সরদার মাহাবুবুর রহমান। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষে (বিআরটিএ) ক্যাশিয়ার হিসেবে যোগ দেন। তখন তাঁর বেতন ছিল সাকল্যে দেড় হাজার টাকা। দুই ধাপ পদোন্নতি পেয়ে ২০২৩ সালে উপপরিচালক (ডিডি, অর্থ) হন তিনি। এখন তাঁর বেতন প্রায় ৭০ হাজার টাকা। সরকারি এই কর্মকর্তা ঢাকায় গড়েছেন বহুতল ভবন, ফ্ল্যাট। কিনেছেন গাড়ি। গোপালগঞ্জ জেলা শহরে নির্মাণ করছেন ১৪ তলা ভবন।

মাহাবুবুর রহমানের পুরো চাকরিজীবনের হিসাব করলে দেখা যায়, তিনি বেতন পেয়েছেন সর্বোচ্চ ৮৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে তাঁর প্রয়াত কৃষক বাবা কিছু আবাদি জমি রেখে গেছেন, সেগুলো সেভাবেই আছে। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর বিপুল সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 
মাহাবুবুর রহমানের গ্রামের বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামে। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া আবাদি জমিজমা এখন পর্যন্ত বিক্রি করেননি মাহাবুবুর রহমান বা তাঁর শরিকরা। তাঁর স্ত্রী মিন্নি বেগম গৃহিণী। তিন ছেলেমেয়ে এখনও শিক্ষার্থী। শ্বশুরবাড়ি থেকেও বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির অর্থ দিয়েই গড়েছেন এসব সম্পদ।

বিআরটিএর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জেলা ও সার্কেল অফিসগুলোর জন্য বার্ষিক বরাদ্দ হয়। কোন অফিস কত বরাদ্দ পাবে তা নির্ধারণ করতেন মাহাবুবুর রহমান। একক ক্ষমতা ছিল তাঁর হাতে। বাজেট বাড়িয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট সার্কেল থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন তিনি। কেনাকাটার ভাউচার পাস করাতেও কমিশন দিতে হতো তাঁকে। এ ছাড়া বিআরটিএর বেসরকারি ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের বিল পাস করাতে উৎকোচ নিতেন। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাজেট সংক্রান্ত কমিটি হওয়ায় বর্তমানে তাঁর ক্ষমতা অনেকটা খর্ব হয়েছে। 
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাহাবুবের বাবা আব্দুর রাশেদ সরদার প্রায় ৩০ বছর আগে মারা গেছেন। তারা দুই ভাই ও দুই বোন। ডুমুরিয়া গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ছয়জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাহাবুবের বাবা রাশেদ সরদার কৃষিকাজ করতেন। তিনি চাষাবাদের যে জমিজমা রেখে গেছেন, তা ছেলেমেয়েরা বিক্রি করেননি। পৈতৃক টিনের বাড়ি ছিল। সেটি ভেঙে এখন একতলা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।

ঢাকা উদ্যানে বহুতল ভবন
মোহাম্মদপুর থানাধীন ঢাকা উদ্যানে মাহবুবুর রহমানের একটি বহুতল ভবন রয়েছে। ব্লক-এ। রোড-২। বাড়ি নম্বর-২১। আটতলা অট্টালিকা। ছাদের ওপরে অর্ধেকাংশে আরও একটি ফ্ল্যাট করা হয়েছে। সে হিসাবে বাড়িটি সাড়ে আটতলা। নিচতলায় তিনটি দোকান ঘর ভাড়া দেওয়া আছে। বাড়িটির ম্যানেজারের দায়িত্বে রয়েছেন আরজু মিয়া। 
ভাড়াটিয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে ৭-৮ বছর আগে। মাহবুবুর রহমান সেখানে কখনোই বাস করেননি। প্রতি তলায় দুটি করে ইউনিট। সব ক’টিতে ভাড়াটিয়া রয়েছে। 
কর্নার প্লটের ভবনটির বাইরের অংশে রং করা নেই। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, সাধারণত বাইরের দিকে চাকচিক্য থাকলে মানুষের মনে ভবন ও মালিক সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সেটা এড়াতে রং করা হয়নি।

গোপালগঞ্জে নির্মাণাধীন ১৪ তলা ভবন
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাহাবুবুর রহমান ২০১৪ সালে গোপালগঞ্জ জেলা শহরের থানাপাড়া জামে মসজিদের পাশে ৬৫ লাখ টাকায় স্ত্রীর নামে সাড়ে ৬ শতাংশ জমি কেনেন। বছর দুয়েক আগে সেখানে ১৪ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন মাহাবুব। 
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের ৯ তলা পর্যন্ত উঠেছে। বাইরের অংশের প্লাস্টারের কাজ চলছে। ভবনের প্রতিটি তলায় তিন ইউনিট। নির্মাণ শ্রমিকরা বলেন, তারা বাড়িটির মালিক হিসেবে মাহাবুবুর রহমানকেই জানেন। তিনি ঢাকায় সরকারি বড় কর্মকর্তা। মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে নির্মাণকাজ দেখতে এখানে আসেন। নির্দেশনা দেন। তাঁর নির্দেশনায় কাজ এগিয়ে চলছে। 
ছয় মাসের মধ্যে ভবনটি বসবাসের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে জানান শ্রমিকরা। ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে অন্তত ২ হাজার ৩০০ টাকা ব্যয় হবে।
মাহাবুবুর রহমানের শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জে। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, মাহাবুবের শ্বশুর প্রয়াত মোহাম্মদ আলী পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন। নব্বই দশকে তিনি অবসরে যান। এরপর গোপালগঞ্জ শহরের মিয়াপাড়ায় জমি কিনে ছাপড়া ঘর তুলে বসবাস করতেন। সাত মেয়ে ও চার ছেলে নিয়ে দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। শহরে মুদি ব্যবসা করেছেন। ভিটে  জমি ছাড়া তাঁর কোনো সম্পদ ছিল না। মিন্নির স্বামীর টাকায় জমি কেনার পর বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে।

রাজধানীর মিরপুরে ফ্ল্যাট
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাহাবুবুর রহমান একসময় মিরপুরের উত্তর টোলারবাগে পরিবার নিয়ে থাকতেন। গত ২৯ জানুয়ারি দুপুরে উত্তর টোলারবাগের ১৯/সি-২ নম্বর ভবনে গিয়ে এর সত্যতা মেলে। ভবনের ব্যবস্থাপক আতাউর রহমান জানান, একই হোল্ডিংয়ে পাশাপাশি দুটি ছয়তলা ভবন। প্রথম ভবনের ৩/এ ফ্ল্যাটের মালিক মাহবুবুর রহমান। ফ্ল্যাটের আয়তন আনুমানিক ১২০০ বর্গফুট। ২০১০ সালে ভবন নির্মিত হয়। ওই সময়ই ফ্ল্যাটটি কেনেন মাহাবুব। সেখানেই বসবাস করতেন। তবে প্রায় ১০ বছর আগে ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়ে পরিবার নিয়ে উত্তরায় চলে যান। বর্তমানে ধানমন্ডি এলাকার ফ্ল্যাটে থাকেন। 

সরকারি চালক চালান ব্যক্তিগত গাড়ি
মাহাবুবুর রহমানের একটি প্রাইভেটকার রয়েছে। পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন। তবে ব্যক্তিগত চালক রাখেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন জানান, মাহাবুবুর রহমানের সরকারি গাড়ির চালক সেলিমকে দিয়ে ওই গাড়ি চালানো হয়। মাহাবুবুর রহমান সরকারি গাড়িতে সকালে অফিসে আসেন, ছুটি হয় বিকেলে। এই সময়ের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে তিনি চালক সেলিমকে ধানমন্ডির বাসায় পাঠিয়ে দেন প্রাইভেটকার ড্রাইভিং করার জন্য। 
জানতে চাইলে মাহাবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘আমার যা সম্পদ রয়েছে সব আয়কর ফাইলে ওঠানো আছে।’ এই সম্পদ কি চাকরির টাকায় করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ নিয়ে ঢাকা উদ্যানের বাড়ি করেছি। এখন ভাড়া থেকে ঋণ শোধ করছি।’

মাহাবুবের সম্পদের বিবরণ শোনার পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড.

ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, তাঁর (মাহাবুব) বৈধ আয়ের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য নেই। তিনি যে পর্যায়ের কর্মচারী, সেই পর্যায়ে তো প্রশ্নই ওঠে না এত সম্পদ করার। বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারী হিসেবে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে কোনো পর্যায়ের ব্যক্তির পক্ষে বৈধ উপায়ে বিশাল সম্পদ অর্জন করার সুযোগ নেই। কাজেই এটা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে যে, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তাঁর দাপ্তরিক অবস্থান অপব্যবহার করে বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন। 
তিনি বলেন, যোগসাজশমূলক দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতা ব্যবহার করে সম্পদ গড়েছেন। তাঁকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি যাদের যোগসাজশে, সুরক্ষায় এই সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদেরও একইভাবে সম্পদের হিসাব নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া সাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনতে হবে। 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব আরট ম হ ব ব র রহম ন র গ প লগঞ জ ব আরট এ পর য য় পর ব র করত ন ভবন র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে এবার জামায়াতের বিক্ষোভ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিজয়নগর উপজেলা জামায়াতের উদ্যোগে ‍উপজেলার চান্দুরা এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করা হয়।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২টি আসনসহ দেশের মোট ৩৯টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রাথমিক গেজেট প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সীমানা পুনর্বিন্যাসের আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসন সদর ও বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ছিল। নতুন গেজেটে বিজয়নগরের তিনটি ইউনিয়ন—হরষপুর, চান্দুরা ও বুধন্তি ইউনিয়নকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের মধ্যে দেওয়া হয়েছে। ওই ইউনিয়ন তিনটিকে আগের মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের মধ্যে রাখতে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত আবেদন পাঠিয়েছেন বিজয়নগর উপজেলার চার বাসিন্দা।

আজকের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা জামায়াতের সভাপতি লুৎফর রহমান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রাষ্ট্রু সরকার, চান্দুরা ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি সোহাগ খন্দকার, চান্দুরা হেফাজতে ইসলামের সহসাংগঠনিক সম্পাদক শিহাব সিদ্দিকী, চান্দুরা ইউনিয়ন যুব খেলাফত মজলিসের সাধারণ সম্পাদক তানভীর আহমদসহ আরও অনেকে। তারা আধা ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩টিতে প্রায় ৯৬ হাজার ভোটার আছেন, যা উপজেলার মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। দুই লক্ষাধিক ভোটারবিশিষ্ট উপজেলা একক সংসদীয় আসনের উপযুক্ত হলেও বছরের পর বছর ধরে এটিকে একবার সদর, একবার সরাইল, আবার কখনো নাসিরনগরের সঙ্গে যুক্ত করে অবহেলার শিকারে পরিণত করা হচ্ছে।

তিনটি ইউনিয়নকে আগের আসনে রাখার দাবিতে উপজেলার গোলাম মোস্তফা, এ কে এম গোলাম মুফতি ওসমানী, মো. জাহিদুজ্জামান চৌধুরী ও মো. বায়েজিদ মিয়া স্বাক্ষরিত একটি লিখিত আবেদন গতকাল দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।

বিজয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

আরও পড়ুনব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ১৭ ঘণ্টা আগে

এর আগে গতকাল বিকেলে উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে কর্মসূচিতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজন অংশগ্রহণে বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হয়। এ সময় তাঁরা আধা ঘণ্টার মতো সড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন স্লোগান দেন। একই স্থানে আজ বিকেলে একই দাবিতে মিছিল ও সমাবেশ করার কথা আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ