গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ১২ সিদ্ধান্ত
Published: 10th, July 2025 GMT
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় বেশ কিছু সংস্কার-উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গণমাধ্যম সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ে ইতোমধ্যে কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সভায় সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হয়। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো.
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে সাংবাদিকতার অধিকার সুরক্ষা-সংক্রান্ত অধ্যাদেশ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে স্বল্প সময়ের মধ্যে এই অধ্যাদেশ জারি করা হবে। সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা নিরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কারের লক্ষ্যে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি পত্রিকার বিজ্ঞাপন হার যৌক্তিক পর্যায়ে বৃদ্ধি করা হবে।
কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, গণমাধ্যম সম্পর্কে শ্রোতা, দর্শক ও পাঠকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে বার্ষিক জরিপ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, বিজ্ঞাপনশিল্পে কোনো ধরনের যোগসাজশ এবং সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিপন্থি কৌশল চর্চা হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এফএম রেডিও লাইসেন্সের বিপরীতে জামানত ফি যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা হবে। এছাড়া, এফএম রেডিওতে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে রেডিও কর্তৃপক্ষকে নির্ধারিত হারে ফি প্রদান করতে হবে। বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের ২ শতাংশ সরকারি ফি হিসেবে যেটা কেটে নেওয়া হয়, তা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে, সরকারি ঘোষণা বিনামূল্যে প্রচার করতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শক্রমে গণমাধ্যমের কলাম লেখক, প্রদায়ক, শিল্পী ও অতিথি উপস্থাপক, আলোচকদের সম্মানির ওপর অগ্রিম কর রহিতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কমিশনের সুপারিশের আলোকে টেলিভিশন চ্যানেলের আপ-লিংক এবং ডাউন-লিংকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
এছাড়া, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) এবং জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের পাঠ্যধারা যুগোপযোগীকরণসহ প্রতিষ্ঠান দুটির সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তথ্য সার্ভিসের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য বিসিএস ইনফরমেশন একাডেমি প্রতিষ্ঠার বিষয়েও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।