৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী শব্দটি নতুন রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। কর্মক্ষেত্র বা সমাজে বৈষম্যের শিকার নানা গোষ্ঠী যেন তাদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো পেশার মানুষ তাদের বঞ্চনার কথা সরকারের শীর্ষ মহলকে শোনাতে ঢাকার রাস্তায় জড়ো হচ্ছেন। তবে প্রশ্ন উঠেছে, বৈষম্যের বিরোধিতা কি কেবল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নাম, নাকি বৈষম্য নিরসনের বিষয়ও এর মধ্যে নিহিত ছিল? জুলাই আন্দোলনের ব্যানারে বৈষম্যবিরোধী শব্দটি থাকলেও তাদের দফা-দাবির মধ্যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তেমন কিছু ছিল না। সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে তারা লড়েছেন। হয়তো সংক্ষিপ্ত সময়ে আন্দোলন অভ্যুত্থানে পরিণত হওয়ার কারণে তারা বৈষম্য বিরোধিতার কর্মসূচি হাজির করতে পারেননি।
বৈষম্য একটি বহুমাত্রিক ধারণা, যার বিপরীত হলো সাম্য বা সমতা। শ্রেণি বৈষম্য, আয় বৈষম্য, বেতন বৈষম্য, জাতিগত ও বর্ণবৈষম্য, লৈঙ্গিক বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, বয়স বৈষম্যসহ বহু ধরনের বৈষম্য হতে পারে। আমাদের সমাজে শ্রেণি ও আয় বৈষম্য ব্যাপক। সংবিধানে জাতিগত বৈষম্য করে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি.
আঠারো শতকের শেষ ভাগ থেকে মানব জাতি সমতা অর্জনের সংগ্রামে এগিয়ে যেতে থাকে। ফরাসি বিপ্লবে সাম্যের বাণী ছিল, কিন্তু তা ছিল বিমূর্ত আইনি সমতার। এই বিপ্লব সামন্ত অভিজাত ও ধর্মের শাসনের অবসান ঘটালেও সমাজে বাস্তব সাম্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। পুঁজিবাদ আরও বেপরোয়া বৈষম্য তৈরি করতে থাকলে বিপ্লব-বিদ্রোহ বাড়তে থাকে। এ থেকে আপাত নিষ্কৃতির পথ হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-উত্তরকালে উদারনৈতিক পুঁজিবাদ ও কল্যাণ রাষ্ট্র তৈরি হয়। এতে দরিদ্রদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অভিগম্যতা বৃদ্ধি, প্রগ্রেসিভ ট্যাক্সেশনের মাধ্যমে রাজস্ব থেকে রাষ্ট্র দরিদ্রদের জন্য কিছু সুবিধা বা বেনিফিটের ব্যবস্থা করে দেয়। এতে দরিদ্ররা অন্তত বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু তাতেও এসব সমাজে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও বৈষম্যের অবসান হয়নি। রুশ বিপ্লব সমতার পথে একটা বড় বিজয় হলেও শেষাবধি টিকে থাকেনি।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আমেরিকার সিভিল রাইট মুভমেন্ট, ১৯৯৪ সালে আফ্রিকার বর্ণবাদের অবসান, সাম্প্রতিক ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স, হ্যাশট্যাগ মি টু, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন বর্ণ, জেন্ডার ও আয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন। এ ছাড়া বৈশ্বিক দিক থেকে বিশ্বপুঁজিতন্ত্র উত্তর ও দক্ষিণের দেশগুলোর সম্পদের ব্যাপক বৈষম্য তৈরি করেছে। পুঁজির বৈশ্বিক শ্রম বিভাজন দক্ষিণের দেশগুলোকে উত্তরের লুণ্ঠন ও সস্তা শ্রম শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
আমাদের সংবিধানেও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অনেক কথা লেখা আছে, কিন্তু বাস্তবে কিছু হয়নি। আমরা সংবিধান সংস্কার নিয়ে মশগুল আছি এখন। শাসক শ্রেণির কাছে এসব কাগজ মাত্র; দরকার হলে ছুড়ে ফেলে দেবে আবারও। সমতার ধারণা নিয়ে ডান ও বামদের মধ্যে পার্থক্য আছে।
বুর্জোয়া সমতার ধারণা হলো একটা বিমূর্ত আইনি ধারণা। আইনের চোখে সবাই সমান, যদিও বাস্তবে সবাই সমান নয়। বলা হয়, সবারই সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার আছে; বাস্তবে বিরাট সংখ্যক মানুষ নিঃস্ব। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত যে বৈষম্য উৎপাদন করে; সমতার জন্য স্বয়ং এই ব্যবস্থার অবসান করতে হবে। বাস্তব সমতার আলাপ বাদ দিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গালভরা কথা শেষ বিচারে অর্থহীন হতে বাধ্য। সমতা নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু ভুল ধারণাও আছে। অনেকে মনে করেন, সমতা মানে সবাই একই রকম (সেমনেস)। আসলে তা নয়। অধিকারের মানদণ্ড সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করাই হলো সমতা। মানুষ গুণ ও সক্ষমতার দিক থেকে আলাদা। একে হেগেল বলেছেন ভিন্নতা (ডিফারেন্স)। সবাইকে বিমূর্তভাবে সমান মনে করা ফরাসি বিপ্লব ও এনলাইটেনমেন্টের সীমাবদ্ধতাজাত। আমরা কেউ কবি, কেউ বিজ্ঞানী, কেউবা গায়ক। মানুষের এই ভিন্নতাকে আমরা উদযাপন করতে চাই; বৈষম্যকে নয়।
উদারনৈতিকরা আইনি সাম্যের কথা বলেন, আবার বৈষম্যকে মেনেও নেন। লিবারেলদের বড় তাত্ত্বিক জন রলস পুঁজিবাদের মধ্যে শ্রেণি ও সামাজিক বৈষম্য মেনে নিয়ে পিছিয়ে পড়াদের জন্য স্বতন্ত্রনীতি (ডিফারেন্স প্রিন্সিপল) দিয়ে তাদের সামাজিক সুবিধাপ্রাপ্তির পক্ষে নৈতিক যুক্তি দেন। তিনি বেপরোয়া পুঁজিবাদের মধ্যে একটা ভারসাম্য তৈরি করতে চান, কিন্তু ব্যবস্থার অবসান চান না। তিনি রোগের ওপর মলম লাগানোর ভালোই ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন।
বর্তমান সময়ে শ্রমিক শ্রেণির ধারণার পরিবর্তন ও অন্তর্ভুক্তির পরিসর বেড়েছে। সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত নয়, এমন নতুন ধরনের শ্রমিক তৈরি হয়েছে। গিগ ইকোনমি অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। কেবল বস্তুগত উৎপাদনই নয়; যোগাযোগ, জ্ঞান উৎপাদন, কনটেন্ট তৈরি, রাইড শেয়ার, ডেটা এন্ট্রি, উবার, ডেলিভারি ইত্যাদি নতুন ধরনের কাজ তৈরি হয়েছে। ভার্চুয়াল বা ডিজিটাল শ্রমিকরা অবস্তুগত উৎপাদন ও মূল্য তৈরি করছে।
প্রচলিত প্রলেতারিয়েতের পাশাপাশি প্রিকারিয়েট (প্রিক্যারিয়েট) অর্থাৎ অস্থায়ী ও অনিশ্চিত কাজ, ফ্রিল্যান্সার, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কাজ করছেন এমন শ্রমিক তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে শ্রমিকদের ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক (ইনফর্মাল) শ্রমিক; এন্টনিও নেগরি ও মাইকেল হার্ডের মতে, যারা নিজেদের মধ্যে পার্থক্য ও বৈচিত্র্য বজায় রেখে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। বাংলাদেশের আগস্ট অভ্যুত্থানেও তেমনটা হয়েছে। কেবল সম্পদের বণ্টন নয়; সমতার জন্য গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায় শ্রমজীবীদের ভাগ থাকা দরকার। অমর্ত্য সেন কেবল সম্পদের বণ্টন নয়; ব্যক্তির সক্ষমতার (ক্যাপাবিলিটি) বিকাশ ও স্বাধীনতাকে সমতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। মোদ্দা কথা, সমতা নিয়ে নানা মত ও পথ থাকলেও বাস্তব সমতা অর্জন ও শ্রমজীবীদের ক্ষমতায় ভাগ বসানোর কোনো বিকল্প নেই।
ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান সংবিধান, ক্ষমতা, সাম্য ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে আমাদের চিন্তা ও পুনর্গঠনের সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে সম্পত্তিবান শ্রেণি লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তুলেছে, তা দরিদ্রদের মধ্যে পুনর্বণ্টন করে আমরা সমতার পথে যাত্রা শুরু করতে পারি। ইতিহাসে বিপ্লব-বিদ্রোহ ছাড়া মানবসমাজ সূচ্যগ্র পরিমাণ সমতাও অর্জন করতে পারেনি। আমরা যদি বর্তমান লুটেরা ব্যবস্থার পরিবর্তন না করতে পারি, তাহলে প্রাণ যাবে, রেজিম চেঞ্জ হবে; কিন্তু আমাদের বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বিফল সাধনায় পর্যবসিত হবে। শোষণ ও বৈষম্যের অবসানে বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন করে অধিকতর সমতা ও মুক্তিদায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মত ও পথ নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।
ড. আখতার সোবহান মাসরুর: নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের
অন্যতম ছাত্রনেতা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস থ র র অবস ন র জন য ক ষমত সমত র
এছাড়াও পড়ুন:
ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল
তিন দিন পর অবশেষে শুক্রবার ১৩ জুন দুই বোনের লাশ মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীতে ভেসে ওঠে। রাইসা ও জান্নাত মামাতো-ফুফাতো বোন। তারা আর হাসবে না। বই–খাতা, স্কুলড্রেস সব আছে, শুধু তারা তারা হয়ে গেছে দূর আকাশে। ১৩ বছরের জান্নাত ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ গিয়েছিল ঈদের ছুটিতে। তার এক বছরের ছোট মামাতো বোন রাইসার সঙ্গে খুব খাতির। ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে হাতে মেহেদিও দিয়েছিল দুজন। নানার বাড়ির কাছেই গজারিয়া নদী। সেখানে তারা বুধবার ১১ জুন যায় গোসল করতে। বলা হচ্ছে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয়। ঈদের ছুটির আগে-পরে (৫ জুন-১৪ জুন) এ রকম প্রায় ৬৬টি ঘটনায় ৭৮ জন ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মর্মান্তিক সব মৃত্যুর খবর এখনো আসছে।
যেকোনো বড় ছুটিতে ‘বাড়ির’ জন্য রওনা দিলেই সবাই পৌঁছাতে পারে না, আবার পৌঁছালেও সবার আর ফেরা হয় না কর্মস্থলে, স্কুলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে। শিশুরা এ সময় বেশি মারা যায় পানিতে ডুবে। এবার সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উল্লিখিত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।
৭৮টি মৃতদেহের মধ্যে মাত্র ১২টি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের। বাকি ৬৬ জনই শিশু–কিশোর। এদের বয়স ১০ মাস থেকে ১৭ বছর। ৬৬ জনের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ৫ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এখন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু।
ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ ডুবে মারা যায়। এটি সে দেশের মোট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ দিনে মারা যায় প্রায় ৪০ জন।
এটা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ভারতের চেয়ে বেশি।
বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান মনে করেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।
টিকা দিয়ে বা সময়মতো চিকিৎসায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অকালমৃত্যু ঠেকানো গেলেও ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে’ মানে পানিতে খেয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ডুবে মারা যাচ্ছে পানির বালতিতে, ডোবায়, পুকুরে, খালে, নদীতে।
একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুরাইসা আর জান্নাতের মতো কমপক্ষে ১৬ জন মারা গেছে, যারা একে অপরের বোন বা ভাই। মেহেন্দিগঞ্জে রাইসা ও জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না গেলেও ফরিদপুরের সালথায় তানহা নিজের ভাই তালহাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তানহা নিজেও পানিতে ডুবে যায়। যে কজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডুবে মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রিয়জনদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন। আসলে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের কৌশল জানা না থাকলে শুধু সাঁতারের জ্ঞান দিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণঘাতী প্রচেষ্টার নামান্তরমাত্র। একইভাবে আমি সাঁতার জানি বলেই আরেকজনকে সাঁতার শেখাতে পারব, এমন ভাবনার কোনো মানে নেই। সব খেলোয়াড় যেমন কোচ হতে পারেন না, তেমনি সব সাঁতারুই সাঁতারের প্রশিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন। এবার যে চারজন অভিভাবক ডুবে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই সাঁতার শেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সাঁতার শেখানো কোনো তামাশা বা ফান নয়। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
এত মৃত্যুর কারণ কীএই প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা দরকার।
যেসব কারণ কথিত বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন, তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। গত শুক্রবার (১৩ জুন) দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিন শিশু (রাফা (২), তাসিব (২) ও তুহিন (৫) ডুবে মারা গেলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমাননির্ভর ধারণা থেকে জানান, শিশুর মৃত্যুর জন্য মূলত অভিভাবকেরাই অনেকটা দায়ী। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি তেমন নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরের পাশেই পুকুর বা ডোবা রয়েছে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে প্রায় পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
এবারের মৃত্যুতালিকা দেখলে জানা যাবে অনেকেই তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। কাজেই ছেলেমেয়ে বেশি, তাই নজরদারি নেই, এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। ওয়ারিশজনিত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে খুনখারাবি, শিশুহত্যা এ দেশে নতুন কিছু নয়। বড় ছুটির সুযোগ কেউ নিচ্ছে না তো?
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ আমাদের প্রকল্পনির্ভর গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো কি বড় ছুটিতে খোলা থাকবে? ছুটিতে যখন গ্রামে শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন কি তাদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের কেউ জবাব দেওয়ার নেই।
গত কয়েক বছরের পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে অন্য একটা কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে সেই কারণটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম জানাচ্ছে, হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝোঁক আছে, এমন শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা একেবারেই কম নয়। খিঁচুনির নানা ধরন থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণভাবে এটা মৃগীরোগ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত ২২ জনের বিস্তারিত খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের খিঁচুনি বা মৃগীরোগের প্রভাব ছিল।
গত মে মাসে বড় জোয়ারের সময় মহেশখালীতে যে তিনজন (জামাল মিয়া, দানু মিয়া, ঝুমু) পানিতে ডুবে মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃগীরোগের প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ড. লে সানডার এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত যে মৃগীরোগের উপসর্গ থাকলে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ও তাঁর দল ৮৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই মৃগী বা মৃগীরোগ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা মেডপেজ টুডে লে সানডার–এর গবেষণার সূত্র ধরে জানিয়েছে, অন্যদের চেয়ে মৃগীরোগীদের পানিতে ডোবার আশঙ্কা ২০ গুণ বেশি। আবার বিশেষ ধরনের মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭ গুণ।
মৃগীরোগীর সংখ্যা কম নয়বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মৃগীরোগের উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, সমাজে অবহেলায় বেঁচে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ—সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগ্রহে এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত একটি জরিপ চালানো হয়। এটাই ছিল মৃগীরোগীর সংখ্যা নিরূপণের প্রথম জরিপ। কাকতালীয়ভাবে এই জরিপের ফলাফলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মৃগীরোগীর তথ্য হুবহু মিলে যায়। শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ৯ জন মৃগীরোগী আছে বলে এই জরিপে জানা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মোট মৃগীরোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লাখের মতো। বলে রাখা ভালো, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মৃগীরোগীর গড় সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য আছে।
শিশুর মধ্যে কী কী আলামত দেখলে প্রাথমিকভাবে মৃগীরোগের সন্দেহ করা করা যায়:
এক. হঠাৎ করে কোনো শিশু চোখ-মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে আর তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হলে।
দুই. কোনো শিশু যদি চোখের পলক না ফেলে হঠাৎ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বা অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। অনেক ক্ষেত্রে হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। (অভিভাবকেরা অনেক সময় ভাবেন, এটা শিশুর কাব্যিক ভাব। সন্তান তার কবি হয়ে উঠছে।)
তিন. আপাতদৃষ্টে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এক শিশু যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করে। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করে। আবার কয়েক মিনিট পর আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।
চার. পানি বা আগুনের কাছে গেলেই হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে।
পাঁচ. শিশু চোখেমুখে অন্ধকার দেখার কথা বলে। চোখে আলোর ঝিলিক দেখে, তারপর আর কিছু বলতে পারে না।
এসবের কোনোটাই আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, মৃগী কোনো অভিশাপ নয় বা দৈব কোনো রোগ নয়। মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি অসুখ, যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের শিশু এমনকি বয়স্ক মানুষেরও এটা হতে পারে।
পানিতে নামতে না দেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুদের গাছে চড়তে দেওয়া ঠিক নয়। যেসব শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে, তাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর স্রোত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনিয়ত ঠিক থাকলে অবশ্যই সম্ভব। ২০১৯ সালে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ৮৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।
গ্রামে আগে শিশুদের কোমরে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টি বেঁধে দেওয়া হতো। এটা কোনো অলংকার ছিল না। কর্মব্যস্ত মায়ের কান থাকত সেই ঘণ্টির দিকে। সচেতন অভিভাবকেরা বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারেন। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন প্রয়োজন এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে স্থানীয় অভিভাবক ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
লেখক গবেষক: [email protected]