বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে তাকালে রবীন্দ্রনাথের একুশ লাইনের ‘মরীচিকা’ কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায়। শেষ স্তবকে কবি বলছেন: ‘যারে বাঁধি ধরে তার মাঝে আর/ রাগিণী খুঁজিয়া পাই না।/ যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই/ যাহা পাই তাহা চাই না।’ আমরা কি মরীচিকার পেছনে ছুটছি?

শৈশবে পাঠ্যবইয়ে মরীচিকার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। ধু–ধু মরুভূমিতে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত পথিক দূরে জলের দেখা পায়। তপ্ত বালুরাশির ওপর সূর্যের আলোর প্রতিফলন জলের বিভ্রম একসময় ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। আমরা যেন মরীচিকার পেছনে ছুটছি। কিছুতেই ধরতে পারছি না। রাজনীতিবিদেরা শিখিয়েছেন, তাঁদের কথা শুনলে, তাঁদের দেখানো পথে চললে আমরা সুখের সৈকতে পৌঁছে যাব। সেই থেকে আমরা হাঁটছি, ঘুরছি, দৌড়াচ্ছি; কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। সুখের দেখা মেলে না।

নেতারা একটার পর একটা ইশতেহার দেন। কত সুন্দর সুন্দর নাম সেগুলোর। গণতন্ত্রের চারণভূমিতে পৌঁছাব, সমাজতন্ত্র এল বলে। সেখানে কোনো বৈষম্য নেই। দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়েছে। তাঁদের ভোট দিলে সার্বভৌমত্ব টিকে যাবে। তারপর আমাদের যা চাহিদা, সব মিটে যাবে। আমরা কত কিছু চাই। আমাদের চাওয়াগুলোর কী সুন্দর ভাষা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ: অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,/ চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু।

দুই.

একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলো। দেশ স্বাধীন হলো। মানুষ স্বাধীন হলো না। জন্মের পর থেকে দেখছি ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’। আন্দোলন, সরকার বদল, স্বপ্নভঙ্গ, আবার আন্দোলন, সরকার বদল, আবারও স্বপ্নভঙ্গ। এ এক বৃত্তাকার চক্র। যেখান থেকে শুরু, সেখানেই ফিরে আসা। বৃত্ত আর ভাঙে না।

দেশপ্রেম মানুষের একটা সেন্টিমেন্ট। উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা তার অনুষঙ্গ। উন্নয়ন না হলে দেশের দরকার কী। মানুষের এই সেন্টিমেন্ট নিয়ে হাডুডু খেলে পাকা খেলুড়েদের কতিপয় সিন্ডিকেট। তারা ঘাড়ে-গর্দানে স্ফীত হয়। তারা অনেকেই টেম্পো ছেড়ে বিএমডব্লিউ চড়ে। এক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আরেক সিন্ডিকেট আশার বাণী শোনায়। আমরা পাঁচ-দশ বছর আগের কথা ভুলে যাই। আবারও ছুটি মরীচিকার পেছনে।

সোনার বাংলা শ্মশান কেন—এই জিজ্ঞাসা থেকে আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন একসময় পৌঁছে গেল তুঙ্গে। আমরা স্বাধীন হলাম। আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা আমাদের উপহার দিলেন শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মন্বন্তর। গুদামে চাল পচে। মানুষ না খেতে পেয়ে রাস্তায় মরে। তখন থেকেই আমরা দেখেছি একের পর এক হীরক রাজার শাসন। কখনো সিভিল পোশাকে, কখনো সামরিক উর্দিতে।

জনগণের আকাঙ্ক্ষা আর সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে ঘটল একের পর এক পালাবদল। একাত্তর, পঁচাত্তর, নব্বই, ছিয়ানব্বই এবং সর্বশেষ চব্বিশ। আমরা দেখলাম ইতিহাসের দীর্ঘতম জুলাই। মনে হয়েছিল, জীবন-মরণ করি পণ/ শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড/ এসো মোরা মিলি একসাথ।

 একটা জগদ্দল পাথর সরে গেল; কিন্তু তারপর?

তিন.

৩৬ জুলাই কি অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ, বিপ্লব, নাকি দাঙ্গা। এ নিয়ে কণ্ঠজীবী আর কলমজীবীদের বাহাস চলছে। একটি শব্দ নিয়ে আমরা একমত হতে পারছি না। আমরা নাকি দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। সবাই এত স্বাধীন, যে কেউ যা খুশি করতে পারে। অমুককে ধরো, তমুককে মারো, এই চলছে দিনরাত। এটাই নাকি বিপ্লবের নিয়ম যে সে কোনো নিয়ম মানে না। ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে শোনা গানের সেই চরণের কথা মনে হয় ‘পুরোনো সব নিয়ম ভাঙে অনিয়মের ঝড়।’ আমরা সেই ঝড়ের কবলে পড়েছি।

দেশটা যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। কর্তারা সংবিধানের শব্দাবলি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারি দপ্তরে সেবা পাওয়া যায় না। গণপরিবহনে অব্যাহত আছে মাফিয়া রাজত্ব। গাঁওগেরামের ছেলেরা ড্রোন আর বিমান বানাচ্ছে। আর আমাদের সেরা প্রকৌশলবিদদের আঁতুড়ঘরে তৈরি হচ্ছে রিকশা। অথচ আমাদের দরকার ছিল কয়েক হাজার আধুনিক বাস। একটা জাতি কতটা পশ্চাৎপদ মানসিকতায় ভুগলে এমন হতে পারে!

আমরা থ্রি জিরোর গল্প শুনছি। লোকে ঠাট্টা করে বলে—আমাদের এখন জিরো গ্রোথ, জিরো এমপ্লয়মেন্ট, জিরো ল অ্যান্ড অর্ডার। আগে আমার কী দরকার? ইউরোপ শিল্পোন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির চূড়ায় উঠে এখন মানবিক হচ্ছে। আর আমরা এখনো ভালোভাবে ‘টেক অফ’ করতে পারিনি। আমরা কি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ব? আমাদের অগ্রাধিকার কি আমরা বুঝব না? দেশে এখন যে জিনিসটার চাষ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে, তা হলো ‘হতাশা’। রাজনীতির রেটোরিকের বাইরে আমরা এখনো যেতে পারিনি। সবাই আছেন বাঁধা বুলিতেই। কেউ বলেন ৩১ দফা, কেউ বলেন নয়া বন্দোবস্ত, কেউ বলেন দায় ও দরদের রাজনীতি। চমৎকার শব্দাবলি!

বড় ক্যানভাসে চিন্তা করলে দেখা যাবে, একটা জাতির জীবনে এক বছর কিছুই না। কিন্তু আমরা তো শূন্য থেকে শুরু করছি না। ১৯১৯ সাল থেকে এ দেশে নির্বাচন হচ্ছে। একাধিক রাজনৈতিক দল শত বছরের পুরোনো। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কি কিছু শিখেছি? নাকি প্রতি পাঁচ বছর পরপর আমরা নতুন করে শুরু করছি?

দেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত শব্দ হলো সংস্কার। সংস্কার কি শুধু সংবিধানে হবে? আমাদের অগ্রাধিকারের জায়গাগুলো কী? শুধু সংবিধান খেয়ে কি মানুষ বাঁচবে? মানুষকে শান্তি আর স্বস্তি দিতে যে চারটি সেবার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তা হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন এবং জননিরাপত্তা। এ চারটিতেই আমাদের স্কোর খারাপ। এসব জায়গায় কাজ করতে হলে কি নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার আছে? শুরু তো করা যায়? আমরা তো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখছি না।

চার.

সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটা থাকলেই আমরা অনেকে খুশি। ওটা বাদ দেওয়া যাবে না। আবার আমরা ‘খিলাফত’ও চাই। রাজনীতিবিদেরা এসব শব্দ নিয়ে মল্লযুদ্ধ করতে থাকুক। তাঁদের তো আর খাওয়া-পরার ভাবনা নেই।

মানুষকে বাঁচাতে হলে তার জন্য চাই নানান আয়োজন। এ মুহূর্তে সবচেয়ে দরকার আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এ দুটি বিষয় নিয়ে কে কী ভাবছেন, সেটি জানা দরকার। বায়বীয় রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে শূন্যে আস্ফালন করে কী হবে? রাজনীতির চিরাচরিত মডেল আর এ দেশে কাজ করবে না।

জুলাই আন্দোলনে দেখেছি, নারী-পুরুষ, শিশু–কিশোর, তরুণ-প্রবীণনির্বিশেষে মানুষ প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে পথে বের হয়েছিলেন। এই লক্ষ কোটি মানুষ তো বিসিএস আর কোটা নিয়ে মাতম করেনি। তারা একটা দম বন্ধ করা পৈশাচিক শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল ছাত্রদের। জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে দাবিটা চাকরির কোটা অতিক্রম করে এক দফার আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। হাতে গোনা কিছু সুবিধাভোগী আর পরিবারপূজারি ছাড়া সবাই চেয়েছে হাসিনার পতন। আটঘাট বেঁধে, ব্লু-প্রিন্ট বানিয়ে, মিশন-ভিশন স্থির করে আন্দোলন হয়নি, তাই হাসিনা পালানোর পর একটা প্রশ্ন সামনে এসে গেছে—এখন আমরা কোন পথে চলব?

সবাইকে নিয়ে একটা সামাজিক চুক্তি করা ছাড়া সামনে এগোনো যাবে না। এখানে যদি কেউ মনে করেন আমরা বেশি বুঝি, অন্যরা কম বোঝে, সবাইকে হেদায়েত করার দায়িত্ব আমাদের, তাহলে ভুল হবে। সবাইকে নিয়ে চলার মানসিকতা এবং সক্ষমতাই বলে দেবে আমরা এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব কি না।

বাংলাদেশটা কিন্তু এখনো উত্তপ্ত। ৩৬ জুলাই ইতিহাসের চাকা থেমে গেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কোনো কিছুই মীমাংসিত নয়।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পর এক আম দ র র জন ত সবচ য় দরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ডুরান্ড লাইনের দুদিকে ভূরাজনৈতিক ট্র্যাজেডিতে পাকিস্তান

রাজনীতি অনেক সময় বন্ধুত্ব ও শত্রুতার মেরুকরণ বিস্ময়করভাবে বদলে দেয়। ভূরাজনীতির বেলায়ও সে রকম ঘটে। তবে পাকিস্তানের শাসকদের জন্য আফগান তালেবান সরকারের আচরণ অনেকটাই ট্র্যাজেডির মতো। অচিন্তনীয় এক দুর্বিপাকও বলা যায় একে। কেন এমন হলো? পেছনে ফিরে তাকালে কী দেখি আমরা? এর ভবিষ্যৎ পরিণতি কী?

পাল্টাপাল্টি হামলা ডুরান্ড লাইনের দুই দিকে

গত কয়েক সপ্তাহ আফগানদের সঙ্গে পাকিস্তানের দুই দফা বড় আকারে সংঘর্ষ হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত কাবুল ও কান্দাহারে পাকিস্তানের বোমাবর্ষণ থেকে। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপির নেতা নুর ওয়ালি মেসুদকে হত্যা করতে তারা আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল।

এর প্রতিক্রিয়ায় আফগান তালেবান যোদ্ধারা পাকিস্তানের অনেকগুলো সীমান্তচৌকিতে হামলা করেন। ব্যাপক ক্ষতি হয় তাতে। আফগানদের দাবি, ৫৮ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেছে তারা। পাকিস্তান ২০ জনের কথা স্বীকার করেছে।

সংখ্যা কমবেশি যা–ই হোক, আফগানদের এই হামলা পাকিস্তানের জন্য অবিশ্বাস্য এক অভিজ্ঞতা ছিল। তাদের সশস্ত্র বাহিনীর মান-ইজ্জত হুমকিতে ফেলে। পাল্টা হামলা চালিয়ে তারা আফগানদের ১৯টি সীমান্তচৌকি ভেঙে দেয়। এই পাল্টাপাল্টি হামলা থামাতে সৌদি আরব ও কাতারকে মধ্যস্থতা করতে হয়। কিন্তু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় তাতে কমেনি।

এই ঘটনার সময় ও পটভূমি নজরে রাখার মতো। তালেবান ও পাকিস্তানের যোদ্ধারা যখন পরস্পরের সীমান্তে মৃতের সংখ্যা বাড়াতে ব্যস্ত, তখন আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি দিল্লিতে ভারতের অতিথি হিসেবে জনসংযোগে ব্যস্ত। এরই কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র যে আফগানদের বাগরাম বিমানঘাঁটি চেয়ে বসেছে, সেটাও পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংঘর্ষের একটা দূরবর্তী পটভূমি হিসেবে আছে।

মাওলানা মুত্তাকির সফর ভারতে তুমুল আগ্রহ তৈরি করেছে। এর পরপরই নয়াদিল্লি কাবুলে দূতাবাস নিয়ে ফেরার ঘোষণা দিল। ২০২১–এর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে যে দেশ থেকে ভারতীয় কূটনীতিবিদদের প্রায় প্রাণভয়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল, সেখানে মুত্তাকি আবার তাঁদের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।

এটা ইসলামাবাদের ভয়াবহ এক কূটনৈতিক বিপর্যয় হিসেবে গণ্য হয়েছে। এর ভূরাজনৈতিক তাৎপর্যও বিপুল। অথচ মাঝবয়স থেকে মুত্তাকির পড়াশোনা ও বড় হওয়া শরণার্থী হিসেবে পাকিস্তানেই।

কোথা থেকে দুর্বিপাকের শুরু

প্রশ্ন উঠেছে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে এত যে কূটনৈতিক ও সামরিক দূরত্ব বাড়ছে, তার গোড়ার কারণ কী? নিঃসন্দেহে উত্তর হলো, টিটিপি।

২০২১–এর আগস্টে তালেবান কাবুল দখল করে সরকার গঠন করামাত্র পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখাওয়া বা কেপি নামে পরিচিত) সেখানকার তালেবান সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়ে। পাকিস্তানে আগে থেকে বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন চলছে।

টিটিপি কেপিতে সক্রিয় হওয়ামাত্র দেশটির সশস্ত্র বাহিনী দুটি প্রদেশের বিশাল এলাকাজুড়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। কেবল ২০২৪ সালে কেপিতে পাকিস্তানের আড়াই হাজার সামরিক ও বেসামরিক মানুষ মারা গেছেন। এ বছর ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি। এখন সীমান্তেও জওয়ানদের হারাতে হচ্ছে পাকিস্তানকে।

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কাবুলে তালেবানদের ক্ষমতা দখলমাত্র পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে কবরস্থান খোঁড়ায় বেশি সময় ও শ্রম বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। অথচ এই তালেবানকে একদা তারাই অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও ভাবাদর্শ দিয়ে গড়ে তুলেছিল।

যে অধ্যায়ের শুরু ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সেদিন আফগানিস্তানের ‘সাম্যবাদী’ সরকারকে রক্ষায় দেশটিতে সৈন্য পাঠায়। তাদের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের এটা মনঃপুত ছিল না।

মস্কো-ওয়াশিংটনের সেই ঠান্ডা যুদ্ধে জড়ায় পাকিস্তানের জেনারেল জিয়াউল হক সরকার। অন্যভাবে বললে, এই যুদ্ধে জড়ানোর জন্যই তাঁকে ক্ষমতায় আনা হয়েছিল।

জিয়ার অধীনে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রক্সি’ বা ছদ্ম প্রতিনিধি হিসেবে আফগানিস্তানে রুশদের মোকাবিলায় সশস্ত্র দল গড়ার কাজে নামে। সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সেই যৌথ প্রকল্পেরই সর্বশেষ সংস্করণ ছিল তালেবান।

জিয়াউল হকের পর পাকিস্তানের অন্যান্য সরকারও এই প্রকল্প চালিয়ে গেছে। বিনিময়ে তারা চাহিদামতো অর্থ ও সামরিক সহায়তা পেয়েছে রিয়াদ ও ওয়াশিংটন থেকে।

জনগণকে ইসলামাবাদের শাসকেরা তাঁদের আফগান ভূমিকার পক্ষে যুক্তি হিসেবে বরাবর একটা কথাই বলেছেন, কাবুলে বন্ধুভাবাপন্ন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক বিপুল লাভ। সেই সরকারকে ব্যবহার করে আফগান ভূখণ্ড হয়ে মধ্য এশিয়ার পথে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুবিধা বাড়ানো যাবে।

শেষমেশ ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট সেই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কেবল রুশদের নয়, পরবর্তীকালে ন্যাটো বাহিনীকেও তাড়ায় আফগান পশতু মুজাহিদরা। সবই হয় পাকিস্তানের কূটনৈতিক, সামরিক, ভাবাদর্শিক সহায়তায়। ভারতীয় কূটনীতিবিদদেরও আফগানিস্তান ছাড়তে হয় ওই সময়।

ইসলামাবাদে নীতিনির্ধারকেরা এ সময় বেশ উল্লসিত ছিলেন। কেবল বন্ধুভাবাপন্ন সরকার প্রতিষ্ঠাই নয়, কেবল আফগান মাটি থেকে ভারতীয়দের তাড়ানোই নয়, ১ হাজার ৬০০ মাইল দীর্ঘ ডুরান্ড লাইন নামের সীমান্তরেখা নিয়ে সব দুর্ভাবনা কেটে গেছে বলে মনে করেছিলেন তাঁরা।

এ রকম একটা দীর্ঘ সীমান্তে সামরিক পাহারার খরচপাতি কমে যাওয়া মানে ভারতের সঙ্গে সীমান্তে শক্তি বাড়ানোর সুযোগ। এত সব ইতিবাচক প্রাপ্তির সময় পাকিস্তানের শাসকেরা তাঁদের ৪২ বছরের পুরোনো আফগান প্রকল্পের গলদটা টের পাননি। সেই অধ্যায়ের শুরু ২০২১–এর শেষার্ধ্ব থেকে।

তালেবানদের নতুন কৌশলে চীন ও ইরানও দুর্ভাবনায়

২০২১ সালে হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার নেতৃত্বে কাবুলে তালেবানদের ইসলামি আমিরাত সরকারের নিয়ন্ত্রণ যত দৃঢ় হয়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাকিস্তানের একই আদর্শের শক্তিগুলো জোটবদ্ধ হয়ে সে দেশেও একই আদর্শের সরকার কায়েমে নামতে শুরু করে। এর ফল হয়েছে বহুমাত্রিক।

প্রথমত, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের অখণ্ডতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুটি শক্তিশালী গেরিলাযুদ্ধ সামলাতে হচ্ছে। বালুচদের সশস্ত্রতা পুরোনো হলেও বাহিনী হিসেবে পশতুদের টিটিপি অনেক শক্তিশালী। চার দশকের যুদ্ধে অভিজ্ঞ তারা।

তা ছাড়া আফগানিস্তানকে নিরাপদ পশ্চাদ্‌ভূমি হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে। সেখানে আছে তাদের পুরোনো আফগান সহযোদ্ধারা। আছে একই আদর্শের সরকারও। আবার ৪১ বছর এই আদর্শবাদীদের নিজ ভূমিতে দায় ও দরদের সঙ্গে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে পাকিস্তানেরই বিভিন্ন সংস্থা। ফলে নিজ দেশেও এর বীজ রোপিত হয়েছে তাদেরই অজান্তে।

তালেবান ভারতকে ব্যবহার করে কেবল যে পাকিস্তান ও চীনের জন্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছে তা–ই নয়, ইরানের জন্যও কিছু মুশকিল আছে এতে। দক্ষিণ এশিয়ায় ইসরায়েল হলো ভারতের বিশেষ বন্ধু। এখন ভারতের কাবুল প্রবেশ পার্শ্ববর্তী ইরানের জন্য নিশ্চিতভাবে উদ্বেগের ব্যাপার। 

টিটিপি যে কেবল আফগান তালেবানদের মদদে পাকিস্তানে সশস্ত্র যুদ্ধ চালাচ্ছে, পাকিস্তানের এমন অভিযোগে সত্য চাপা দেওয়ার অপচেষ্টা রয়েছে যে পাকিস্তানের সমাজেই তালেবানের আদর্শের পক্ষে অনেক জনবল রয়েছে। কাবুলের সরকার ঠিক একই কথাই বারবার ইসলামাবাদকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু পাকিস্তানের বিবিধ চাপ সইতে না পেরে তারা এখন দুষ্ট কূটনীতির আশ্রয় নিয়েছে। মুত্তাকির ভারত সফর একটা দারুণ হিসাবি পদক্ষেপ ছিল তাদের জন্য। ভারতকে কাবুলে ফেরানোও একই রণনীতির অংশ। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের পাশাপাশি ইরান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকেও শক্ত বার্তা দিল।

পাকিস্তান বহুকাল ধরে অভিযোগ করে আসছে, নয়াদিল্লি বালুচদের বিচ্ছিন্নবাদী কাজে সহায়তা দেয়। সেই হিসাবে ভারতের কাবুল যাওয়া বালুচ গেরিলাদের জন্য উৎসাহ পাওয়ার মতো একটা ঘটনা। কোয়েটা থেকে কাবুলে যোগাযোগ যতটা সহজ, নয়াদিল্লি থেকে ততটা নয়।

বালুচ-ভারত সম্ভাব্য ঘনিষ্ঠতা চীনের জন্যও মহাবিপদের হতে পারে। কারণ, বালুচদের এলাকায় রয়েছে তার বিপুল বিনিয়োগের বিশাল
করিডর। ইতিমধ্যে অনেক চীনা বালুচদের হাতে মারাও পড়েছেন। 

তালেবান ভারতকে ব্যবহার করে কেবল যে পাকিস্তান ও চীনের জন্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছে তা–ই নয়, ইরানের জন্যও কিছু মুশকিল আছে এতে। দক্ষিণ এশিয়ায় ইসরায়েল হলো ভারতের বিশেষ বন্ধু। এখন ভারতের কাবুল প্রবেশ পার্শ্ববর্তী ইরানের জন্য নিশ্চিতভাবে উদ্বেগের ব্যাপার। 

মুত্তাকির ভারত অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও বার্তাবহ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যখন বেশ খারাপ, তখনই আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী নয়াদিল্লি গেলেন। ট্রাম্পের বাগরাম বিমানঘাঁটি চাওয়ার একটা হালকা প্রত্যুত্তর এটা। এভাবেই আফগানরা একই সঙ্গে ইরান, পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর–কষাকষিতে বেশ ভালো অবস্থানে আছে।

ভারতের জন্য মুহূর্তটা বেশি উপভোগ্য। পাকিস্তান নিরাপত্তা বিষয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তি করে চমক দেখিয়েছে বলে যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের জন্য কাবুল-নয়াদিল্লির নৈকট্য নিঃসন্দেহে আরও বড় চমক। এটা যদি ভারত-তালেবান-টিটিপি-বালুচ নেটওয়ার্ক তৈরি করার পথে সামান্যও অবদান রাখে, সেটা পাকিস্তান ও চীনের জন্য বড় এক দুর্ভাবনার বিষয় হতে বাধ্য।

পাকিস্তানের অদূরদর্শিতার ফল

পাকিস্তানের সম্ভাব্য এই সংকট তার ১৯৭৯ সালে শুরু করা অদূরদর্শিতা ও আত্মঘাতী প্রকল্পেরই অনিবার্য ফল। আফগানদের পণ্য হিসেবে অস্ত্র ধরিয়ে না দিয়ে সেদিন যদি দেশটির সরকারকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিক রূপান্তরে সহায়তা দেওয়া হতো, তাহলে যে সমৃদ্ধ আফগানিস্তান তৈরি হতো, সেটা আজকের অবস্থা থেকে পাকিস্তানের জন্য অনেক নিরাপদ ও বন্ধুভাবাপন্ন হতো। সে রকম হলে আজ আর পাকিস্তানকে ধর্মীয় মোড়কে সীমান্তের দুই দিকে পশতু জাতীয়বাদ মোকাবিলা করতে হতো না।

কাবুলে জাতিবাদী বিবেচনার ঊর্ধ্বে থাকা যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকার পাকিস্তানের জন্য আজকের কাবুল সরকারের চেয়ে বেশি উপকারী হতো। যেমনটি ঘটেছে রাশিয়ার বেলায় কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের দিক থেকে। শেষের এই তিন দেশে সাক্ষরতার হার এখন ৯৯ শতাংশ।  তিনটিই মুসলমানপ্রধান দেশ। চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিছুর কমতি নেই এসব দেশে।

গণতন্ত্রের ঘাটতি এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন থাকলেও এসব দেশ প্রতিবেশী রাশিয়ার জন্য কোনো দুর্ভাবনার কারণ হয়ে উঠছে না, বরং বন্ধুত্বপূর্ণ নিরাপদ পার্শ্বস্থল হয়ে আছে। আবার শিক্ষিত জনবল ও নিরাপত্তা থাকায় এসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়ছে।

মধ্য এশিয়ার এসব দেশের চেয়ে আফগানদের সমৃদ্ধির সুযোগ ছিল বেশি। অথচ এখন আফগানিস্তানে সাক্ষরতার হার ৩৭ শতাংশ। নারীদের বিদ্যাপীঠে যাওয়ার সুযোগ নেই। দু-তিন প্রজন্ম পর সেখানে উচ্চতর কারিগরি জনবলের ঘাটতির মধ্য দিয়ে যে সামাজিক সংকট তৈরি হবে, তার জন্য দোষের ভাগীদার আসলে ইসলামাবাদকেই হতে হবে। যুদ্ধের মধ্যে পড়ে লাখ লাখ আফগানকে পাকিস্তান ও ইরানে শরণার্থী হতে হয়েছিল। তাঁদের নিজ ভূমিতে ফিরে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে একাধিক প্রজন্ম চলে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়ে আফগানিস্তানে প্রক্সি যুদ্ধে জড়িত হতে গিয়ে পাকিস্তানের শাসকেরা নিজেদেরও বহুমুখী সর্বনাশ করেছেন। ঘরে-বাইরে যুদ্ধ করতে নেমে তাঁরা মানবসম্পদে বিনিয়োগ বাড়াতে পারেননি। বাড়তি হিসেবে পেলেন দেশের একাধিক প্রদেশে বিপুল প্রতিপক্ষ সশস্ত্র যোদ্ধা। নিজেদের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সেখানে একই কারণে অস্বাস্থ্যকর সামরিক আধিপত্যের পরম্পরা চলছে। গেরিলা সশস্ত্রতা বিনিয়োগকে কীভাবে ঝুঁকিতে ফেলে, তার বৈশ্বিক এক নজির এখন বেলুচিস্তানে চীনের অর্থনৈতিক করিডর।

অভ্যন্তরীণ ও বাইরের তালেবানদের সঙ্গে সীমান্ত অস্থিতিশীল হওয়ায় পুরো ডুরান্ড লাইন মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের স্বর্গভূমি হয়ে উঠতে শুরু করেছে আবার। দীর্ঘ মেয়াদে এটা পাকিস্তান, চীন ও মধ্য এশিয়ার জন্য বড় এক বিপদ তৈরি করতে যাচ্ছে।

বিপজ্জনক এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশও খুব বেশি দূরে নেই। ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে এই মর্মে বিশ্বাসযোগ্য খবর বেরিয়েছে, টিটিপির হয়ে বাংলাদেশিরাও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ছেন। ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কে সুবাতাস বাংলাদেশিদের কাবুল হয়ে পেশোয়ার যাওয়া সহজ করতে পারে।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ