রুকাইয়া ও আলিফ সম্পর্কে আপন চাচাতো বোন। দুজনই স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। স্কুলে যাওয়া, নদীতে গোসল, খাওয়াসহ প্রায় সব কাজ একসঙ্গে করত। ১ সেপ্টেম্বর আত্রাই নদে গোসলে নেমে মারা যায় তারা। স্বজনেরা তাদের দুজনকে পাশাপাশি কবরে দাফন করেছেন।

রুকাইয়া আক্তার (১৩) ও আলিফ নূরের (১২) বাড়ি দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার মুর্শিদপুর গ্রামে। তাদের বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে আত্রাই নদের মাধবের ঘাট। নদীর পশ্চিমে খানসামা উপজেলা, পূর্বে মুর্শিদপুর ও সেনপাড়া গ্রাম। শিশু থেকে বৃদ্ধ—কমবেশি সবাই আত্রাই নদের মাধবের ঘাটে গোসল করে। কিন্তু নদী খননের কারণে সৃষ্ট গভীর গর্তে পড়ে প্রাণ যায় রুকাইয়া-আলিফের।

গত মঙ্গলবার মুর্শিদপুর এলাকায় রুকাইয়া-আলিফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এখনো শোকের ছায়া। মেয়ের কথা তুলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রুকাইয়ার বাবা আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘সকালে আমার সাথে খেয়েছে। তারপর কোন ফাঁকে যে দুই বোন ছোট ভাইদের নিয়ে নদীতে গেছে, আমরা খেয়াল করিনি। মেশিন দিয়ে বালু ওঠানোর কারণে নদীর পূর্ব পাশে অনেক বড় বড় গর্ত হয়েছে। হয়তো বুঝতে না পেরে গর্তে গিয়ে পড়েছে আর উঠতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসের লোক এসে বিকেলে রুকাইয়াকে উদ্ধার করেছে। আর আলিফের লাশ পেয়েছি পরের দিন সকালে, কিছুটা দূরে।’

দিনাজপুরে রুকাইয়া-আলিফের মতো নদী বা পুকুরে গোসলে নেমে প্রাণহানির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বিশেষত বর্ষাকালে প্রাণহানির ঘটনা বেশি।

এ বিষয়ে জেলা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ৪ বছরে তারা ৫৪টি ফোন পেয়েছে। এসব ফোন পেয়ে তারা ৬২ জনের মরদেহ ও ৩৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে। যদিও স্থানীয় পত্রিকা ঘেঁটে গত ৪ বছরে ৮৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা জানা গেছে। এর মধ্যে নদীতে ডুবে মারা গেছেন ৪৬ জন। অন্যরা পুকুর-জলাশয়ে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই শিশু, যাদের বয়স ৪ থেকে ১৫ বছর। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে বীরগঞ্জ ও খানসামা উপজেলায়।

আত্রাই নদের মাধবের ঘাট এলাকার বাসিন্দা দীনেশ চন্দ্র বলেন, ‘খোঁজ নি দেখেন, আত্রাই নদীত ছাওয়া পড়ি মারা যাওয়ার ঘটনা বেশি। গোটা নদীটাত মেশিন দি বালু উঠি নিয়ে যাছে। বালু তুলায় একেকটা গর্ত হইছে দুই–তিন মানুষ (অন্তত ১৫ ফুট গভীর)। ছাওয়া ছোট নদীত স্নান করিবা আসিবি, ওমাক ফির বারণ করা যায়!’

স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশির ভাগ মৃত্যুর ঘটনা সকাল নয়টা থেকে বেলা তিনটার মধ্যে। উঠানে খেলার সময় বাড়ির লোকজনের অগোচরে পুকুরে পড়ে যাওয়া, নয়তো দল বেঁধে নদীতে গোসল করতে গিয়ে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।

কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, একসময় নদী-পুকুর-জলাশয়ে ভরপুর পানি থাকত। তখন এত মারা যাওয়ার কথা শোনা যেত না। কিন্তু এখন পানিই থাকে না। তারপরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবার সচেতনতার পাশাপাশি সাঁতার প্রশিক্ষণসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে।

জেলা নাগরিক ফোরামের আহ্বায়ক মেহেরুল্লাহ (বাদল) বলেন, প্রায়ই নদী বা পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি উদ্বেগের। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়, দিনাজপুরে কোনো ডুবুরি দল নেই। কোথাও নিখোঁজের ঘটনা ঘটলে রংপুর থেকে ডুবুরি আনতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুঁজেও সন্ধান মেলে না। পরদিন লাশ ভেসে ওঠে। তিনি বলেন, এত বড় একটি জেলা, এখানে ডুবুরি থাকা জরুরি। পাশাপাশি স্থানীয় ক্লাব, সংগঠনসহ প্রশাসনেরও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন।

বীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা আফরোজা সুলতানা বলেন, ‘ডুবে যাওয়া ব্যক্তিকে আমরা হাসপাতালে পাই মৃত অবস্থায়। এ ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে যতখানি প্রচার-প্রচারণা-প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা। বীরগঞ্জে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে জলকপাটের ওখানে। শিশুটি হয়তো সাঁতার জানে কিন্তু জলকপাটের ওই জায়গায় গোসলে নেমে একটি শিশুর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ রাখা কঠিন। শিশুরা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।’

দিনাজপুর ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় ডুবুরি পদ নেই। একজন ফায়ার ফাইটারকে ডুবুরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উদ্ধারকাজে রংপুরের দলের সঙ্গে তিনি কাজ করেন। তিনি বলেন, দিনাজপুর একটি বড় জেলা। এখানে নদী ও পুকুরের সংখ্যাও বেশি। জেলায় দ্রুত সেবা নিশ্চিত করতে পূর্ণাঙ্গ ডুবুরি দল দরকার। বিষয়টি তাঁরা মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ত য র ঘটন আল ফ র উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে না যুক্তরাষ্ট্র: ট্রাম্প

ভেনেজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিকোলাস মাদুরোর দিন ফুরিয়ে এসেছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। খবর বিবিসির। 

ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করতে যাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিবিএস নিউজের ৬০ মিনিটসকে বলেন, “আমার সন্দেহ রয়েছে। আমার মনে হয় না। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করছে।”

আরো পড়ুন:

ক্যারিবীয় জাহাজে আবারো যুক্তরাষ্ট্রের হামলা, নিহত ৩

নাইজেরিয়ায় হামলার হুমকি ট্রাম্পের

ক্যারিবীয় অঞ্চলে মাদক চোরাচালানের অভিযোগে নৌযানগুলোতে মার্কিন হামলা অব্যাহত থাকার মধ্যে ট্রাম্পের এই মন্তব্য এলো। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের প্রবাহ বন্ধ করার জন্য এই হামলা প্রয়োজনীয়।

ট্রাম্প এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, ক্যারিবীয় সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান মাদক বন্ধ করার লক্ষ্যে নয়, বরং ট্রাম্প বিরোধী মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, এটি ‘অনেক কিছু’ সম্পর্কে।

বিবিসির মার্কিন নিউজ পার্টনার সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে ক্যারিবীয় ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন হামলায় কমপক্ষে ৬৪ জন নিহত হয়েছে।

সম্প্রতি ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোতে এক বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, “মার্কিন হামলায় আপনি যেসব নৌযানে বিস্ফোরণ হতে দেখেন, তার প্রতিটিতে অন্তত ২৫ হাজার মাদকদ্রব্য ধ্বংস হয়। এগুলো যুক্তরাষ্ট্রে মাদক সরবরাহের জন্য দায়ী।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্থলপথে ভেনেজুয়েলায় হামলার পরিকল্পনা করছে কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প তা উড়িয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, “আমি এটা বলতে চাই না যে আমি এটা করব...আমি ভেনেজুয়েলার সাথে কী করব, আমি তা করব কিনা, তা আমি বলব না।”

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘অঘোষিত যুদ্ধ’ শুরু করার অভিযোগ তুলেছেন। অন্যদিকে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেট্রোর অভিযোগ, নৌযানগুলোতে হামলা চালানোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকায় ‘আধিপত্য বিস্তার’ করার চেষ্টা করছে।

ট্রাম্প জানান, তার সরকার ‘সারা বিশ্ব থেকে’ সন্ত্রাসীদের যুক্তরাষ্ট্রে ‘আসতে’ দেবে না।

তিনি বলেন, “তারা কঙ্গো থেকে আসে, তারা সারা বিশ্ব থেকে আসে, তারা আসছে, কেবল দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নয়। তবে বিশেষ করে ভেনেজুয়েলা- খারাপ। তাদের গ্যাং আছে।”

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্দিষ্ট করে ভেনেজুয়েলার ‘ট্রেন দে আরাগুয়ার’ নাম উল্লেখ করেন। তিনি এটিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ গ্যাং’ হিসেবে অভিহিত করেন।

জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজে ফিরে আসার পর থেকে, ট্রাম্প প্রশাসন মেক্সিকো এবং ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি মাদক পাচারকারী সংগঠন ও অপরাধী গোষ্ঠীকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভেনেজুয়েলার ট্রেন দে আরাগুয়া এবং কার্টেল অব দ্য সানস, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট মাদুরো ও তার ঘনিষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা পরিচালনা করে। তবে কারাকাস সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ