Prothomalo:
2025-08-04@08:53:13 GMT

খাসিয়ারা একা নয়, অসহায় নয়

Published: 4th, August 2025 GMT

জায়গাটির নাম প্রতাপপুর লামা খাসিয়াপুঞ্জি। এপারে জাফলং, ওপারে ভারতের মেঘালয়। আর মনজুড়ানো সেই পিয়াইন নদ, যা এককালে পাথরে ভরা ছিল। নদী ভাগ করেছে দুই দেশের মানুষকে। কত বড় বড় পাহাড় সেখানে। এই বর্ষায় পাহাড়ি ঝরনায় জল ঝরে। আরও দূরে বিস্তীর্ণ পাহাড়। মেঘ জমে আছে ওখানে।

আমি দুবার গিয়েছি এই গ্রামে। অতি মনোমুগ্ধকর একটি গ্রাম। স্কুলের শিশুরা গান গেয়ে ফুল দিয়েছিল আমাদের। শান্ত, স্নিগ্ধ, উন্নত, পরিচ্ছন্ন ও সভ্য মানুষের একটি গ্রাম। এখানে প্রকৃতি তার সব রূপ উজাড় করে দিয়েছে। এই গ্রামের পানজুমে হামলা হয়েছে গত ২৯ জুলাই রাতে।

দুর্বৃত্তরা দুই হাজার পানগাছ কেটে বীরদর্পে চলে গেছে। আর খাসিয়া হেডম্যান পরিবারসহ পথে বসে গেছে নিমেষে। বললাম, আবার কান্না থামিয়ে, বুকে শক্ত পাথর বেঁধে উঠে দাঁড়াতে হবে, এখানেই এই দেশে থাকতে হবে সুখ-দুঃখে, আনন্দে, উৎসবে, আক্রমণে–অপমানে, চূড়ান্ত ক্ষতির সময়েও। কারণ, আরেকবার আশায় বুক বাঁধব আমরা, স্বীকৃত ও সম্মানীয় নাগরিক হিসেবে জীবনের স্বপ্ন দেখব। আবার আশাহত হলে ফিরে যাব আগের জায়গায় নতুন সংগ্রামের পথে, নিজ গ্রামে নদীর কাছে, পাহাড়ের ভেতরে, প্রকৃতির কোলে।

দুই.

খাসিয়া মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির সামনে বৃষ্টির মধ্যে বক্তৃতা করছিল গত ৩১ জুলাই, ‘যে দুই হাজার পানগাছ কেটে ফেললেন রাতের আঁধারে চোরের মতো, সে তো শুধু গাছ নয়, আমাদের সন্তান। ২০ বছরের বেশি বয়সের পানগাছ নির্বিচারে ধ্বংস করে দিলেন, খাসিয়াদের জীবিকা ধ্বংস করে দিলেন।’ এই দুষ্কৃতকারীদের বিচার চাই।

এখন প্রশ্ন হলো, কার কাছে বিচার চেয়ে পাবে খাসিয়ারা? সরকারের কাছে? উপদেষ্টারা অনেকে খাসিয়াদের অবস্থা সম্পর্কে জানেন। প্রশাসন, পুলিশ, বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতা, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, ব্যবসায়ী—সবাই তো জানেন, খাসিয়াদের জীবিকা ও ভূমির মালিকানা নিয়ে সমস্যা, ওদের জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ তেমন নেই, ওদের গ্রাম পর্যন্ত ভালো রাস্তা রেই, স্বাস্থ্যসেবার কোনো সুবিধা নেই, অর্থনৈতিক–সামাজিক সহায়তা নেই।

পানজুম হারিয়ে বাবার কান্না দেখে মেয়ে রিমায়া খংলা ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছে, ২৯ জুলাই মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা আমাদের একমাত্র জীবিকার সম্বল পানবাগানের দুই হাজার গাছ কেটে ফেলেছে। একটি পানগাছ বড় হতে, ফলন দিতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগে। এখন এই পাঁচ বছর আমরা কীভাবে চলব। মেয়ে লিখেছে, তাদের বাবা কত কষ্ট করে সারা দিন পরিবারের জন্য, সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য। দেখলাম, সিলেট প্রশাসন অবশ্য সাড়া দিয়েছে এবং প্রশাসনের লোকজন ঘটনাস্থলে গেছেন। পুলিশ ইচ্ছা করলে দুর্বৃত্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে পারে। ওই রাতে ওই পানজুম এলাকায় মুঠোফোন ট্র্যাক করলে বা রেকর্ড দেখলে অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব। এ কাজ যেন প্রশাসন ও পুলিশ অবশ্যই করে।

আশায় বুক বেঁধেছিলাম, চব্বিশের জুলাইয়ের পর সরকারিভাবে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ আর বলা হবে না। এ যাত্রায় বৈষম্য দূর হবে, হাহাকার–নিপীড়ন থাকবে না, রাষ্ট্রের নির্মম উদাসীন্য ও হিংস্রতা মানুষকে ঘাবড়ে দেবে না, বরং রাষ্ট্র হবে স্নেহশীল।তিন.

একটা মেসেজ দিতে হবে সমাজকে, রাষ্ট্র ও সরকার এই খাসিয়াদের পাশে আছে। তারা অসহায় নয়, একা নয়। খাসিয়ারা রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার দাবি করেছে। দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি চেয়েছে আর তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়েছে, যাতে এই কঠিন সময়ে তারা টিকে থাকতে পারে।

এ রকম ঘটনা খাসিয়া ও গারোদের পানজুমে এর আগেও ঘটেছে, বিশেষ করে কুলাউড়া এলাকায়। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। কোনো বিচারের খবর নেই। জুম খেতে কখনো ওদের পাহারা বসাতে হয়। একটি দেশ কতখানি উন্নত, গণতান্ত্রিক, সভ্য ও মানবিক, তার বিবেচ্য বিষয় হলো সেই দেশে ও সমাজে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের অবস্থা কেমন, তার ওপর। সংখ্যালঘু হয়ে না জন্মালে এই বেদনা অনুভব করা সহজ নয়। এ কারণে জাতিসংঘ ১৯৯২ সালে মাইনরিটি ডিক্লারেশন দিয়েছিল।

জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ঘোষণাপত্রের প্রথম ধারা বলছে, এই সংখ্যালঘুদের পরিচয় ও অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর এই দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্র আইন, নীতিপ্রণয়নসহ যেকোনো বিধান প্রণয়ন করবে। অর্থাৎ সব সংখ্যালঘু মানুষ তাদের আশ্রয়ের জন্য, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য দ্বারস্থ হবে রাষ্ট্রের কাছে। আর সেটি পালন করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।

চার.

বহুদিনের স্বৈরশাসনের পর আমরা একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছিলাম। আশায় বুক বেঁধেছিলাম, জুলাইয়ের পর ‘অফিশিয়ালি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ আর বলা হবে না। এযাত্রায় বৈষম্য দূর হবে, হাহাকার–নিপীড়ন থাকবে না, রাষ্ট্রের নির্মম উদাসীন্য ও হিংস্রতা মানুষকে ঘাবড়ে দেবে না, বরং রাষ্ট্র হবে স্নেহশীল। রাষ্ট্র নিষ্ঠুর নয় দয়ার্দ্র হবে, উদ্ধত অহংকারী নয়, নম্র ও বিনীত হবে।

ন্যাশনাল পার্ক, বন বিভাগ, চা–বাগান, পর্যটন ইত্যাদির নামে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের ভূমি দখল হবে না। বাড়িঘর, জীবন–জীবিকার ওপর আর হামলা হবে না। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারী ও বালিকারা নিরাপদে চলাচল করতে পারবে, সম্মানীয় হবে। বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকশিত হবে। পাহাড়ে মানুষে–মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও সম্প্রীতি জোরদার হবে।

সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে, গরিব মানুষের ওপর নতুন করে জুলুম হবে না। এমনকি সংখ্যায় কম হওয়ার কারণে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাবে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হওয়া পর্যন্ত। এমনই কত আশা করেছিলাম। কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল। আমরা যেন এই আশা ও স্বপ্নের অধিকার না হারাই।

এমনকি সংখ্যায় কম হওয়ার কারণে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হওয়া পর্যন্ত। এমনই কত আশা করেছিলাম। কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল। আমরা যেন এই আশা ও স্বপ্নের অধিকার না হারাই।

শেষে ফিরে যাই খাসিয়া মেয়েটির কাছে। তার ক্রন্দনরত বাবার কাছে। পানজুমের ভেতরে ছিন্নভিন্ন গাছের স্তূপে দাঁড়িয়ে তিনি চোখের জল মুছলেন গামছায়। তাঁর নাম রিসং কংওয়াং। সামনে অনিশ্চিত এক সময়। তবু আমাদের পথ চলতে হয়, এগিয়ে যেতে হয়।

আজ আমি আমার কঠিন অসুখের পর এই প্রথম কলাম লিখলাম। এভাবে বেঁচে থাকতে হয়। এত কিছুর পরও আশাবাদী থাকি, একটা বড় পরিবর্তন আসবে আজ না হোক কাল, আগামীকাল না হোক পাঁচ, দশ, পনেরো, কুড়ি, পঁচিশ বছর পর।

তখন হয়তো আমরা আমাদের গভীর বেদনায় সমব্যথী এক রাষ্ট্র ও সমাজ পাব। সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি সত্যিকারের সহানুভূতিশীল আচরণ করবে। একটা রিকনসিলিয়েশন হবে। তখনো এই পিয়াইন নদ বয়ে চলবে। এই পাথর, পাহাড়, ব্রিজ, ঝরনা, কতশত গাছপালা, সবুজ অরণ্য, কত নৌকা ও মানুষ থাকবে।

ওই যে খাসিয়া শিশুরা গান গেয়েছিল নিজের ভাষায়, আজও মনে আছে সেই মুখগুলো। এই গানের ভাষা অন্ধকারের নয়, নতুন এক ভোরের আলোর।

সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য দ র হব আম দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

খাসিয়ারা একা নয়, অসহায় নয়

জায়গাটির নাম প্রতাপপুর লামা খাসিয়াপুঞ্জি। এপারে জাফলং, ওপারে ভারতের মেঘালয়। আর মনজুড়ানো সেই পিয়াইন নদ, যা এককালে পাথরে ভরা ছিল। নদী ভাগ করেছে দুই দেশের মানুষকে। কত বড় বড় পাহাড় সেখানে। এই বর্ষায় পাহাড়ি ঝরনায় জল ঝরে। আরও দূরে বিস্তীর্ণ পাহাড়। মেঘ জমে আছে ওখানে।

আমি দুবার গিয়েছি এই গ্রামে। অতি মনোমুগ্ধকর একটি গ্রাম। স্কুলের শিশুরা গান গেয়ে ফুল দিয়েছিল আমাদের। শান্ত, স্নিগ্ধ, উন্নত, পরিচ্ছন্ন ও সভ্য মানুষের একটি গ্রাম। এখানে প্রকৃতি তার সব রূপ উজাড় করে দিয়েছে। এই গ্রামের পানজুমে হামলা হয়েছে গত ২৯ জুলাই রাতে।

দুর্বৃত্তরা দুই হাজার পানগাছ কেটে বীরদর্পে চলে গেছে। আর খাসিয়া হেডম্যান পরিবারসহ পথে বসে গেছে নিমেষে। বললাম, আবার কান্না থামিয়ে, বুকে শক্ত পাথর বেঁধে উঠে দাঁড়াতে হবে, এখানেই এই দেশে থাকতে হবে সুখ-দুঃখে, আনন্দে, উৎসবে, আক্রমণে–অপমানে, চূড়ান্ত ক্ষতির সময়েও। কারণ, আরেকবার আশায় বুক বাঁধব আমরা, স্বীকৃত ও সম্মানীয় নাগরিক হিসেবে জীবনের স্বপ্ন দেখব। আবার আশাহত হলে ফিরে যাব আগের জায়গায় নতুন সংগ্রামের পথে, নিজ গ্রামে নদীর কাছে, পাহাড়ের ভেতরে, প্রকৃতির কোলে।

দুই.

খাসিয়া মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির সামনে বৃষ্টির মধ্যে বক্তৃতা করছিল গত ৩১ জুলাই, ‘যে দুই হাজার পানগাছ কেটে ফেললেন রাতের আঁধারে চোরের মতো, সে তো শুধু গাছ নয়, আমাদের সন্তান। ২০ বছরের বেশি বয়সের পানগাছ নির্বিচারে ধ্বংস করে দিলেন, খাসিয়াদের জীবিকা ধ্বংস করে দিলেন।’ এই দুষ্কৃতকারীদের বিচার চাই।

এখন প্রশ্ন হলো, কার কাছে বিচার চেয়ে পাবে খাসিয়ারা? সরকারের কাছে? উপদেষ্টারা অনেকে খাসিয়াদের অবস্থা সম্পর্কে জানেন। প্রশাসন, পুলিশ, বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতা, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, ব্যবসায়ী—সবাই তো জানেন, খাসিয়াদের জীবিকা ও ভূমির মালিকানা নিয়ে সমস্যা, ওদের জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ তেমন নেই, ওদের গ্রাম পর্যন্ত ভালো রাস্তা রেই, স্বাস্থ্যসেবার কোনো সুবিধা নেই, অর্থনৈতিক–সামাজিক সহায়তা নেই।

পানজুম হারিয়ে বাবার কান্না দেখে মেয়ে রিমায়া খংলা ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছে, ২৯ জুলাই মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা আমাদের একমাত্র জীবিকার সম্বল পানবাগানের দুই হাজার গাছ কেটে ফেলেছে। একটি পানগাছ বড় হতে, ফলন দিতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগে। এখন এই পাঁচ বছর আমরা কীভাবে চলব। মেয়ে লিখেছে, তাদের বাবা কত কষ্ট করে সারা দিন পরিবারের জন্য, সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য। দেখলাম, সিলেট প্রশাসন অবশ্য সাড়া দিয়েছে এবং প্রশাসনের লোকজন ঘটনাস্থলে গেছেন। পুলিশ ইচ্ছা করলে দুর্বৃত্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে পারে। ওই রাতে ওই পানজুম এলাকায় মুঠোফোন ট্র্যাক করলে বা রেকর্ড দেখলে অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব। এ কাজ যেন প্রশাসন ও পুলিশ অবশ্যই করে।

আশায় বুক বেঁধেছিলাম, চব্বিশের জুলাইয়ের পর সরকারিভাবে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ আর বলা হবে না। এ যাত্রায় বৈষম্য দূর হবে, হাহাকার–নিপীড়ন থাকবে না, রাষ্ট্রের নির্মম উদাসীন্য ও হিংস্রতা মানুষকে ঘাবড়ে দেবে না, বরং রাষ্ট্র হবে স্নেহশীল।তিন.

একটা মেসেজ দিতে হবে সমাজকে, রাষ্ট্র ও সরকার এই খাসিয়াদের পাশে আছে। তারা অসহায় নয়, একা নয়। খাসিয়ারা রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার দাবি করেছে। দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি চেয়েছে আর তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়েছে, যাতে এই কঠিন সময়ে তারা টিকে থাকতে পারে।

এ রকম ঘটনা খাসিয়া ও গারোদের পানজুমে এর আগেও ঘটেছে, বিশেষ করে কুলাউড়া এলাকায়। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। কোনো বিচারের খবর নেই। জুম খেতে কখনো ওদের পাহারা বসাতে হয়। একটি দেশ কতখানি উন্নত, গণতান্ত্রিক, সভ্য ও মানবিক, তার বিবেচ্য বিষয় হলো সেই দেশে ও সমাজে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের অবস্থা কেমন, তার ওপর। সংখ্যালঘু হয়ে না জন্মালে এই বেদনা অনুভব করা সহজ নয়। এ কারণে জাতিসংঘ ১৯৯২ সালে মাইনরিটি ডিক্লারেশন দিয়েছিল।

জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ঘোষণাপত্রের প্রথম ধারা বলছে, এই সংখ্যালঘুদের পরিচয় ও অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর এই দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্র আইন, নীতিপ্রণয়নসহ যেকোনো বিধান প্রণয়ন করবে। অর্থাৎ সব সংখ্যালঘু মানুষ তাদের আশ্রয়ের জন্য, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য দ্বারস্থ হবে রাষ্ট্রের কাছে। আর সেটি পালন করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।

চার.

বহুদিনের স্বৈরশাসনের পর আমরা একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছিলাম। আশায় বুক বেঁধেছিলাম, জুলাইয়ের পর ‘অফিশিয়ালি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ আর বলা হবে না। এযাত্রায় বৈষম্য দূর হবে, হাহাকার–নিপীড়ন থাকবে না, রাষ্ট্রের নির্মম উদাসীন্য ও হিংস্রতা মানুষকে ঘাবড়ে দেবে না, বরং রাষ্ট্র হবে স্নেহশীল। রাষ্ট্র নিষ্ঠুর নয় দয়ার্দ্র হবে, উদ্ধত অহংকারী নয়, নম্র ও বিনীত হবে।

ন্যাশনাল পার্ক, বন বিভাগ, চা–বাগান, পর্যটন ইত্যাদির নামে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের ভূমি দখল হবে না। বাড়িঘর, জীবন–জীবিকার ওপর আর হামলা হবে না। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারী ও বালিকারা নিরাপদে চলাচল করতে পারবে, সম্মানীয় হবে। বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকশিত হবে। পাহাড়ে মানুষে–মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও সম্প্রীতি জোরদার হবে।

সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে, গরিব মানুষের ওপর নতুন করে জুলুম হবে না। এমনকি সংখ্যায় কম হওয়ার কারণে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাবে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হওয়া পর্যন্ত। এমনই কত আশা করেছিলাম। কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল। আমরা যেন এই আশা ও স্বপ্নের অধিকার না হারাই।

এমনকি সংখ্যায় কম হওয়ার কারণে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না হওয়া পর্যন্ত। এমনই কত আশা করেছিলাম। কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল। আমরা যেন এই আশা ও স্বপ্নের অধিকার না হারাই।

শেষে ফিরে যাই খাসিয়া মেয়েটির কাছে। তার ক্রন্দনরত বাবার কাছে। পানজুমের ভেতরে ছিন্নভিন্ন গাছের স্তূপে দাঁড়িয়ে তিনি চোখের জল মুছলেন গামছায়। তাঁর নাম রিসং কংওয়াং। সামনে অনিশ্চিত এক সময়। তবু আমাদের পথ চলতে হয়, এগিয়ে যেতে হয়।

আজ আমি আমার কঠিন অসুখের পর এই প্রথম কলাম লিখলাম। এভাবে বেঁচে থাকতে হয়। এত কিছুর পরও আশাবাদী থাকি, একটা বড় পরিবর্তন আসবে আজ না হোক কাল, আগামীকাল না হোক পাঁচ, দশ, পনেরো, কুড়ি, পঁচিশ বছর পর।

তখন হয়তো আমরা আমাদের গভীর বেদনায় সমব্যথী এক রাষ্ট্র ও সমাজ পাব। সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি সত্যিকারের সহানুভূতিশীল আচরণ করবে। একটা রিকনসিলিয়েশন হবে। তখনো এই পিয়াইন নদ বয়ে চলবে। এই পাথর, পাহাড়, ব্রিজ, ঝরনা, কতশত গাছপালা, সবুজ অরণ্য, কত নৌকা ও মানুষ থাকবে।

ওই যে খাসিয়া শিশুরা গান গেয়েছিল নিজের ভাষায়, আজও মনে আছে সেই মুখগুলো। এই গানের ভাষা অন্ধকারের নয়, নতুন এক ভোরের আলোর।

সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

সম্পর্কিত নিবন্ধ