দিল্লির মতো ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণকে একত্রিত করার পরামর্শ
Published: 6th, February 2025 GMT
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন একত্রিত করার সুপারিশ করেছে অর্থনৈতিক সংস্কার বিষয়ক টাস্কফোর্স। সব ধরনের আহ্বান এবং সমালোচনা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে ঢাকা শহর দুই ভাগে বিভক্ত করে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিল্লির মতো ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে একত্রিত করে একটি মেট্রোপলিটন সরকার গঠন করলে উপকার পাওয়া যাবে।
অর্থনীতি চাঙা করতে এবং টেকসই উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণ করতে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কেএএস মুরশিদকে প্রধান করে এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড.
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকাকে পুনরায় একীভূত করা হলে শাসন ব্যবস্থায় গতি আসবে, অনাকাঙ্খিত জটিলতা কমবে এবং সম্পদের সঠিক বণ্টন নিশ্চিত হবে। প্রতিবেদনে সমন্বিত নগর পরিকল্পনার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ভূমি ব্যবহার, পরিবহন অবকাঠামো ও জনসেবাকে সমন্বিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ নগর মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হোক। এগুলো ছাড়াও টাস্কফোর্স ঢাকার সব ধরনের গণপরিবহন ও সহায়ক পরিবহন ব্যবস্থাকে একই প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় আনার সুপারিশ করেছে।
প্রস্তাবিত সমন্বিত গণপরিবহন ইউনিটের অধীনে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি (বিআরএফ), ট্রাম, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), লাইট রেল ট্রানজিট (এলআরটি), মনোরেল, শহরতলির যাত্রীবাহী ট্রেন, মেট্রোরেল (এমআরটি) এবং রাইডশেয়ার পরিষেবাগুলো থাকবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ইউনিটটি মেয়রের কার্যালয় অথবা একটি নির্দিষ্ট স্থানীয় সরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হলে বিভিন্ন গণপরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এছাড়া, এসব সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা তার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে এবং আরও বাসযোগ্য ও কার্যকরভাবে পরিচালিত রাজধানী শহরে রূপ নিতে পারবে।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নানা সমস্যার কারণে আধুনিক ও বাসযোগ্য রাজধানী হিসেবে ঢাকার কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকার সড়ক নকশা অপরিকল্পিত। এটি মোট এলাকার মাত্র ৭ শতাংশজুড়ে বিস্তৃত। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও তৃতীয় পর্যায়ের সড়কের মধ্যে কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই এবং প্রধান সংযোগ সড়কেরও অভাব রয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পুরোনো পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। সেখানে একমুখী ট্রাফিক প্রবাহ, দ্বিমুখী ট্রাফিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সড়ক টোল নীতি নির্ধারণ বা বহুমুখী গণপরিবহন কেন্দ্রের মতো আধুনিক ব্যবস্থা এখনও চালু হয়নি।
এতে আরও বলা হয়েছে, বিদ্যমান বিশৃঙ্খল গণপরিবহন ব্যবস্থার মধ্যে নতুন রেললাইন ও একাধিক ফ্লাইওভারের অনুমোদন জটিলতা আরও বাড়িয়েছে। এ ছাড়া, মূলধননির্ভর ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে গণপরিবহন অবকাঠামোর ভবিষ্যৎ উন্নয়নের সম্ভাবনা অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসপাতাল, অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহজ প্রবেশাধিকার এখনও নিশ্চিত হয়নি। এটি দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার ফলে আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
ঢাকায় যানবাহনের গতি বছরের পর বছর নাটকীয়ভাবে কমছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালে ডিউটিপি গবেষণায় গড় গতি ছিল ২৫ কিমি/ঘণ্টা, যা ২০০৫ সালে এসটিপি গবেষণায় ১৫ কিমি/ঘণ্টায় নেমে আসে। এরপর ২০১৫ সালে আরএসটিপি গবেষণা অনুযায়ী, এটি আরও কমে ৬.৭ কিমি/ঘণ্টায় পৌঁছায়। সাম্প্রতিক ইউআরএসটিপি গবেষণার (অপ্রকাশিত) ফলাফল পরিস্থিতির আরও অবনতি দেখাচ্ছে। এই নিম্নমুখী প্রবণতা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, ঢাকা ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ছে, প্রায় অচল শহরে পরিণত হচ্ছে। গুগলের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১১.৫ কিলোমিটার জুড়ে (তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত) অপরিবর্তনীয় নিষিদ্ধ এলাকা শহরের গতিশীলতা ও সম্প্রসারণকে আরও সীমিত করে রেখেছে।
এ ছাড়া, প্রতিবেশী দেশগুলো যেখানে তাদের ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে কৌশলগতভাবে একাধিক বিমানবন্দর ও রানওয়ে গড়ে তুলেছে, সেখানে ঢাকা এখনো মাত্র একটি বিমানবন্দর ও একটি রানওয়ের ওপর নির্ভরশীল। এটি শহরের উন্নয়নকে পিছিয়ে দিচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫০ বছরে সুবিধাবাদী দুর্বৃত্ত শ্রেণির উত্থান হয়েছে, যা অর্থনীতির মূল ভিত্তি দুর্বল করেছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। বিগত সব সরকারকেই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনিয়মের দায় নিতে হবে। তবে গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্দ নীতির কারণে সুশাসনের ব্যাপক অবনতি হয়।
টাস্কফোর্স মতামত দিয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা পেতে বাধ্যতামূলক ঘুষ-দুর্নীতির প্রবণতা বেসরকারি খাতেও ছড়িয়েছে। এ কারণে জনগণের সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবেদনে ‘গুন্ডা প্রতিরোধ বাহিনী’ কেমন হতে পারে, তার নকশা প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়, শুধু নির্দিষ্ট কাজের জন্যই নিয়োজিত এ বাহিনী সরকারি খাত কিংবা বেসরকারি সিকিউরিটি ফার্ম থেকেও হতে পারে। বাহিনীর অপব্যবহার প্রতিরোধেও পাল্টা ব্যবস্থা থাকতে হবে। অ্যান্টিগুন স্কোয়াডের কার্যক্রম তদারকে তরুণ সমাজ ও নাগরিক সমাজকে মূল ভূমিকায় রাখার সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স।
হাসনাত//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব যবস থ সরক র সমন ব
এছাড়াও পড়ুন:
৯ ঘণ্টা ধরে শাহবাগ অবরোধ, জনভোগান্তি চরমে
জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং দ্রুত স্থায়ী বিধানে যুক্ত করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় ৯ ঘণ্টা ধরে অবরোধ করে রেখেছেন ‘জুলাই যোদ্ধারা’। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে জুলাই শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের (আহত) ব্যানারে তাঁরা এ ‘অবস্থান কর্মসূচি’ পালন করছেন।
রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ে আশপাশের সড়কগুলোতে। এসব সড়কে দিনভর ব্যাপক যানজট তৈরি হয়। ফলে বৃষ্টির মধ্যে জীবনের তাগিদে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষদের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। বাধ্য হয়ে বিকল্প পথে চলে গণপরিবহন, অনেক যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেখা গেছে হেঁটে হেঁটে। বিশেষ করে অফিসফেরত মানুষকে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
বেলা ১১টায় শাহবাগ মোড়ের সঙ্গে যুক্ত সব সড়কের মুখ আটকে দিয়ে সড়কের মাঝখানে অবস্থান নেন অবরোধকারীরা। এ সময় তাঁরা জুলাই সনদ দ্রুত বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবি জানান। অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জুলাই যোদ্ধা সংসদ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম ওই কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়। এ সময় অবরোধকারীরা ‘জুলাই নিয়ে টালবাহানা, চলবে না চলবে না’, ‘জুলাইয়ের চেতনা দিতে হবে ঘোষণা’, ‘জুলাই সনদ দিতে হবে, দিতে হবে, দিতে হবে’ স্লোগান দিতে থাকেন।
বন্ধ হয়ে পড়ে শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, সায়েন্স ল্যাব ও গুলিস্তানগামী প্রধান সড়কগুলোও। ফলে সকাল থেকেই এসব এলাকায় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এসব সড়কে চলাচলকারী গণপরিবহনগুলো বিকল্প পথে চলাচল করে।
বেলা তিনটার দিকে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ–সংলগ্ন মূল সড়কে পুলিশের ব্যারিকেড ও বাঁশ ব্যবহার করে সড়ক আটকে রেখেছেন অবরোধকারীরা। শাহবাগ থানার সামনের সড়কেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন তাঁরা।
বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ষাটোর্ধ্ব নূরে আলম বলেন, ‘কেরানীগঞ্জে যাব। কোনো বাস পাচ্ছি না। রিকশায় যে কিছু দূর যাব, তারাও ভাড়া বেশি চাচ্ছে।’ একপর্যায়ে হেঁটেই রওনা দেন তিনি।
এক পথচারী ইমরান হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দুই দিন পরপর সড়ক অবরোধ হয়। এর ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের।’
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শাহবাগ থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হতে দেখা যায় মোটরবাইক আরোহীদের। শাহবাগ থানার সামনে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশাকে বাধা দিলে চালক বলেন, ‘এত দাবিদাওয়া এত দিন আছিলো কই।’ তবে গণপরিবহন আটকে দেওয়া হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যানবাহন এবং তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স শুরু থেকেই চলাচল করতে দেখা গেছে।
অবরোধকারীদের দাবি
অবরোধকারীদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে জুলাই শহীদ ও জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি; শহীদ পরিবার ও আহতদের আজীবন সম্মান; চিকিৎসা, শিক্ষা ও কল্যাণের পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান করা; শহীদ পরিবার ও আহতদের প্রতি দায়িত্ব গ্রহণ করা; আহতদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান ও কল্যাণমূলক ব্যয় রাষ্ট্রকে বহন করা; আহত ও শহীদ পরিবারের জন্য আজীবন সম্মানজনক ভাতা নিশ্চিত করা; শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য বিশেষ আইনি সুরক্ষা ও সহায়তাকেন্দ্র গঠন করা; শহীদ ও আহতদের ওপর সংগঠিত দমন-পীড়নের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিচারকাজ সম্পন্ন করা এবং একটি স্বাধীন সত্য ও ন্যায় কমিশন গঠন করা।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খালিদ মনসুর বলেন, সকাল থেকেই শাহবাগে অবরোধের কারণে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। শাহবাগ থানা-পুলিশ আলোচনার মাধ্যমে অবরোধকারীদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
তবে জুলাই যোদ্ধা সংসদের মুখ্য সংগঠক মাসুদ রানা জানান, তাঁদের আন্দোলন চলছে। সনদ ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তাঁরা এখানেই থাকবেন।