ইরান নিয়ে ট্রাম্পের উভয় সংকট এবং পুতিনের পরামর্শ
Published: 20th, June 2025 GMT
ইরানের ওপর ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ স্পষ্টত ব্যর্থ হচ্ছে। রাশিয়ান মিডিয়া জানিয়েছে: ১. ইসরায়েলের রাফায়েল অস্ত্র কমপ্লেক্স ধ্বংস হয়ে গেছে; ২. হাইফা তেল শোধনাগারে আগুন লেগেছে; ৩. আয়রন ডোমেকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়েছে এবং ৪. ইসরায়েলের আকাশ-আধিপত্য কাল্পনিক এক গল্প মাত্র।
মঙ্গলবার ইরান প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার আরেকটি ঢেউ আছড়ে পড়ে দক্ষিণ ইসরায়েলের নেভাটিম বিমানঘাঁটির ওপর, যেখানে স্টিলথ ফাইটার জেট, পরিবহন বিমান, ট্যাঙ্কার বিমান এবং ইলেকট্রনিক অনুসন্ধান/নজরদারির জন্য মেশিন ইত্যাদি স্থাপন করা আছে।
এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি অভিজাতদের যুক্তিবাদী অংশ উদ্বিগ্ন। মোসাদের সাবেক প্রধান ড্যানি ইয়াতোমকে উদ্ধৃত করে খবর বেরিয়েছে– ‘ইরানিরা হাঁটু গেড়ে বসবে না; তারা আত্মসমর্পণের পতাকা তুলবে না এবং আত্মসমর্পণ করবে না!’ মার্কিন সম্প্রচার টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এনবিসি জানিয়েছে, ইসরায়েল পশ্চিমা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইরানকে প্রতিশোধমূলক আক্রমণ বন্ধ করে পারমাণবিক আলোচনায় ফিরে যেতে বলেছে। এটি সম্ভবত রোববার ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্পের পোস্টের– ইসরায়েল ও ইরান তার মধ্যস্থতার মাধ্যমে ‘একটি চুক্তি’ করে তাদের সহিংস সংঘাতের অবসান ঘটাবে; ব্যাখ্যা হতে পারে। ট্রাম্প লিখেছেন, ‘শিগগিরই আমরা ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে শান্তি ফিরে পাব। এ নিয়ে অনেক আহ্বান ও বৈঠক হচ্ছে।’ এমনকি তিনি সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাফল্যের উপমাও তুলে ধরেছেন।
ট্রাম্পকে আসলেই একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশেষ করে কীভাবে সামনের আগ্রাসী যুদ্ধ থেকে ইসরায়েলকে উদ্ধার করা যায়। ট্রাম্প ইসরায়েল লবির তিনটি অংশেরই কথা শুনতে বাধ্য– ইহুদিবাদী, গোঁড়া খ্রিষ্টান ও ধনী ইহুদি অভিজাত গোষ্ঠী, যারা মার্কিন রাজনীতিতে রাজত্ব করছে।
ট্রাম্প কতটা অস্থিরতায় ভুগছেন, দেখুন। ১৬ জুন সোমবার কানাডায় জি৭ শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বিরক্তিকর মেজাজে ছিলেন এবং সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফেরেন। এ নিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ কেবল মন্তব্য করেছিলেন, ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করতে তাড়াহুড়ো করে ফিরে গেছেন। ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছেন, ‘ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ভুল করে বলেছেন যে আমি কানাডায় জি৭ শীর্ষ সম্মেলন ছেড়ে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে ‘যুদ্ধবিরতি’ নিয়ে কাজ করার জন্য (ওয়াশিংটন) ডিসিতে ফিরে যেতে চাইছি। ভুল! তিনি জানেন না– কেন আমি এখন ওয়াশিংটনে যাচ্ছি। তবে যুদ্ধবিরতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।… ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, ইমানুয়েল সর্বদা ভুল করেন। সতর্ক থাকুন!’
 চার ঘণ্টা পর তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই, কোনো আকারে বা প্রকারে ‘শান্তি আলোচনা’র জন্য ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ করিনি।… যদি তারা কথা বলতে চায়, তারা জানে কীভাবে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তাদের টেবিলে থাকা চুক্তিটি গ্রহণ করা উচিত ছিল– অনেক জীবন বাঁচানো যেত!!!’ সাত ঘণ্টা পর ট্রাম্প দাবি করেন, ‘এখন ইরানের আকাশের ওপর আমাদের সম্পূর্ণ এবং সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।’
কিন্তু কয়েক মিনিট পর ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে হুমকি দিয়ে বলেন: “আমরা ঠিক জানি তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ নেতা’ কোথায় লুকিয়ে আছেন। তিনি সহজ এক লক্ষ্যবস্তু, কিন্তু সেখানে নিরাপদ আছেন– আমরা তাঁকে বের (হত্যা!) করতে যাচ্ছি না, অন্তত আপাতত নয়।’ সাত মিনিট পর আরও একটি বাজে পোস্ট বড় অক্ষরে লেখা হয়েছিল: ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ!’
 সম্ভবত ট্রাম্প মঙ্গলবার দিনটা শেষ করেছেন ইরানকে হাঁটু গেড়ে বসতে নির্দেশ দিয়ে। কিন্তু তা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। বাস্তবে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবদুর রহিম মুসাভি মঙ্গলবার বলেছেন, এখন পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানগুলো নিছক প্রতিরোধমূলক সতর্কতা; প্রকৃত ‘শাস্তিমূলক অভিযান’ শিগগিরই শুরু হতে চলেছে। জেনারেল তেল আবিব এবং হাইফার বাসিন্দাদের ‘তাদের জীবন বাঁচাতে এই অঞ্চলগুলো ছেড়ে যেতে’ বলেছিলেন।
ট্রাম্পের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হলো, এর কোনো দ্রুত সমাধান চোখে পড়ছে না। মার্কিন হস্তক্ষেপ এমন এক মহাদেশীয় যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে, যা ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্ব শেষ হওয়ার পরও চলবে। ২০০৩ সালে বুশের ইরাক আক্রমণ তাঁকে ধ্বংস করেছিল। উপরন্তু ট্রাম্পকে তখন আমেরিকা ফার্স্ট, মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন– ম্যাগা অভিযান, ইউক্রেন, তাইওয়ান, শুল্ক যুদ্ধ, অভিবাসন, মুদ্রাস্ফীতি, চীন ইত্যাদি ভুলে যেতে হবে।
এমনকি ইউরোপীয় মিত্ররাও ট্রাম্পের পাশে দাঁড়াবে না। ট্রাম্পের বিদায়ের পর জি৭ শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে মাখোঁ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকে সবচেয়ে বড় ভুল হবে সামরিক উপায়ে ইরানে শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা। কারণ এতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও বিবৃতি দিয়ে ট্রাম্পকে ইরানে কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ না চালাতে পরামর্শ দিয়েছেন। ভুলে যাবেন না, এই সংশয়বাদীদের মধ্যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও আছেন, যার বিদেশি হস্তক্ষেপের সাফল্য নিয়ে সন্দেহের সূত্রপাত হয়েছিল ইরাকে তিনি মার্কিন মেরিন সেনা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে। তখনই তিনি আমেরিকার হস্তক্ষেপবাদী শাসন পরিবর্তন প্রকল্প এবং এ অঞ্চলে দুর্ভাগ্যজনক ‘চিরকালের যুদ্ধ’ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন।
এদিকে বুধবার রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি মিডিয়া ইভেন্টে পুতিন বলেছেন, এ বছরের জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত রাশিয়া-ইরান ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে ইরানই পারস্পরিক প্রতিরক্ষা ধারা অন্তর্ভুক্ত করতে চায়নি (যেমন রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে করেছে); তদুপরি মার্কিন-ইসরায়েলি দানবের সঙ্গে লড়াই চালাতে গিয়ে তেহরান এখন পর্যন্ত মস্কোর কোনো সাহায্য চায়নি!
 ট্রাম্প এখান থেকে একটি শিক্ষা নিতে পারেন। সেটা হলো, ইরান একটি অত্যন্ত স্বাধীনচেতা দেশ। নিঃসন্দেহে সে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি উৎপাদনশীল সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী; অবশ্যই তা আমেরিকার মতো নয়। ইরানি নেতার শিরশ্ছেদ করলেও ট্রাম্পকে আগামী কয়েক দশক মার্কিন-ইরান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা ভুলে যেতে হবে। এমনও হতে পারে, ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্বের মধ্যেই পশ্চিম এশীয় অঞ্চলে মার্কিন অবশিষ্ট প্রভাবও চলে যাবে। পুতিনও বুধবার যা বলেছেন, তার সারমর্ম– ওয়াশিংটনের সন্তুষ্টির জন্য ইরানে শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন কেবল একটি স্বপ্নই থেকে যাবে।
ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন প্রতিরক্ষা শিল্পের কথা উল্লেখ করে পুতিন বলেন, ‘আমি কেবল চারপাশ থেকে যা জানি এবং শুনেছি তার পুনরাবৃত্তি করব। এই ভূগর্ভস্থ কারখানাগুলো এখনও বিদ্যমান, তাদের কিছুই হয়নি এবং এ প্রসঙ্গে আমার মনে হয়, আমাদের সবার জন্য একসঙ্গে শত্রুতা শেষ করার উপায় অনুসন্ধান করা সঠিক হবে.                
      
				
পুতিন বলেছেন, মস্কো ‘আমাদের ইরানি বন্ধুদের কিছু নির্দিষ্ট সংকেত দিয়েছে যে সাধারণভাবে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে ইরানের স্বার্থ সুরক্ষিত করা সম্ভব এবং একই সঙ্গে ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগ দূর করাও সম্ভব।
আমরা আবারও আমাদের সব অংশীদারের কাছে সেগুলোর রূপরেখা তুলে ধরেছি: যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, এমনকি ইরানের কাছেও। আমরা কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। কেবল পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাব্য উপায় কী দেখছি; তা নিয়ে কথা বলছি। তবে সমাধান অবশ্যই এসব দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে লুকিয়ে আছে, সর্বোপরি ইরান ও ইসরায়েলের কাছে।’
 সত্যি বলতে, ইরান আলোচনার টেবিলে সহজ দেশ নয়। বিশেষত জাতীয় স্বার্থ ও কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন রক্ষার প্রশ্নে দেশটি খচ্চরের মতো একগুঁয়ে হতে পারে। প্রায় ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে একটি সভ্যতা রাষ্ট্র বলে পরিচিত জাতির যৌথ চেতনার কথা বিবেচনায় নিতে হবে। পুতিন বলেছেন, ‘রাশিয়া একবার ইরানের জন্য যৌথভাবে একটি সমন্বিত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু (ইরানি) অংশীদাররা খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি এবং এটিই সত্য।’ 
পুতিন সম্ভবত বুঝতে পারছেন যে ইরানে মার্কিন হস্তক্ষেপের আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্যই তিনি এ নিয়ে চিন্তিত। নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প উভয়ের প্রতি পুতিনের আপাত সরল তবে বাস্তবে জটিল পরামর্শ: ‘কোনো কিছু শুরু করার সময় তা আদৌ অর্জনযোগ্য কিনা– খেয়াল রাখা উচিত।’
এম কে ভদ্রকুমার: ভারতীয় সাবেক কূটনীতিক, ভূরাজনীতি বিশ্লেষক; ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন থেকে ভাষান্তর করেছেন
 সাইফুর রহমান তপন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প ত ন বল ব যবস থ র জন য আম র ক আম দ র বল ছ ন ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূলে রয়েছে কৃষি। এই কৃষির বিবর্তনের গল্প, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য যেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।
সময়ের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই হারানো ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও তুলে ধরার প্রয়াসেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জাদুঘর।
আরো পড়ুন:
জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ২০ শিক্ষার্থী
গোপনে বাকৃবি ছাত্রীদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে সাবেক ছাত্রকে দিতেন আরেক ছাত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঠিক সামনেই সবুজ দেবদারু গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই কৃষি জাদুঘর। প্রকৃতির কোলে যেন কৃষির ইতিহাস কথা বলে এখানে।
২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন।
নানা প্রতিবন্ধকতা ও জনবল সংকটের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এটি পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেশের কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির এক জীবন্ত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।
৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই অষ্টভুজ আকৃতির ভবনটি স্থাপত্যগত দিক থেকেও দারুণ দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাশে প্রাচীন সাতটি খনার বচন। প্রবেশমুখের ঠিক পরেই দুটি অফিস কক্ষ, আর একটু ভেতরে এগোলেই দেখা যায় একটি ছাদহীন বৃত্তাকার বাগান, যা প্রাকৃতিক আলোর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। সেই বাগানের চারপাশেই রয়েছে সংরক্ষণশালার বিভিন্ন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই যেন কৃষির একেকটি অধ্যায়।
জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো বীজ সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, তিসি, চিনাবাদাম, কাউনধান, ফ্রেঞ্চ বিন, ফাবা বিনসহ নানা ফল ও সবজির বীজ। দেখা মেলে বিরল প্রজাতির তৈকর ফলের বীজ, যা একসময় আচার ও জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্না বীজ, যার তৈল দিয়ে কসমেটিক ও ঔষধি পণ্য তৈরি হয়।
মাটির নানা প্রকার নমুনা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সার, এমনকি পাহাড়ি চাষাবাদের মডেলও স্থান পেয়েছে এখানে।
শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও দর্শনার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন ফসল রোগের চিত্র, আক্রান্ত বীজ, ও ব্যাকটেরিয়ার নমুনা। এ অংশের এক বিশেষ আকর্ষণ আড়াই কেজি ওজনের এক বিশাল মিষ্টি আলু, যা দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
জাদুঘরের আরেক অংশ যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘর। এখানে প্রদর্শিত আছে বুনো মহিষ, হরিণের শিং, গরু, অজগর ও গোখরা সাপের কংকাল। রয়েছে সংরক্ষিত কালো মেটো ইঁদুর, ধারাই সাপ, এবং কচ্ছপের খোল ও কঙ্কাল।
উপরে তাকালে দেখা যায় এক বিশাল প্রিজার্ভড শকুন, সে যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। রয়েছে প্লাটিপাসের কংকালও, যা এক বিরল প্রাণীর বাস্তব নিদর্শন। প্রতিটি নমুনাই যেন দর্শনার্থীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল ফসল বা জমির নয়, এটি প্রকৃতি ও প্রাণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যও এখানে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এক কক্ষে সাজানো আছে ঢেকি, কুলা, পানের ডাবর, হুকা, হারিকেন, কুপি বাতি, গরুর গাড়ির মডেল, এমনকি মাছ ধরার পুরোনো যন্ত্রও। রয়েছে তবলা, বেহালা, আদুরী, ক্রাম ও নাতকসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।
এক পাশে দেখা যায় ‘গিলা’, যা একসময় বর-কনের গোসল অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো নামটিও জানে না, অথচ এটি ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ।
আরো রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির পূর্ণাঙ্গ মডেল, যা দেখতে যেন একেবারে বাস্তব কৃষকের ঘর। এখানে দেখা যায় কৃষকের হালচাষের দৃশ্য, রান্নাঘর, ধান রাখার গোলা, গরুর খোঁয়াড় এবং গৃহিণীর সাজানো রান্নার জায়গা। যেন একবারে গ্রামের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল আর মডেলের মধ্যে।
প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে পুরনো মাইক্রো কম্পিউটার, ডট প্রিন্টার, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, ঘাণি, ডিঙি নৌকা, কাঁঠের তৈরি গরুর গাড়ি, তালগাছের কুন্দা ও উপজাতিদের পোশাক। এক পাশে ঝুলছে হরিণের চামড়া, অন্য পাশে সাজানো উপজাতীয় কৃষি উপকরণ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই উপকরণগুলো কেবল প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং কৃষির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মেলবন্ধনের প্রতীক।
জাদুঘরের আরেক বিশেষ প্রদর্শনী হলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এগুলো দেখে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জাদুঘরের প্রতিটি কোণ যেন বলে, কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। এখানকার প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মডেল, প্রতিটি নমুনা কৃষির বিকাশ ও মানুষের সংগ্রামের গল্প বহন করে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে কৃষির অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যন্ত এক নজরে দেখতে পান।
বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে উপকরণসমৃদ্ধ কৃষি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এটিকে দোতলা ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে কৃষি ভিত্তিক ১৪টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি উপকরণ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।”
তিনি আরো বলেন, “দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে টিকিট ব্যবস্থা চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।”
এই কৃষি জাদুঘর শুধু কৃষি উপকরণের প্রদর্শনী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্কের এক সজীব দলিল। শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এখানে আসে, তবে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে যায় মাটির গন্ধে, কৃষকের ঘামে, বাংলার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল সৌন্দর্যে।
জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এবং প্রতি শনিবার বন্ধ থাকে। সময় সুযোগে একবার ঘুরে গেলে দেখা মিলবে বাংলাদেশের কৃষির হাজার বছরের গল্প, যা মাটি, ঘাম, বীজ আর ঐতিহ্যের বন্ধনে গাঁথা এক অনবদ্য ইতিহাস।
ঢাকা/মেহেদী