জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার পূর্ণ ভাষণ
Published: 5th, August 2025 GMT
৫ আগস্ট ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে’ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাত ৮টা ২০ মিনিটে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ শুরু হয়। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ড. ইউনূসের ভাষণের পুরো বক্তব্য প্রধান উপদেষ্টার প্রেস ইউংসের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে পাঠানো হয়েছে।
রাইজিংবিডি ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ ৫ আগস্ট, জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন। এক বছর আগে এ দিনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পূর্ণতা পায়, দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ।
গত বছরের জুনে আদালতের একটি রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল হলে দেশের তরুণ শিক্ষার্থী সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের এই ক্ষোভ দাবানলে পরিণত হয় স্বৈরাচারের তুচ্ছতাচ্ছিল্যে, দমন-পীড়নে, নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, নির্মম হত্যাযজ্ঞের কারণে।
স্বৈরাচারী শাসকের নির্দেশে পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের সামনে নির্ভিকচিত্তে দাঁড়িয়েছিল এদেশের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। তাদের সম্মুখভাগে ছিলেন আমাদের অদম্য নারীরা। দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করতে অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছেন তারা।
ড.
গত এক বছরে আমরা অনেক সংকট ও সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে পার করেছি। অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা আমাদের গভীরভাবে বেদনাহত করেছে। সর্বশেষ মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ঝরে গেছে আমাদের কোমলমতি শিশু-সহ বেশকিছু মানুষের প্রাণ। আগুনে পুড়ে আহত হয়েছেন অনেকেই। এ ঘটনা আমাদের সবাইকে শোকস্তব্ধ করে দিয়েছে। এই দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। যারা এখনো হাসপাতালের চিকিৎসাধীন তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর সিঙ্গাপুর, চীন, ভারতসহ কয়েকটি দেশের যেসকল চিকিৎসক এবং নার্স আহতদের সেবায় অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। যারা রক্ত দিয়ে আহতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি তাঁদের প্রতিও।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা অনেক দূর পথ অতিক্রম করে এসেছি। আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, অর্থনীতিতে গতিশীলতা এসেছে, সংকট দূর হয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা সফলতার সঙ্গে শুল্ক আলোচনা সমাপ্ত করেছি। এর ফলে আমাদের অর্থনীতির সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে।
যখন এক বছর আগে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৬ বছরব্যাপী একটানা ধ্বংসযজ্ঞ এবং লুটপাটে বিধ্বস্ত এক অর্থনীতির দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন কারোরই মনে হচ্ছিল না এই বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে আবার সহজে চালু করা যাবে। মাত্র এক বছরের মধ্যে আমরা এতদূর রাস্তা অতিক্রম করতে পারবো যা চিন্তাই করা যায়নি। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার পালা। আমরা এখন অন্তর্বর্তী সরকার থেকে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
আমরা দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে দেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করব। তবে নির্বাচনের আগে আমাদের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে।এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ।
আজ, জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে, সকল রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে আমরা জাতির কাছে জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেছি। এই ঘোষণাপত্রে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের মানুষের অতীতের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয়েছে।
আমাদের তিনটি দায়িত্ব ছিল-সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা দেয়ালে দেয়ালে যে প্রত্যাশার কথা লিখে রেখেছিল তার অন্যতম ফোকাস ছিল রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার। সে লক্ষ্যে আমরা বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলাম। তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান সংস্কার কমিশনগুলো যে সুপারিশ পেশ করেছে সেগুলোর মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বহু সংস্কার আমরা ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছি।
এই সংস্কারগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাত, বিচার ব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস পাবে।
দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকাজ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করেছিলাম। এই কমিশনে ৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক দল ও জোট স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মতামত দিয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রায় দুই মাস ধরে দলগত ও জোটগতভাবে আলোচনা করেছিল। এই প্রক্রিয়ায় যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো বাদ দিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের বিষয় চিহ্নিত করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৩ দিন ধরে আলোচনা শেষে ১৯টি বিষয়ের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, যদিও কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।
সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি। ঐকমত্য কমিশনের পরিচালনায় দেশের সকল রাজনৈতিক দল মিলে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিনিয়ত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে এসেছে।
জুলাই সনদ একটি ঐতিহাসিক অর্জন। এটা শুধু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নয়, বৃহত্তর পরিমণ্ডলের রাজনৈতিক ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দলিলতো স্মরণীয় হয়ে থাকবেই, এটা রচনার প্রক্রিয়াও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দলিল প্রণয়নের জন্য আমি সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে এবং ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দকে বিশেষ করে এই উদ্যোগের নেতৃত্বদানকারী প্রফেসর আলী রীয়াজকে জাতির পক্ষ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এই আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা ছিল। আমরা আশা করছি এই ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে অচিরেই রাজনৈতিক দলগুলি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে এবং এর বাস্তবায়নেও ঐকমত্যে পৌঁছাবে।
জুলাই সনদ বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা, নাগরিক অধিকারের সত্যিকারের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সামর্থ্যের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে।
আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে ভবিষ্যতের কোনো সরকারই যেন আর ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে। রাষ্ট্রকে এমনভাবে মেরামত করতে হবে যাতে কখনো কোথাও ফ্যাসিবাদের লক্ষণ পাওয়া গেলেই সেটিকে যেন তাৎক্ষণিকভাবে সেখানেই নির্মূল করা যায়। আর যেন ১৬ বছরের জন্য অপেক্ষা করতে না হয়। বহু মানুষকে প্রাণ দিতে না হয়। আমাদের যেন আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের প্রয়োজন না হয়।
জুলাই আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিচারকাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে। বিচারের আনুষ্ঠানিক শুনানি পর্বও শুরু হয়েছে। ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে যারা জড়িত তাদের বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই।
বিচার প্রক্রিয়া ও এর ফলাফল ক্রমান্বয়ে মানুষের কাছে প্রকাশিত হতে থাকবে। বিচারের পুরো প্রক্রিয়া দেশবাসীর কাছে স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান রাখা হচ্ছে।
এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা। নির্বাচন অনুষ্ঠান। আজ এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাব, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
আপনারা সকলেই দোয়া করবেন যেন সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এ দেশের সকল নাগরিক একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার কাজে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এই নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখরভাবে সম্পন্ন করা যায় সেজন্য সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করবো।
এবারের নির্বাচন যেন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তি-শৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে সেজন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করতে আগামীকাল থেকে আমরা সকলেই মানসিক প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরু করব।
নির্বাচনে ভোটারদের সম্পর্কে দু-একটা কথা বলতে চাই। এবার আমরা প্রবাসী ভোটারদের ভোট দেওয়ার আয়োজন নিশ্চিত করতে চাই।
অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যে আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে তার বড় কারণ হলো আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদান। নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নারী ভোটাররা যেন দেশের সর্বত্র নির্দ্বিধায় আনন্দ-উৎসাহ সহকারে তাদের ভোট দিতে পারে এটা নিশ্চিত করতে চাই। এবার যেন কেন্দ্রে কেন্দ্রে নারী ভোটারদের ঢল নামে আমরা সেই লক্ষ্যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার কারণে গত ১৫ বছর ধরে নাগরিকবৃন্দ ভোট দিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে আমরা আমাদের বকেয়া আনন্দসহ মহা আনন্দে ভোট দিতে চাই। এবারের নির্বাচনে জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে যাবে এরকম ভোটাররা নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে, তাদের এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য। এর মধ্যে নতুন নারী ভোটার থাকবে, নতুন পুরুষ ভোটার থাকবে। এর মধ্যে এমন ভোটার থাকবে যারা ১৫ বছর আগে থেকেই ভোট দিতে পারতো কিন্তু জীবনে একবারও ভোট দিতে পারেনি। এর মধ্যে আসবে যারা ১০ বছর আগে, ৫ বছর আগে ভোট দিতে পারত কিন্তু পারেনি। আর আসবে ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতীর দল যারা এই প্রথমবার ভোটার হওয়ার যোগ্যতা লাভ করলো এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোট দেওয়ার সুযোগও পেয়ে গেল। নির্বাচনের দিনকে আমরা ঈদের উৎসবের মতো করতে চাই। এবারের ভোটের আনন্দ থাকবে সবার মধ্যে। আপনারা সবাই বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন।
নাগরিক অধিকার প্রয়োগের মহাআনন্দ পরবর্তী বংশধরদের কাছে তুলে ধরার জন্য।
এখন থেকে প্রতিদিন আলাপ করুন, আপনার এলাকায় ভোটদান ব্যবস্থা কেমন হলে সুন্দর হয়, কেমন হলে আনন্দমুখর হয়, সেটা আগে থেকে ঠিক করার জন্য। নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজের ভিত্তি রচনা হবে এবারের নির্বাচনে। তার জন্য প্রস্তুতি নিন।
দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যতগুলো বড় সংঘাত, সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলোর নেপথ্যে কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো দল যদি গায়ের জোরে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে তার চূড়ান্ত পরিণতি কী তা জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে।
আমরা ইতিহাসের কলঙ্কিত কোনো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি আর করতে চাই না।
আপনারা প্রত্যেকেই অবগত আছেন, একটা গোষ্ঠী নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তারা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে দেশের বাহিরে বসে এবং ভেতরে থেকে নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
আমাদেরকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন নির্বাচনকে সংঘাতময় করে তোলার কোনো রকমের সুযোগ না পায়। মাথায় রাখবেন, পরাজিত শক্তি নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। কিন্তু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সফলভাবে আয়োজন করা গেলে অপশক্তির পরাজয় চূড়ান্ত হবে।
নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিনিয়ত পরামর্শ নেওয়ার জন্য আমরা প্রযুক্তির সাহায্য নেব। এজন্য একটি অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছি। দ্রুত এই অ্যাপটি চালু হবে। আপনারা আপনাদের সকল পরামর্শ, সকল মতামত, সকল আশঙ্কা এবং উদ্যোগের কথা এই অ্যাপের মাধ্যমে আমাদেরকে জানাবেন।
আমরা তা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবো, সমস্যার সমাধানের জন্য ব্যবস্থা নেব।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমার আহ্বান থাকবে আপনাদের নির্বাচনী ইশতেহারে, আপনাদের প্রতিশ্রুতি-প্রতিজ্ঞা-পরিকল্পনায় কোনো কিছুতেই যেন তরুণরা বাদ না পড়ে। নারীরা বাদ না পড়ে। মনে রাখবেন, যে তরুণ-তরুণীরা বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে তারা বিশ্বকেও বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
আপনার দল থেকে তাদেরকে সে সুযোগ দেবার উদ্যোগ নিন।
আগামী নির্বাচনে সবাই নিরাপদে যার যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবে এটা নিয়ে কারো কোনো আপত্তির সুযোগ রাখা যাবে না। আমরা সবাই সবার পছন্দের প্রতি সম্মান দেখাব—এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
আপনারা জানেন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা ফসল উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে।এর ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা হয়েছিল। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ, নজরদারি ও মধ্যস্বত্ব ভোগিদের দৌরাত্ম্য কমানোর ফলে এটি এড়ানো গেছে। বিশেষ করে, এ বছরের পবিত্র মাহে রমজান মাস থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।
মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল আমাদের জন্য সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। ভঙ্গুর অর্থনীতি ও বন্যার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল প্রায় ১৪ পার্সেন্ট। এখন সেটা অর্ধেকে নেমে এসেছে।আমরা আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যে এটি ৬ শতাংশে নেমে আসবে।
এই জুন মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়েছে, যা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ নিয়ে চার মাস ধরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমেছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি প্রবাসীদের অসীম আস্থার ফলে মুদ্রা বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। গত অর্থবছর ব্যাংকিং চ্যানেলে রেকর্ড তিন হাজার ৩৩ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। রপ্তানি আয় প্রায় ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এর ফলে টাকা শক্তিশালী হয়েছে। অনেক বছর পর ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাড়ছে। গত ১১ মাসে বৈদেশিক পাওনাদারদের পাওনা সুদ ও আসল বাবদ ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪০০ কোটি ডলার অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। আগের বকেয়া দায় পরিশোধের পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। আগামীতে এ ধারা বজায় থাকবে বলে আমরা আশা করি।
বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার ফলে এই বছরের প্রথম তিন মাসে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এটা দ্বিগুণের বেশি। আর অক্টোবর থেকে হিসাব করলে ছয় মাসে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট এসেছে সাড়ে ষোলো হাজার কোটি টাকা, যা গত সরকারের আমলের শেষ ছয় মাসের তুলনায় দ্বিগুণ।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় লক্ষ্য। সম্প্রতি হংকংভিত্তিক শিল্প গোষ্ঠী হানডা বাংলাদেশের বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে আড়াইশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছে, যা এখাতে চীনা কোনো কোম্পানির একক সর্বোচ্চ বিনিয়োগ। তাদের এই বিনিয়োগের ফলে ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি হানডার এই বিনিয়োগ আরো চীনা কোম্পানিকে এদেশে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করবে। এর মাধ্যমে আমাদের তরুণ তরুণীদের কর্মসংস্থানের পথ খুলবে।
গত ১৬ বছরে দেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে গিয়েছে, আমরা সেটা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছি। এই দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার জন্য সরকার নামকরা বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে। যথাযথ আইনি পদক্ষেপের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদী-দুর্বৃত্তরা যে অর্থসম্পদের পাহাড় গড়েছে তার কিছু কিছু ইতোমধ্যে জব্দ হয়েছে। এ কার্যক্রম সঠিকভাবে চালিয়ে যেতে পারলে অল্প সময়ের মধ্যে আরো কিছু ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে মজবুত করতে হলে আমাদের চিন্তায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। আমি বরাবরই বলে এসেছি, এদেশের নদী ও বিশাল সমুদ্র আমাদের মূল্যবান সম্পদ। আমরা এ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে সমান্তরালভাবে ‘পানিভিত্তিক অর্থনীতি’ গড়ে তুলতে চাই।
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, বঙ্গোপসাগরের একটা অংশও আমাদের দেশ। এর পরিমাণ আমাদের মোট জমির পরিমাণের চাইতে বেশি। আমরা প্রায় সবসময় জমিভিত্তিক আমাদের অর্ধেক দেশ নিয়ে মাথা ঘামাই। বাকি পানিভিত্তিক অর্ধেক দেশকে হিসেবেই ধরি না। কারণ আমরা ওই অংশে বসবাস করি না। আমরা তো হাওর বাওরেও বসবাস করি না। তাই বলে তো তাকে হিসেবের বাইরে রাখি না।
এখন থেকে আমাদের অংশের বঙ্গোপসাগরকে আমরা আমাদের দেশের মূল্যবান অংশ, এ কথা সবসময় মাথায় রেখে অগ্রসর হবো। এই অংশের পানির ওপর দিয়ে দেশ-বিদেশের সঙ্গে আমরা বাণিজ্য করবো। তার মাধ্যমে আমরা পুরো পৃথিবীকে আমাদের প্রতিবেশী বানাবো।
এই পানির মধ্যে আছে অফুরন্ত সম্পদ; মৎস্য সম্পদ, যা প্রতি বছর ফসল দেয়। এই পানির নিচে আছে অফুরন্ত গ্যাস। এর সবকিছুকে নিয়েই প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তা-ভাবনাকে চালিত করতে হবে।
বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত ড্রাই ডক লিমিটেডকে নিউ মুরিং টার্মিনাল কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। তারা কাজ শুরু করা মাত্রই কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। প্রথম দুই সপ্তাহে দেখা গেছে আগের তুলনায় প্রতিদিন গড়ে ২২৫টি বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। এ বন্দরকে আধুনিকভাবে গড়ে তোলা গেলে তা শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই ভূমিকা রাখবে না, নেপাল, ভূটানসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বিনিময়ে তারাও উপকৃত হবে, আমরাও উপকৃত হবো।
আমাদের উপকূল অঞ্চল অফুরন্ত সম্ভাবনার আধার। কুমিরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত নানা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যে সমগ্র উপকূল অঞ্চলকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। এই পুরো অঞ্চলে অনেকগুলো শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে শুধু সমুদ্রের সান্নিধ্য এবং তার ব্যবহারের দক্ষতার কারণে। সমুদ্র, উপকূলীয় অঞ্চলের সম্পদ ও পরিবেশের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমাদের বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি এবং তারা উৎসাহ সহকারে সাড়া দিয়েছেন।
গভীর সমুদ্রকে আমরা এখনো আমাদের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারিনি। একে কেন্দ্র করে আমরা মাছ পালন, আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছি, এতে করে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আমাদের অর্থনীতি নতুন শক্তিতে বলীয়ান হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে আমরা গভীরভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য আরব আমিরাত পুনরায় ভিসা চালু করেছে। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য প্রথমবারের মতো মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালু করেছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গেও ভিসা জটিলতা কীভাবে কমিয়ে আনা যায় এ নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
আগামী পাঁচ বছরে জাপানে অন্তত ১ লক্ষ বাংলাদেশি তরুণদের পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু করেছি। তরুণদের সেখানে পাঠানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ অন্যান্য ব্যবস্থাও আমরা নিতে শুরু করেছি। এর পাশাপাশি, আমরা ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, সার্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দক্ষ কর্মীদের পাঠানো উদ্যোগ নিয়েছি।
সৌদি আরব, জর্ডান, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে নথিপত্রের কারণে যে প্রবাসীরা ইরেগুলার হয়ে গিয়েছিলেন, তাদেরকে রেগুলারাইজ করার ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিদ্যমান চুক্তিগুলোকে পর্যালোচনা করে দেখছি যাতে আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনদের জন্য সেগুলো স্বস্তিদায়ক হয়।
দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের নাগরিকরা যে যেখানে অবস্থান করছে তারা যাতে সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পান আমরা সে বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছি।
চলতি বছর আমাদের নানা উদ্যোগের ফলে প্রায় ৮৭ হাজার বাংলাদেশি সুষ্ঠুভাবে হজ পালন করতে পেরেছেন। হজের ব্যয়ও অন্যান্য বছরের তুলনায় আমরা কমিয়ে আনতে পেরেছি। হাজীরা যাতে নির্বিঘ্নে হজ সম্পন্ন করতে পারে সেজন্য ‘লাব্বাইক’ নামে অ্যাপ চালু করেছি। যার মাধ্যমে ঘরে বসেই হাজীদের আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন তাদের অবস্থান প্রতি মুহূর্তে জানতে পেরেছেন।
এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতেও আমাদের হজ ব্যবস্থাপনা প্রশংসিত হয়েছে। আগামী বছরের হজ ব্যবস্থাপনা যেন আরও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যায় সেজন্য মন্ত্রণালয় এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তরুণ শিক্ষার্থীদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের বাবা-মা ও শিক্ষকরা। আমাদের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে বহু কষ্টে বড় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। লেখাপড়া শেষ করে অনেক ছাত্ররা অসুস্থ হয়ে বের হয়। এর কারণ আবাসিক হলের নোংরা পরিবেশ, খাবারের নিম্ন মান তার উপর দলীয় সন্ত্রাসীদের দমন-পীড়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবর্তে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের জোর করে রাজনৈতিক দলের প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া হতো। প্রশাসন ও শিক্ষকরা সবই জানতেন, অথচ কেউ এটি থামাতে পারেননি, চেষ্টাও করেননি। কারণ শিক্ষকদের একটি বড় অংশ প্রমোশনের জন্য, সুবিধার জন্য দলীয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। নিপীড়কের ভূমিকায় ছিলেন।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে দলীয় সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ আর অমানুষিক নির্যাতন চলত। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছিল টর্চার সেল।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, আমরা আর কখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমন কোনো রাজনীতি দ্বারা কলুষিত হতে দেব না যা পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট করে, তরুণদের জীবন ধ্বংস করে। বাবা-মায়েদের যেন সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়ে আর কখনো শঙ্কায় থাকতে না হয়।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ধারাবাহিকভাবে পরামর্শক কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছে, বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে।
বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
সরকার কিছুদিন আগে সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব প্রধান শিক্ষকের বেতনের গ্রেড এক ধাপ বাড়িয়ে দশম গ্রেড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শূন্য পদে সাড়ে ছয় হাজার প্রধান শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।
প্রাথমিকের পড়াশোনার পদ্ধতিগত পরিবর্তনের দিকেও আমরা মনোযোগ দিচ্ছি। সব স্কুলে ইন্টারনেট সংযোগ ও মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কমপক্ষে ১০০টি স্কুলে এ বছরের মধ্যেই ই-লার্নিং চালু হবে। ঢাকা চট্টগ্রামের অভিজ্ঞ শিক্ষকরা প্রযুক্তির সহায়তায় এসব স্কুলে শিক্ষকতা করে সেখানকার শিক্ষক ঘাটতি পূরণ করবেন।
যেসব এলাকায় বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে সেখানে সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি নিরসন এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক ও স্টারলিংক পরিষেবা ব্যবহার করে এ সংকট মোকাবিলা করা হচ্ছে।
স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের পড়াশোনার উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। স্কুলের অবকাঠামোকে নারীবান্ধব করে তুলতে স্কুল ভবন নির্মাণের সময় কমিটিতে নারী স্থপতি রাখার নিয়ম করা হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হলো-স্কুল ভবনের ডিজাইন থেকে শুরু করে পড়াশোনার পরিবেশ, চিন্তাভাবনায় মেয়েদেরকে বিষয়ভাবে গুরুত্ব দেওয়া, যাতে তারা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে স্বস্তিদায়ক পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ এবং আহত যোদ্ধাদের জন্যও আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত ৭৭৫টি শহিদ পরিবারকে প্রায় ১০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ও মাসিক ভাতা বাবদ ব্যাংক চেক দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট যারা আছেন, তাদেরও কয়েকটি আইনগত বিষয় নিষ্পত্তি সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর পাশাপাশি আহত ১৩ হাজার ৮০০ জন জুলাই যোদ্ধাকে তিনটি ক্যাটাগরিতে নগদ টাকা ও চেক বাবদ মোট ১৫৩ কোটি ৪ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে।
৭৮ জন অতি গুরুতর আহত জুলাই যোদ্ধাকে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরস্ক এবং রাশিয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে এবং চিকিৎসা ব্যয় বাবদ এ পর্যন্ত প্রায় একশ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আহতদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের সবকটি মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দেশের শহরে-বন্দরে হাজারো প্রতিষ্ঠান, সড়ক, সেতু, সেনানিবাস, যুদ্ধ জাহাজ, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে স্বৈরাচার তার নিজের এবং নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে চালু করেছিল। আমরা সব নাম পরিবর্তন করে আগের নাম বা মানানসই নাম করে দিয়েছি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমন এক অবস্থায় দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিল যখন প্রতিটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল। আমাদের প্রথম এবং প্রাথমিক কাজ ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার এবং পুনর্নির্মাণে হাত দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুনর্গঠন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, আইন-আদালত, নির্বাচন কমিশন-সহ যাবতীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সচল করা এবং নাগরিকদের নিকট দায়বদ্ধ করে তোলা।
রক্তাক্ত জুলাই ছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তরুণদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।১৬ বছর ধরে সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের বিরোধিতা করে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে প্রতিটিতেই দলীয় সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের আক্রমণ করেছে। প্রতিটি আন্দোলনকেই দমন করার জন্য দলীয় সন্ত্রাসীরা সর্বোচ্চ আঘাত করেছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অংশ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অথবা দাঁড়িয়ে দর্শকের ভূমিকায় থাকতে বলা হয়েছে।
একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারকাজ হাতে নিয়েছে। বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ-সহ যেসকল কাজ এ সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে করে যেতে পারবে সেসকল কাজের অধিকাংশই ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়ে গেছে, বাকি কাজ চলমান রয়েছে।
স্বৈরাচার আমলে দলীয় বাহিনীতে পরিণত হওয়া ভঙ্গুর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন যাতে না ঘটে সেজন্য পুলিশ সদর দপ্তরে একটি ‘সেল’ কার্যকর করা হয়েছে, যেখানে মানবাধিকারসহ পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে সংঘটিত যেকোনো অপরাধের বিষয়ে অভিযোগ করা যায়। এই সমস্ত ‘সেল’ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধান কার্যালয়েও স্থাপন করা হচ্ছে।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ হবে স্বচ্ছ কাচের ঘরে। হাজতখানায় বন্দিদের মানবিক সেবা নিশ্চিত করা হবে, অভিযান পরিচালনার সময় পুলিশ যেন জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ডিভাইসসহ বডি-ক্যামেরা পরিধান করেন তা নিশ্চিত করা হবে। পুলিশ যেন আর কখনোই কোনো আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করতে না পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেআইনি সমাবেশে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের স্বীকৃত পাঁচটি ধাপ অনুযায়ী পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
সবমিলিয়ে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ১৬টি সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ৪৩টি সংস্কারকাজ সমাপ্ত হওয়ার পথে।
দেওয়ানি আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ বিভিন্ন আইনগত সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি সরকার ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুমোদন করেছে। এর ফলে এখন থেকে কোনো ব্যক্তিকে আটকের পর ১২ ঘণ্টার মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব পরিবারকে জানাতে হবে।
আটককৃত ব্যক্তিকে আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দিতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি রিমান্ডের পর অসুস্থ বা আহত হলে তাকে ডাক্তার কর্তৃক পরীক্ষা করতে হবে এবং আঘাতের কারণ নিশ্চিত হতে হবে, তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে হবে।
এক্ষেত্রে পুলিশের দায় থাকলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
এই আইনের ফলে গ্রেপ্তার ও আটক নিয়ে মানুষের হয়রানি অনেক কমে আসবে, পুলিশের জবাবদিহিতা বাড়বে এবং বিচারের কাজ দ্রুততর হবে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ছিল কোনো ব্যক্তি থানায় জিডি করতে গেলে অবশ্যই তা গ্রহণ করতে হবে। জিডি গ্রহণ করা ছাড়া থানা থেকে কোনো ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। এই সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশের সব থানায় অনলাইনে জিডি করা যাবে। এখন থানায় জিডি না নেওয়ার আর কোনো অভিযোগ থাকবে না।
গণতান্ত্রিক চর্চার অন্যতম প্রধান শর্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় মুক্ত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রথম এবং সবচাইতে বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এসব বাধা অপসারণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা সমালোচনাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। যে কেউ চাইলেই যেকোনো মাধ্যমে-সেটা মূলধারার গণমাধ্যম হোক কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই হোক, সরকারের সমালোচনা করতে পারছেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমেও সরকারের সমালোচনা করা যাচ্ছে। নিকট অতীতে যা ছিল অকল্পনীয়।
সাংবাদিকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকার ইতোমধ্যেই প্রেস কাউন্সিল পুনর্গঠন করেছে। আপনারা জানেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ গুজব ও অপতথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। দেশকে অস্থিতিশীল করতে হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে গুজব। অপতথ্য মোকাবিলা করার জন্য সাংবাদিকদের সক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
স্বৈরাচারী সরকার আমলে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যা পরে সাইবার নিরাপত্তা আইন রূপে আবির্ভূত হয়েছিলো। আমরা এই আইনটি বাতিল করেছি। এই আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা বাতিল করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে এটি একটি বড় অগ্রগতি। নতুন যে আইন প্রণীত হয়েছে তাতে আগের আইনের নিবর্তনমূলক ৯টি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। আগের আইনের আওতায় করা ৯৫ শতাংশ মামলাই এসব ধারায়। আমরা বিশ্বাস করি, নতুন এই আইন প্রণয়নের পর সাংবাদিকদের আইনি হয়রানি বন্ধ হবে।
গত বছর মানুষের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দিতে ফ্যাসিবাদী সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল, যাতে গোপনে তারা দমন-নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার সাইবার সুরক্ষা আইন সংশোধন করে নতুন অধ্যাদেশে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ব্যন্ডউইডথ (রিয়েল টাইম ইন্টারনেট ট্র্যাফিক) পরিবহনে ৪.০০ টেরাবাইট/সেকেন্ডের মাইলফলক অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস পিএলসি। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবার মান ভালো করতে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আপনাদের আহ্বানে, একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আমরা দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলাম। জুলাই অভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশের যে অভূতপূর্ব সম্ভাবনা জাগ্রত হয়েছে তাকে এগিয়ে নিতে আপনারা আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
গত ১২ মাস ধরে আপনাদের সবাইকে সাথে নিয়ে জুলাইয়ের দাবি পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আসুন, আজ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই এই জাতিকে আমরা আর কখনো বিভক্ত হতে দেব না।
আমরা সকল নাগরিকের প্রতি মর্যাদাশীল থাকব, তিনি যেই পরিচয়েরই হোন না কেন। আমরা দৈনন্দিন জীবনে নানা ঘাতে প্রতিঘাতে সাময়িকভাবে যদি পথভ্রষ্ট হয়েও পড়ি প্রতি বছর জুলাই আমাদেরকে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হতে শক্তি যোগাবে।
জুলাই তরুণদের উছিলায় জাতির আত্ম-আবিষ্কারের মাস। ভুল ভ্রান্তি শুধরে নেবার মাস। গর্তে পড়ে যাবার প্রবণতা থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার মাস।
জুলাই গ্রামে গঞ্জে, সরকারি বেসরকারি স্কুল কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফসলের মাঠে, ঘরে বাড়িতে, কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণীদের কাছ থেকে তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলি জেনে নেবার মাস।
নির্বাচন আসছে। যদি আপনি আপনার নির্বাচনী এলাকা থেকে দূরে বসবাস করেন তবে এখন থেকে নিয়মিত নির্বাচনী এলাকা পরিদর্শন করুন। যাতে সেরা ব্যক্তিকে নির্বাচিত করতে আপনি প্রস্তুত হতে পারেন।
যাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের এই অতি মূল্যবান অধিকার ফিরে পেলাম, ভোটটা দেবার আগ মুহূর্তে যেন তাদের চেহারা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে।
ফেব্রুয়ারি বেশি দূরে নয়। নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নিতে নিতেই ভোটের দিন এসে পড়বে। বহু বছর আমরা কেউ ভোট দিতে পারিনি। এবার আমরা সবাই ভোট দেবো। কেউ বাদ যাবে না। সবাই যেন বলতে পারি নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে দেশকে রওনা করার জন্য আমি আমার ভোটটা দিয়েছিলাম। আমার ভোটেই দেশটা সেপথে রওনা হতে পেরেছিল।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসে সকল নাগরিকের কাছে আমার আহ্বান, আসুন, “নতুন বাংলাদেশ” গড়ার প্রথম বড় পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হই।
ঢাকা/সাইফ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ল ই গণঅভ য ত থ ন ন শ চ ত করত গণত ন ত র ক ন শ চ ত কর র প রক র য় স স ক রক জ সরক র র স র ব যবস থ সরক র র প জ ল ই সনদ প রথমব র আম দ র অ ন র জন য আম দ র প প রস ত ত দ র জন য আম দ র ব ব ধ বস ত র জন য স অন য ন য এখন থ ক ব যবহ র আপন দ র সরক র স ১৬ বছর এক বছর আর কখন ঐকমত য এই আইন এই প র কর ছ ল পর ব র য ন আর র অন য ত কর ছ ন র পর র পর ব পর ব শ ক ত কর র অর থ ন কর ছ র কর ম ব স কর হয় ছ ল জন য প পর ম ণ ত হয় ছ প রব স ক জ কর র লক ষ দ র এই লক ষ য নত ন ব পর চ ল সব স ক রক র স স জন য আগস ট আনন দ আপন র র আমর বছর র র একট অবস থ র আমল প রথম ক ষমত য সকল র আইন ক বছর ন করত আইন র র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
আনিসুল ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ হয়ে বহিষ্কৃতদের করলেন পুনর্বহাল
জাতীয় পার্টির (জাপা) জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনোনীত করেছে জি এম কাদেরবিরোধী অংশ। সেই সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের যেসব নেতাকে বিনা নোটিশে বহিষ্কার করেছিলেন, তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে স্বপদে পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। রাজধানীর গুলশান-২ নম্বর এলাকার একটি মিলনায়তনে আজ মঙ্গলবার দুপুরে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
জাতীয় পার্টির জি এম কাদেরবিরোধী অংশের দপ্তর সম্পাদক এম এ রাজ্জাক খানের নামে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আনিসুল ইসলাম মাহমুদদের এই সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত জি এম কাদেরসহ জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ সংকট আরও জটিল করে তুলল। এখন তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়, সে দিকে দৃষ্টি নেতা-কর্মীদের।
গত ৩০ জুলাই ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. নুরুল ইসলাম এক আদেশে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সব ধরনের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। এই প্রেক্ষাপটে আজ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও তাঁর সমমনারা বৈঠক করে এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবে এসব সিদ্ধান্তের কোনো কার্যকারিতা নেই বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির জি এম কাদের অংশের মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের যে আদেশ ছিল, তাতে আমরা দেখেছি, জি এম কাদেরসহ দুজনের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বহিষ্কৃতদের পুনর্বহালের বিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই। ফলে বহিষ্কৃত কেউ পুনর্বহাল হয়নি। এ অবস্থায় প্রেসিডিয়ামের সভা সম্পূর্ণ বেআইনি। কেবল চেয়ারম্যান অথবা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই সভা ডাকতে পারেন। অন্য কারও সভা ডাকার আইনগত ভিত্তি নেই।’
আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ অব্যাহতি পাওয়া দলের ১০ জন নেতা গত ১০ জুলাই আদালতে ওই মামলা দায়ের করেছিলেন। তাতে অভিযোগে বলা হয়, ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান (রাঙ্গা) গঠনতন্ত্রের পরিপন্থীভাবে জি এম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর জি এম কাদের পার্টির সম্মেলন ও কাউন্সিল করে অবৈধভাবে নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন করেন। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ২৮ জুন প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদ থেকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সাতজনকে, পরে আরও তিনজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং জাতীয় পার্টির ওয়েবসাইট থেকেও তাঁদের নাম মুছে ফেলা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাদীপক্ষ ন্যায়বিচারের স্বার্থে মোকদ্দমা বিচারাধীন থাকাকালে আদালতের কাছে চারটি অস্থায়ী আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আরজি জানানো হয়। তা হলো; জি এম কাদের কর্তৃক স্বাক্ষরিত প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদবি থেকে অব্যাহতির চিঠি এবং তৎমর্মে চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের বিরুদ্ধে অস্থায়ী আদেশ প্রদান, এই মোকদ্দমা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০(১)(ক) ধারার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকা এবং জি এম কাদেরের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করার অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রদান। সেই সঙ্গে দলে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ক্রমানুসারে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা প্রদান।
আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন পরিবর্তিত আকারে মঞ্জুর করেন। একই সঙ্গে জি এম কাদের ও মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার ওপর পরবর্তী ধার্য তারিখ ১২ আগস্ট পর্যন্ত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন। তবে আবেদনে বাদীপক্ষ দলে জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার যে নির্দেশনা চেয়েছিল, সেটি মঞ্জুর করেননি আদালত। কিন্তু জি এম কাদের কর্তৃক স্বাক্ষরিত প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পদবি থেকে অব্যাহতির চিঠি এবং তৎমর্মে চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের বিরুদ্ধে অস্থায়ী আদেশ প্রদানে বাদীপক্ষের আরজি আমলে নেন আদালত। এই সূত্রেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে স্বপদে পুনর্বহাল করে জি এম কাদেরবিরোধী অংশের নেতারা আজ প্রেসিডিয়ামের সভা করে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনোনীত করেন।
জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ধারা ২০-এর উপধারা-২ (খ) বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যানের দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতিতে চেয়ারম্যান পার্টিতে সিনিয়র কো–চেয়ারম্যান কিংবা কো–চেয়ারম্যান পদে কেহ দায়িত্বে থাকিলে তাঁহাকে, অন্যথায় প্রেসিডিয়ামের একজন সদস্যকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করিতে পারিবেন এবং মনোনীত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রেসিডিয়ামের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করিবেন।’
এই মোকদ্দমার বাদীদের অন্যতম জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে চেয়ারম্যানের (জি এম কাদের) হাত বাঁধা। তিনি কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিতে পারছেন না। অন্যদিকে তিনি এত দিন যাঁদের বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিয়েছিলেন, আদালতের আদেশের পর তা অকার্যকর হয়ে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বহিষ্কৃত বা অব্যাহতিপ্রাপ্তরা অটোমেটিক্যালি পুনর্বহাল হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র কো–চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে আমরা প্রেসিডিয়ামের সভা করেছি।’
এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সভায় সর্বসম্মতিক্রমে কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাহিদুর রহমান টেপা ও শফিকুল ইসলাম সেন্টু, সুনীল শুভ রায়, কাজী মামুনুর রশিদ, নুরুল ইসলাম মিলন, জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, ইয়াহইয়া চৌধুরীসহ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বিনা নোটিশে জি এম কাদের যাঁদের বহিষ্কার করেছিলেন, তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে স্বপদে পুনর্বহাল করা হয়।
পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সভাপতিত্বে দলের প্রেসিডিয়াম সভা হয়। এতে কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মহাসচিব মুজিবুল হক, প্রেসিডিয়াম সদস্য এ টি ইউ তাজ রহমান, সোলায়মান আলম শেঠ, নাসরিন জাহান রত্না, নাজমা আকতার, রানা মোহাম্মদ সোহেল, লিয়াকত হোসেন খোকা, জহিরুল ইসলাম জহির, মোস্তফা আল মাহমুদ, মাসরুর মওলা, জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, আরিফুর রহমান খান অংশ নেন। এ ছাড়া দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম, লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দ দিদার বখত, এ কে এম সেলিম ওসমান, নাছির উদ্দিন মাহমুদ, জহিরুল আলম রুবেল, আমিনুল ইসলাম ঝন্টু ভার্চ্যুয়ালি অংশ নেন।
সভায় দেশের চলমান রাজনীতি এবং আগামী দিনে জাতীয় পার্টির করণীয় এবং সাংগঠনিক নানা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আগামীকাল বুধবার বিকেল চারটা পর্যন্ত সভা মুলতবি ঘোষণা করা হয়।