নরসিংদীতে টেঁটার জায়গা নিয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র, ৫ মাসে খুনের মামলা ৫৯
Published: 18th, January 2025 GMT
নরসিংদী জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চল, বিশেষ করে রায়পুরা উপজেলায় ‘চুন থেকে পান খসলেই’ একপক্ষের সঙ্গে অন্যপক্ষের টেঁটাযুদ্ধ লেগে যেত। টেঁটা-বল্লমের ব্যবহার আগের মতোই আছে, এবার তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার। পুরো নরসিংদী জেলায় এখন অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। গত কয়েক মাসে নজিরবিহীন কিছু সংঘর্ষ-হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন।
নরসিংদীর ৬টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয় রায়পুরা উপজেলায়। বিশেষ করে দুর্গম চরাঞ্চলে। গত ৫ মাসে সংঘর্ষের ঘটনা কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি খুন হয়েছে রায়পুরাতেই। তাদের বেশিরভাগ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন।
গত বছরের ১৩ আগস্ট দিনে-দুপুরে রায়পুরা উপজেলার শ্রীরামপুর রেলগেট এলাকায় মনিরুজ্জামান মনির নামে এক সাংবাদিককে প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর বর্তমানে তিনি কিছুটা সুস্থ। এ ঘটনার এক মাস পরই ২৩ অক্টোবর একই উপজেলার শ্রীনগর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে দুপক্ষের সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হন। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন গুলিবিদ্ধ। ওই ঘটনায় অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
গত ৬ নভেম্বর সকালে রায়পুরা উপজেলার মির্জাচর ইউনিয়নের শান্তিপুর গ্রামের মেঘনা নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের সময় ড্রেজার আটক করে গ্রামবাসী। আটককৃত ড্রেজার ছিনিয়ে নিতে গ্রামবাসীর ওপর গুলিবর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা।
গত ৭ ডিসেম্বর একই উপজেলা মেথিকান্দা এলাকায় দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যসহ দুজন নিহত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১০ জন।
গত ১১ ডিসেম্বর একই উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল বাঁশগাড়ী এলাকায় দুপক্ষের সংঘর্ষে বাড়িঘরে আগুন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় উভয়পক্ষের গুলিবিদ্ধসহ ১০ জন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষে দুপক্ষই আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেছে।
নরসিংদী সদর উপজেলায়ও এ পর্যন্ত যতগুলো সংঘর্ষ, হামলা, মারামারি হয়েছে, সবগুলোয় আগ্নেয়াস্ত্রেরই ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৬ নভেম্বর মাধবদী থানার মহিষাশুড়া ইউনিয়নের বালুসাইর গ্রামে জুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধসহ তিনজন আহত হয়েছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে নরসিংদী সদর উপজেলার পাঁচদোনায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গুলি করে একজনকে হত্যা করা হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও তিনজন। ২১ ডিসেম্বর রাতে সদর উপজেলার পাঁচদোনা বাজার এলাকায় ডেকে নিয়ে একজনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ৯ নভেম্বর দুপুরে পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের গালিমপুর গ্রামে দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হন উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বাদল মিয়া।
এ রকম আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নরসিংদীর অন্য উপজেলাতেও প্রায়ই ঘটছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কিংবা আধিপত্য, যে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অবাধে ব্যবহার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। এসব অস্ত্র ব্যবহার করার সময় দেখা যায় অধিকাংশরাই মাথায় হেলমেট। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অস্ত্র হাতে হেলমেট বাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে।
আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের পাশাপাশি পুলিশের ওপর হামলা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ মাসে জেলার ৭টি থানায় মোট ৬৪৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে খুনের ঘটনায় ৫৯টি মামলা করা হয়। এ ছাড়া অস্ত্র মামলা ১০টি, ডাকাতির মামলা ৭টি, চুরির মামলা ৪৯টি এবং বিভিন্ন অপরাধে আরও ৫২১টি মামলা হয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার মো.
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নরসিংদী জেলার শাখার সাধারণ সম্পাদক হলধর দাস বলেন, “সমাজ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীরা যেন তাদের ধরনও পাল্টে দিয়েছে। পুলিশ যতটা নীরব ততটা সরব সন্ত্রাসীরা। এখন অপরাধ সংঘটনের আগে অপরাধীরা আধুনিক কৌশল ও প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে থাকে। মনে হয় যেন, তারা পুলিশ বাহিনীর চাইতেও বড় কোনো বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর শক্তিমত্তা, কৌশল ও ব্যবস্থাপনার প্রতি দৃষ্টি রেখেই তারা তাদের পরিকল্পনার ছক আঁকে। মনে হয় যেন, তাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সোর্স আছে। পুলিশ জানার আগেই তারা অপরাধ সংঘটিত করে দ্রুত গা-ঢাকা দেয়। যার ফলে অপরাধীরা দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বেড়েছে খুন, ছিনতাই, রাহাজানিসহ বিভিন্ন অপরাধ। এসব থেকে রেহাই পেতে হলে আগে সন্ত্রাসীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন করে অপরাধীদের সাজা দেওয়ার চিত্র সমাজে তুলে ধরতে পারলে অপরাধীরা পিছপা হবে।”
ঢাকা/হৃদয়/টিপু
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর গ ল ব দ ধ হয় ক ন দ র কর র স ঘর ষ অপর ধ র উপজ ল র এল ক য় র ঘটন ঘটন য়
এছাড়াও পড়ুন:
রাশিয়ার কাছে ট্রাম্পের পরমাণু সাবমেরিন মোতায়েনের ঝুঁকি আসলে কতটা
সাধারণ সময়ে এই ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক, যুগ পরিবর্তনকারী ও ভয়জাগানিয়া বলে মনে হতো। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধকালেও কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে রাশিয়ার উপকূলের দিকে পরমাণু সাবমেরিন পাঠানোর এমন নির্দেশ দেননি।
এই ধরনের পরমাণু উত্তেজনার খেলায় আগে কখনো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নেতা জড়াননি।
সত্যি বলতে, ১৯৬২ সালে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের উপকূল থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়ে বিশ্বকে পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় ১৩ দিন ধরে পুরো পৃথিবী ভয় আর অনিশ্চয়তায় কাঁপছিল।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্পনাবিলাসী শাসনব্যবস্থার কারণে এবার তেমন ভয় বা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। এটি মোটেই কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটের দ্বিতীয় সংস্করণ নয়, তা খুব স্পষ্ট।তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্পনাবিলাসী শাসনব্যবস্থার কারণে এবার তেমন ভয় বা আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে না। এটি মোটেই কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটের দ্বিতীয় সংস্করণ নয়, তা খুব স্পষ্ট।
তবে তার অর্থ এই নয় যে ট্রাম্প যা করলেন, সেটি কোনো ঝুঁকিমুক্ত সিদ্ধান্ত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অবস্থান এমনভাবে বদলেছেন, যেটা তাঁর পূর্বসূরিদের কেউই সাহস করেননি। এমনকি অনেকটা হালকাভাবেই তিনি পারমাণবিক উত্তেজনার সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখেছেন।
এখন যদি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পাল্টা জবাব দিতে চান, তাহলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।
ট্রাম্প হয়তো মনে করছেন, পুতিন তেমন কিছু করবেন না। আসলে ট্রাম্প সম্ভবত এবার রাশিয়ার কৌশলই ব্যবহার করছেন।
পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক অবস্থান বদলানোকে চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার সময় তিনি প্রায়ই কালিনিনগ্রাদে পারমাণবিক ওয়ারহেড ছুড়তে সক্ষম ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেন। এই কালিনিনগ্রাদ এলাকাটি ন্যাটোর সদস্যদেশ পোল্যান্ডের সীমান্তে অবস্থিত।
২০২৩ সালে পুতিন বেলারুশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেন। স্নায়ুযুদ্ধের পর এই প্রথম রাশিয়া নিজেদের দেশের বাইরে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করল। তিনি ইউক্রেনে বারবার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ইঙ্গিতও দিয়েছেন।
আর গতকাল শুক্রবার পুতিন ঘোষণা দিলেন, রাশিয়া ওরেশনিক নামে একধরনের হাইপারসনিক মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি শুরু করেছে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ২০২৫ সালের মধ্যেই বেলারুশে মোতায়েন করা হবে। তিনি দাবি করেন, এই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের জন্য নির্দিষ্ট স্থানও ইতিমধ্যে বাছাই করে রাখা হয়েছে।
গত কয়েক দিনে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ সতর্ক করে বলেছেন, ট্রাম্পের নানা হুমকি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। মেদভেদেভ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করছেন। তিনি এর আগেও পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন।
পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই পারমাণবিক অবস্থান বদলানোকে চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার সময় তিনি প্রায়ই কালিনিনগ্রাদে পারমাণবিক ওয়ারহেড ছুড়তে সক্ষম ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেন।কিছুদিন আগেও পুতিনের ভক্ত হিসেবে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার হুমকিকে পাত্তা দিচ্ছেন এবং তার মোকাবিলায় পাল্টা চাল দিচ্ছেন।
অন্যভাবে বললে, রাশিয়া যেটাকে ‘কেবল হুমকি’ হিসেবে দিচ্ছে, ট্রাম্প সেটাকে ‘আসল হুমকি’ হিসেবে নিচ্ছেন। এটা অনেকটাই উল্টো পরিস্থিতি। কারণ, ট্রাম্পের সমর্থকেরা সাধারণত বলে থাকেন, তাঁর কথাকে সরাসরি না নিয়ে রূপকভাবে বুঝতে হবে।
মেদভেদেভকে উদ্দেশ করে ট্রাম্প তাঁর নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে লেখেন, ‘শব্দের গুরুত্ব অনেক। আর সেগুলো অনেক সময় এমন পরিণতি ডেকে আনতে পারে, যা কেউ চায় না।’
তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই হুমকিকে অনেকটাই নাটকীয় ‘পারফরম্যান্স’ বলা যায়। হ্যাঁ, এটি উচ্চ ঝুঁকির, দায়িত্বহীন। তবে শেষমেশ এটি একধরনের ‘লোক দেখানো কার্যকলাপ’।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের পেছনে অন্য উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। আগামী কয়েক দিনে ট্রাম্পকে ব্যাখ্যা করতে হবে, ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। দিন দিন এটির গুরুত্ব আরও বাড়ছে। কারণ, গতকাল শুক্রবার কিয়েভে রাশিয়ার এক হামলায় ৩১ জন নিহত হয়েছেন।
এ ছাড়া রাশিয়ার তেল-গ্যাস কেনা দেশগুলো বিশেষ করে চীন, ভারত, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর দ্বিতীয় স্তরের নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরিকল্পনাও ট্রাম্পের জন্য কূটনৈতিক চাপে পরিণত হয়েছে।
এ সবকিছুর মাঝখানে ট্রাম্প যদি পরবর্তী সময়ে তাঁর হুমকি থেকে সরে দাঁড়াতে চান, তাহলে তিনি দেখাতে পারবেন যে সাবমেরিন মোতায়েনের মাধ্যমে তিনি রাশিয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। তিনি এমন একটি কৌশল নিয়েছেন, যার ঝুঁকি হয়তো বেশি, কিন্তু অর্থনৈতিক খরচ তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষ করে যেসব মিত্রদেশকে তিনি অন্য ক্ষেত্রে পাশে পেতে চান, তাদের ওপর শুল্ক আরোপের চেয়ে এই মূল্য তুলনামূলক কম।