Samakal:
2025-11-03@19:17:52 GMT

ভ্রমণের ভ্রম

Published: 13th, January 2025 GMT

ভ্রমণের ভ্রম

পর্যটকের চাপে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের ত্রাহি অবস্থা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। আমরা জানি, অতিরিক্ত নৌযান ও পর্যটকের চাপজনিত ক্ষতি হইতে বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ২০১৪ সালে সুন্দরবন ভ্রমণ নীতিমালা প্রণীত হইয়াছিল, যথায় বনের অভয়ারণ্যের উপর চাপ হ্রাসকরত প্রান্তসীমায় নূতন পর্যটনকেন্দ্র গঠন, তৎসহিত প্রকৃতিবান্ধব পর্যটনের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু সোমবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাইয়া ইদানীং প্রত্যহ গড়ে ৩০টি নৌযান অভয়ারণ্যে পূর্ণ দিবস অবস্থান করিতেছে। শুধু তাহাই নহে; নৌযানেই বসিতেছে ব্যাপক হই-হুল্লোড় সহযোগে ‘বনভোজন’। বলিয়া রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত বনটির সম্পূর্ণ অংশ সংরক্ষিত এবং ৫৩ শতাংশ এলাকা ঘোষিত বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হইলেও সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বন বিভাগ ১১টি পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ করিয়াছে, যাহার মধ্যে চারটি পড়িয়াছে অভয়ারণ্য এলাকায়। 

সুন্দরবনে পর্যটনের প্রভাব লইয়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, যেই ট্রলার বা জাহাজে সুন্দরবনে মানুষ ভ্রমণ করে, সেইগুলির শব্দে বন্যপ্রাণী প্রজননে অনাগ্রহী হইতে পারে। ফলস্বরূপ সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী হ্রাস পাইবে। তদুপরি ঐ শব্দের কারণে বাদুড়, শুশুক ইত্যাদি শব্দতরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে চলাচলকারী প্রাণীর চলাচলে ব্যাঘাত ঘটায় ইহাদের পরিযায়ী হইবার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণারত খুবির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অপর অধ্যাপক বলিয়াছেন, মানুষ যেই পারফিউম-কসমেটিকস ব্যবহার করে, উহার ঘ্রাণ গ্রহণেও প্রাণিকুলের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হইতে পারে।

এমনকি ভরপুর পর্যটন বাণিজ্যের অন্তরালে পর্যটকের নিরাপত্তার বিষয়ও গৌণ হইয়া পড়িয়াছে। সুন্দরবন উপকূলে ট্রলার ও জালি বোটের ন্যায় চলাচল-নিষিদ্ধ নৌযানে পর্যটকগণ বনের গহিনে চলিয়া যাইতেছেন। বনের অভ্যন্তরে কোনো পর্যটক হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হইলে সেই ব্যক্তিকে উদ্ধারের কোনো পন্থা নাই। সরেজমিন পরিদর্শনে সমকাল প্রতিবেদক বন বিভাগের অনুমোদনপ্রাপ্ত ৬৮টি নৌযানের বেশ কয়েকটিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বয়া, লাইফ জ্যাকেট ও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পান নাই। অন্যদিকে সুন্দরবনে চলাচলকারী নৌযানের বনে প্রবেশের জন্য বন বিভাগের অনুমতিপ্রাপ্তির শর্তস্বরূপ নৌপরিবহন অধিদপ্তর হইতে জরিপ সনদ গ্রহণের নিয়ম থাকিলেও বন বিভাগ এই বিষয়ে তত্ত্ব-তালাশ করে না। নৌপরিবহন অধিদপ্তরও নিয়মটি কার্যকরে উন্নাসিক। ফলত অভয়ারণ্যের কটকা, কচিখালী, নীলকমলে পূর্বাপেক্ষা পর্যটকের চাপ বৃদ্ধি পাইয়াছে। এই কারণে পর্যটন প্রদর্শকগণকে উদ্ধৃত করিয়া প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, কটকা, কচিখালী ও নীলকমলে পূর্বের ন্যায় ব্যাঘ্র তো দূরস্থান, হরিণও দৃশ্যমান নহে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা সচল রাখিবার ক্ষেত্রে সুন্দরবনের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ইহার সহিত এই বন জাতীয় অর্থনীতির জন্যও কতটা গুরুত্বপূর্ণ, উহাও আমরা জ্ঞাত। শিকারি পক্ষীর নখরের থাবা হইতে রক্ষাকল্পে মুরগি যদ্রূপ উহার শাবকদিগকে ডানা দিয়া ব্যূহ রচনা করে, তদ্রূপ সিডর, আম্ফান, আইলার ন্যায় বহু ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবন কীভাবে প্রসারিত বক্ষ চিতাইয়া মানববসতি রক্ষা করিয়াছে, তাহাও অজ্ঞাত নহে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বিশেষত সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সুন্দরবনকে ক্রমেই বিপদে ফেলিতেছে। পরিবেশদূষক বহু সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পও সুন্দরবনের জন্য বিবিধ হুমকি উৎপাদন করিতেছে। ক্রমবর্ধমান পর্যটকের আনাগোনা নিশ্চয় বনের খোদ অস্তিত্বই বিপন্ন করিয়া দিবে।

অত্র সম্পাদকীয় স্তম্ভে ইতোপূর্বে বলিয়াছি, সুন্দরবনকে স্বাভাবিক অস্তিত্বে থাকিতে দিলে উহা স্বয়ং বাঁচার পন্থা অবলম্বন করিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মানুষের সহায়তা জরুরি। ইহারই অংশরূপে যথেচ্ছা অভয়ারণ্যে গমনের সুযোগ বন্ধ করা দরকার। সংরক্ষিত বনাঞ্চলেও নিয়মনীতির বাহিরে পর্যটন বন্ধ করা জরুরি। আমরা ভ্রমণের বিরোধী নহি। কিন্তু খোদ পর্যটনস্থলই ধ্বংস করিয়া ভ্রমণের ভ্রম কদাচ কাম্য নহে।
 

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’

পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে। 

যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে। 

রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”

তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।

শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’

ঢাকা/শহিদুল/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনে শিকারিদের হামলায় বন কর্মকর্তা আহত
  • দুবলারচরে পুণ্যার্থীদের যাত্রা শুরু
  • সুন্দরবনে দুবলার চরে রাস উৎসব শুরু আজ, এবারও নেই মেলার আয়োজন
  • সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’