয়েলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি (এসআই আল-আমিন) জানান, জুয়েলকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
আটক করার পর শেখ জুয়েলকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন তাঁর স্ত্রী শিল্পী বেগম। তিনি বলেন, ‘(গতকাল) দুপুরের পর জানতে পারি, পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে। থানায় গিয়ে দেখা করি। তিনি সুস্থ ছিলেন। আমাকে বলেন, “আমি কিছু করিনি, আমাকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা কর।” এরপর খবর পাই তিনি মারা গেছেন। একজন সুস্থ মানুষ এভাবে মারা যেতে পারে না। তাঁকে নির্যাতন করে মারা হয়েছে।’
এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন বিএনপির নেতারা। গতকাল রাতে সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেনের (কায়কোবাদ) ছোট ভাই কাজী শাহ আরফিন ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘মুরাদনগরের বাঙ্গরা থানায় পুলিশের হেফাজতে বিএনপির একজন কর্মী নিহত হয়েছেন, যার বিরুদ্ধে কোনো মামলাই ছিল না। একটি স্বাধীন দেশের থানায় বিনা অপরাধে এভাবে একজন নাগরিকের মৃত্যু শুধু অমানবিকই নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অপব্যবহার ও দমননীতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। ন্যায়বিচারের নামে যদি মানুষ হত্যা হয়, তাহলে সেটাকে বিচার নয়, বর্বরতা বলা হয়। এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’