বেড়েছে শিক্ষার ব্যয় অসহায় অভিভাবক
Published: 19th, January 2025 GMT
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন ইশতিয়াক আহমেদ। সংসারে রয়েছে তাঁর স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে। সামান্য আয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা।
এর মধ্যে কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম নগরের একটি বেসরকারি স্কুলে ছোট মেয়েকে ভর্তি করাতে গিয়ে ইশতিয়াকের চোখ কপালে ওঠে। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, ভর্তি বাবদ দিতে হবে ৬ হাজার টাকা, প্রতি মাসে বেতন দেড় হাজার এবং ডায়েরি, খাতা ইত্যাদি বাবদ লাগবে ১ হাজার ৮০০ টাকা। দুই রঙের কাপড়ে সেলাই করতে হবে স্কুল পোশাক; খরচ পড়বে ৪ হাজার। এর সঙ্গে লাগবে জুতা-মোজা। বাইরে থেকে কিনতে হবে ছয়টি বই; দাম পড়বে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। এসব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েকে ভর্তি না করেই বাসায় ফেরেন এই অভিভাবক।
এ অবস্থা শুধু ইশতিয়াক আহমেদের নয়, তাঁর মতো অনেক অভিভাবক নতুন বছরে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছেন। এর বড় কারণ, গতবারের চেয়ে এবার দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে প্রায় শিক্ষা উপকরণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১২ থেকে ১৫ পৃষ্ঠার একটি ছোট বই কিনতে গুনতে হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। খাতা, কলম, পেন্সিল, রাবার, শার্পনার, জ্যামিতি বক্সসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। একটু ভালোমানের ছোট থেকে মাঝারি সাইজের একটি স্কুলব্যাগের দাম এক হাজার টাকার ওপরে। স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে সব মিলে এক শিক্ষার্থীর পেছনে খরচ পড়ছে ১৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার
টাকা; যা অনেকের পক্ষেই বহন করা অসম্ভব। শিক্ষা খরচের এমন বাড়তি চাপে দিশেহারা নিম্ন-মধ্যবিত্তরা।
চট্টগ্রামে শিক্ষাসামগ্রী বিক্রির প্রধান তিনটি মার্কেট নগরের আন্দরকিল্লা, রেয়াজউদ্দিন বাজার ও চকবাজার। এসব মার্কেটের বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা যায়, এবার সবই বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ দামে। গত বছর যেসব পেন্সিল প্রতি ডজন ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, এবার সেগুলো বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। প্লে-ওয়ান ও প্রথম শ্রেণির একটি ১০ থেকে ১২ পৃষ্ঠার বইয়ের দাম পড়ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, যা গতবার ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকা। ৩০ থেকে ৩৫ পৃষ্ঠার একটি খাতার দাম পড়ছে ৪০ টাকা, যা গতবার ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। কয়েক পৃষ্ঠা বাড়লেই দাম পড়ছে অনেক বেশি। মানভেদে প্রতি ডজন কলমের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৬০ টাকা। প্রতি দিস্তা (খুচরা পৃষ্ঠা) খাতার দাম পড়ছে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ১৮ থেকে ২৫ টাকা। গতবার মাঝারি আকারের জ্যামিতি বক্সের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা থাকলেও, এবার বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়।
চকবাজার মোড়ের শাহেনশাহ মার্কেটের নিউ একাডেমিক লাইব্রেরি অ্যান্ড স্টেশনারি দোকানে মেয়ের জন্য বই কিনতে আসা শামীম আহমেদ বলেন, ‘দ্বিতীয় শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ের জন্য বই কিনতে এসেছিলাম। সামান্য কয়েক পৃষ্ঠার একটি বইয়ের দাম নাকি ২০০ টাকার ওপরে! গত বছর ছয়টি বই কিনেছিলাম ৩৫০ টাকায়। এখন সেসব বইয়ের দাম পড়ছে প্রায় দুই হাজার টাকা। এত টাকা খরচ করে সন্তানদের কীভাবে পড়াবে কম আয়ের মানুষ?’
আরেক অভিভাবক পাপিয়া ইসলাম বলেন, ‘চাল, ডাল, তেলসহ ভোগ্যপণ্যের আকাশচুম্বী দামে নিম্ন-মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস। সেখানে শিক্ষা উপকরণের বাড়তি দাম মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।’
নিউ একাডেমিক লাইব্রেরির মালিক রাজীব দে বলেন, ‘গতবার ছয় থেকে সাত প্রকারের এক সেট বই ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায় কেনা গেলেও, এবার একই বইয়ের দাম পড়ছে দুই হাজারের বেশি। অনেকে এত দাম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছেন। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে, তাই দামও বেশি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘বাড়তি ব্যয়ের চাপ সামলাতে না পেরে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ ঝরে পড়তে পারে। এ জন্য কম টাকায় শিক্ষার্থী ভর্তির পাশাপাশি শিক্ষা উপকরণের দাম কমাতে সরকারসহ দায়িত্বশীলদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।’
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সন্তানকে স্কুল ভর্তি করা থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে কয়েক গুণ বাড়তি ব্যয়ের কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে অভিভাবকদের। লাগামহীনভাবে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়লেও তা নজরদারিতে উদাসীন প্রশাসন, যার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।’
আন্দরকিল্লা প্রিন্ট অ্যান্ড প্রিন্টিং সমিতির এক নেতা বলেন, ‘শিক্ষার প্রায় সব উপকরণের দাম হু-হু করে বাড়ছে। এতে সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে নিয়ে যেতে একটি বড় অংশের মানুষ বেশি কষ্টে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। তবে কেন দাম বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখতে সরকার বা প্রশাসন নীরব।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইয় র দ ম র দ ম পড়ছ উপকরণ র বই ক ন সরক র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
‘লিচুর বাগানে’ যে কারণে ‘পিরিতের বেড়া’ দিতে হয়
‘তাণ্ডব’ সিনেমার গান ‘লিচুর বাগানে’ প্রকাশের পর রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। কফি শফ থেকে বাস, মেট্রোরেল আশপাশে কান পাতলে গানটা শোনা যাচ্ছে। কেউ না কেউ শুনছেন। সামাজিক মাধ্যমের স্টোরি ও রিলসেও গানটি ভেসে বেড়াচ্ছে। চরকি ও এসভিএফের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত গানটির আজ পর্যন্ত (১২ এপ্রিল ২০২৫) ভিউ হয়েছে যথাক্রমে ১২ মিলিয়ন ও ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন।
উচ্ছ্বসিত অনেক দর্শক গানটি নিয়ে মন্তব্যও করেছেন। তাহসিন নামের এক শ্রোতা লিখেছেন, ‘গানটির প্রতিটি সুর, দৃশ্য ও পরিবেশনায় বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অপূর্ব রূপ ফুটে উঠেছে। যাত্রাপালার ফিল্মের আবহে তৈরি এই গানটি যেন গ্রামীণ বাংলার প্রাণস্পন্দন তুলে ধরেছে। লোকেশন থেকে শুরু করে কস্টিউম, প্রতিটি ডিটেইলে আছে নিখুঁত যত্ন।’
গানটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বন্ধুদের মধ্যে খুনসুটিও চলছে। বন্ধুকে মেনশন দিয়ে কেউ যেমন প্রশ্ন করছেন, ‘কী রে, বেড়া ডিঙাতে পারলি?’ আবার কেউ জিজ্ঞেস করছেন বল তো, ‘“লিচুর বাগানে” কেন “পিরিতের বেড়া” দিতে হয়?’
প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক। শুরুতেই ‘লিচুর বাগানে’ গানটি দিয়ে আলোচিত, ‘কে এই ছত্তার পাগলা’ শীর্ষক প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। গবেষক সরোজ মোস্তফার মতে ‘কে দিল পিরিতের বেড়া লিচুরও বাগানে’ পঙ্ক্তির রচয়িতা ও সুরকার ছত্তার পাগলা। তবে সংগীতগবেষক গৌতম কে শুভর মত ভিন্ন। তাঁর মতে, ‘এটি মূলত প্রচলিত ঘেটু গান। “কে দিল পিরিতির বেড়া লিচুর বাগানে?” অংশটি মূল গানের অংশ। ছত্তার পাগলা নিজের মতো করে এর সঙ্গে কথা সংযোজন করেছেন। নেত্রকোনায় ছত্তার পাগলার লেখা রূপটিই বিখ্যাত হয়েছে।’ ২০১৪ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন ছত্তার পাগলা। জীবদ্দশায় রচনা ও সুরারোপ করেছেন কয়েক শ গান। মৃত্যুর বছর তিনেক আগে তাঁর কাছ থেকে গানটি শুনে হাতে লিখে রেখেছিলেন আল মামুন চৌধুরী।
আল মামুন চৌধুরীর লেখা অনুযায়ী গানটির কথা:
কে দিল পিরিতের বেড়া, লিচুরও বাগানে
লিচুরও বাগানে গো সই…লিচুরও বাগানে …(ঐ)
পাখি খাইছ না লিচু, বন্দে খাইবো
বন্দে লিচু খাইয়া, খুশি হইবো
আমার কাছে আইসা কইবো
কত শান্তি দিবো আমার মনেপ্রাণে (ঐ)
ছোট ছোট লিচুগুলি, বন্দে তুলে আম্বো তুলি
বন্দে দেয় গো আমার মুখে,
আমি দিতে চাই বন্ধুর মুখের পানে…(ঐ)
মিষ্টি লিচু খাইয়া বন্দে, বাঁশি বাজায় মন আনন্দে
আমার মনে লাগে সন্দে বন্ধু সম্ভব জাদু জানে (ঐ)
বাঁশি হাতে পলায় মালা, তারে চায় ছত্তার পাগলা,
করব লইয়া উলামেলা, (২) প্রাণবন্ধুর সনে…(ঐ)
সরল অর্থে ‘বেড়া’ হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা তথা বাধা তৈরির উপকরণ। আর ‘পিরিতের বেড়া’ মানে ভালোবাসায় বাধা। কিন্তু ভালোবাসার এই বাধা তথা প্রতিবন্ধকতা ‘লিচুর বাগানে’ কেন? কবিতা তথা গানে অর্থের তারতম্য অর্থের অনুগত না হয়ে বোধ কিংবা ভাবনার পরবশে প্রস্ফুটিত হয়। ব্যক্তিবিশেষে তা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ লাভ করে, ভিন্ন ভিন্ন মূল্য পায়।
আরও পড়ুন‘লিচুর বাগানে’ গানটি দিয়ে আলোচিত, কে এই ছত্তার পাগলা ০৬ জুন ২০২৫‘কে দিল পিরিতের বেড়া, লিচুরও বাগানে’ একটি ‘ঘাটু গান’ বা ‘ঘেটু গান’। এই গান প্রসঙ্গে জানা যায়, এই গানের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল নৃত্য। অল্প বয়সী একটি ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে তার নৃত্যের মধ্য দিয়ে ঘেটু গান পরিবেশিত হতো। সঙ্গে থাকত ঢোল, হারমোনিয়াম, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। কয়েকটি ‘ঘেটু গানে’র দৃষ্টান্ত দেখা যাক।
(১)
‘তুই আমারে চিনলে নারে
আমি তো রসের কমলা।
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি
মধ্যে নলের বেড়া।’
(২)
ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু
পান খাইলায়না
এক বালিশে দুইটি মাথা
সুন্দর কইরা কওরে কথা।
গানগুলো থেকে উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না যে ‘ঘেটু গানে’ যেমন ভাষার সারল্য আছে, তেমনিভাবে রূপকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যাপিত জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা নানা উপকরণ। আর এ ক্ষেত্রে গান রচনার সময় রচয়িতা তাঁর আশপাশ থেকেই গান নির্মাণের উপকরণগুলো যে নিয়ে থাকবেন, সেই ধারণাও পাওয়া যায়। ‘লিচুর বাগানে’ গানের ক্ষেত্রেও বোধ করি এটা ঘটেছে। তাই এই গানে যেমন ‘লিচু বাগানে’র কথা আছে, একইভাবে আছে ‘পাখি’, ‘বাঁশি’ ও ‘লিচু’র কথাও। পাখিকে লিচু না খাওয়ার অনুরোধ করলেও পাখি যেন খেতে না পারে সে কারণেই যে বেড়া দেওয়া হয়েছে; সেই ব্যথাও গানটিতে ফুটে উঠেছে। সব মিলিয়ে ‘লিচুর বাগান’ শেষ পর্যন্ত ‘লিচুর বাগানে’ সীমাবদ্ধ থাকেনি। হয়ে উঠেছে ভালোবাসার প্রতীক।
কথায় আছে, ভালোবাসা জয় করে নিতে হয়। জিতে নেওয়ার মধ্যেই আছে অপার আনন্দ। ভালোবাসায় প্রতিবন্ধকতা থাকাটা মোটেও দোষের নয়। বরং বাধা না থাকাটাই যেন আশ্চর্যের। একইভাবে ভালোবাসা জিতে নেওয়ার পরও পেয়ে গেছি বলে হাল ছেড়ে দিলে চলে না। ‘লিচুর বাগান’কে এ ক্ষেত্রে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করলে, ‘লিচুর বাগানে’ ‘পিরিতের বেড়া’ তথা ভালোবাসার বেষ্টনী দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কেননা ‘ভালোবাসা’কে ভালোবাসা দিয়েই আগলে রাখতে হয়। প্রবল যত্নে আঁকড়ে রাখতে হয়। যেন কোনো কৌতূহলেই তা দুলে না ওঠে, হারিয়ে না যায়।
আরও পড়ুনসাবিলা তো ‘লিচুর বাগানে’ দিয়ে কী যে আগুন লাগিয়ে দিল...০৫ জুন ২০২৫