অ্যাসাইলাম আবেদনকারীদের অস্ট্রেলিয়ায় পাসপোর্ট দিচ্ছে না বাংলাদেশ মিশন, ভোগান্তি
Published: 27th, July 2025 GMT
ভ্রমণ, শিক্ষার্থী বা বিভিন্ন ভিসায় অস্ট্রেলিয়ায় এসে অ্যাসাইলাম বা রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করা বাংলাদেশিদের ই-পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ করছে না সেখানকার বাংলাদেশ মিশন। এতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার মতো সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব বাংলাদেশি। প্রবাসজীবন নিয়ে পড়েছেন অনিশ্চয়তায়। বাংলাদেশ মিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, এ ধরনের আবেদন গ্রহণের বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
সিডনির লাকেম্বায় এক ক্যাফেতে কথা হয় অস্ট্রেলিয়ায় সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করা এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমার স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষ। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তাই এখানে অ্যাসাইলামের জন্য আবেদন করতে বাধ্য হয়েছি। এর মধ্যেই আমার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। নতুন পাসপোর্টের জন্য সিডনি কনস্যুলেটে যোগাযোগ করলে তারা আমার আবেদন গ্রহণই করল না।’
এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার পড়াশোনা আছে, যোগ্যতা আছে; কিন্তু একটা ভালো চাকরির জন্য যে প্রফেশনাল কোর্সটাতে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম, পাসপোর্ট ছাড়া তারা আমাকে ভর্তিই করছে না। আমি অস্ট্রেলিয়া সরকারের কাছে একজন অবৈধ ব্যক্তি নই, আবার নিজ দেশের সরকারের কাছেও যেন আমার কোনো পরিচয় নেই। এ কেমন জীবন?’
এই শিক্ষার্থীর মতো শত শত বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ায় এ সমস্যার শিকার। সিডনির বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল এবং ক্যানবেরার বাংলাদেশ হাইকমিশন—উভয় মিশনই অ্যাসাইলাম আবেদনকারীদের ই-পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ না করার বিষয়ে একই নীতি অনুসরণ করে আসছে।
স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা
নতুন পাসপোর্ট না পাওয়া বাংলাদেশিরা অস্ট্রেলিয়ায় স্বাস্থ্যসেবা ও উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের মতো নানা জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়া সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসা পাওয়ার জন্য বৈধ পরিচয়পত্র অপরিহার্য। পাসপোর্ট নবায়ন করতে না পারায় অনেকে এই মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সিডনিতে বসবাসরত একটি বাংলাদেশি পরিবার জানায়, তাদের সন্তানের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে বারবার পাসপোর্টের কপি দিতে হয়েছে। কিন্তু মেয়াদোত্তীর্ণ পাসপোর্ট হওয়ায় প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় চাকরির বাজারে টিকে থাকতে হলে শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে নিজেকে ক্রমাগত উন্নত করার বিকল্প নেই। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকায় বাংলাদেশিরা কোনো কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারছেন না। ফলে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভালো চাকরি পাচ্ছেন না তাঁরা।
এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন বিভাগের সঙ্গে যেকোনো রকম যোগাযোগের জন্য একটি বৈধ পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়। পাসপোর্ট না থাকায় অনেক প্রবাসী নিজেদের ভিসা পরিবর্তন বা অন্য কোনো আবেদনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
পাসপোর্ট নবায়ন না করার বিষয়টি মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন আইনজীবী মোহাম্মদ নিজামউদ্দীন। তিনি বলেন, ‘একজন ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কোন ভিসার জন্য আবেদন করেছেন, তার ওপর ভিত্তি করে নিজ দেশের পাসপোর্ট না দেওয়াটা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।’
এই অভিবাসন আইনজীবী বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন আইন অনুযায়ী, অ্যাসাইলাম ভিসার আবেদন অন্য যেকোনো ভিসার আবেদনের মতোই একটি বৈধ প্রক্রিয়া। যে কেউ এই আবেদন করতে পারে। আবেদনটি যৌক্তিক কি না, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষের। যদি কারও অ্যাসাইলাম আবেদন বাতিলও হয়ে যায়, তারপরও তার সামনে আরও অনেক বৈধ ভিসার পথ খোলা থাকতে পারে। কিন্তু পাসপোর্ট না দিলে সেসব পথই বন্ধ হয়ে যায়।’
মোহাম্মদ নিজামউদ্দীন বলেন, ‘সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অনেক সময় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার অজুহাত দেখায়। কিন্তু তারা এটা চিন্তা করে না যে যখন একটি দেশ তার নিজের নাগরিককে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করে, তখন সেই দেশই আন্তর্জাতিক মহলে প্রমাণ করে দেয়, তার নাগরিকেরা কতটা নিপীড়নের শিকার। এটি দেশের ভাবমূর্তির জন্য আরও অনেক বেশি ক্ষতিকর।’
ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বদরুল আলম খান বিষয়টিকে ‘অন্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘একজন মানুষ যখন বিদেশে থাকেন, তখন পাসপোর্টই তাঁর একমাত্র পরিচয়, শিকড়ের চিহ্ন। সেই চিহ্নটুকু কেড়ে নেওয়ার অধিকার কোনো রাষ্ট্রেরই থাকা উচিত নয়। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক জটিলতা নয়, এটি একটি মানবিক বিপর্যয়।’
এ বিষয়ে সিডনির কনসাল জেনারেল মো.
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের আবেদন গ্রহণের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা নেই। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে একটি দিকনির্দেশনা পাওয়ার চেষ্টা করছি। সরকারি নতুন কোনো নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত আমরা আগের নিয়মই অনুসরণ করছি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য কর র ব সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ