চল্লিশ বছর আগে, ১৯৮৫ সালে কাজী আনোয়ার হোসেন সৃষ্ট কালজয়ী চরিত্র মাসুদ রানা সিরিজের একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল ‘চারিদিকে শত্রু’ নামে। চার দশক আগের এই বইয়ের নামটি কীভাবে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল সেই কথায় আসছি, তবে তার আগে সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারের শিরোনামটাও তুলে ধরছি, ‘আগে শত্রু মনে হতো একটা, এখন মনে হচ্ছে চতুর্মুখী’।

নাহিদ ইসলাম সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তাঁর চিন্তার জায়গাটি নিশ্চয়ই ভিন্ন, পরিসর অনেক ব্যাপক। তবে আমাদের মতো আমজনতার উদ্বেগটাও নীতিনির্ধারকেরা একটু ভেবে দেখতে পারেন, কারণ এই বিষয়টিও একেবারে ফেলনা নয়। এখন ঘরে-বাইরে চারদিকে এমন এক অস্বস্তিকর অনুভব, যেন চারদিকে দৃশ্যমান বা অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত লড়াই করছি। এবং বলাই বাহুল্য, এই লড়াইয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শত্রুর জয় নিশ্চিত হচ্ছে।

ফেসবুকে ‘ট্রাফিক অ্যালার্ট’ নামে একটি গ্রুপের সদস্য হিসেবে নিয়মিত ট্রাফিক পরিস্থিতির আপডেট পাই। কোন রাস্তা কখন বন্ধ, কোথায় আকস্মিক আন্দোলনের ভোগান্তি চলছে, কোথায় দীর্ঘ যানজট ইত্যাদি। তবে কয়েক মাস ধরে নগরীর ট্রাফিক পরিস্থিতি ছাপিয়ে সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে রাজপথের নিরাপত্তাহীনতা, অরাজকতা আর রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার বর্ণনা।

কয়েক দিন আগে এই প্রথম আলোতেই আমরা দেখেছি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ভয়াবহ চিত্র। পাঠকদের অবগতির জন্য ‘ট্রাফিক অ্যালার্ট’ গ্রুপে দেওয়া ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় কিছু ঘটনা তুলে ধরছি:

ঘটনা এক: অঞ্জন আহমেদ সানভী ৬ ফেব্রুয়ারি দেওয়া একটি পোস্টে বলেছেন, ‘মাওয়া থেকে আসার পথে পোস্তগোলা ব্রিজ থেকে নেমে মোচড়েই মোবাইল ছিনতাই করা হচ্ছে বাস থেকে টান দিয়ে! আমাকে ভিডিও করতে দেখে মোবাইল টান দিয়ে ভেগেছে অন্যদিক দিয়ে! সবাই একটু সাবধান থাকবেন প্লিজ! আর এদের কাছে চাপাতি থাকে তাই একা কেউ যেয়েন না সামনে দয়া করে!’

এই পোস্টের সঙ্গে ছিনতাইকারীর ছবিও যুক্ত করেছেন তিনি।

ঘটনা দুই: জুনায়েদ আহমেদ নামের আরেকজন ৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘খুব বাজে একটা অবস্থা এয়ারপোর্ট থেকে কাওলা পর্যন্ত! আমি জ্যামের কথা বলছি না! আমি বলছি ছিনতাইকারীর কথা। আজকে সময় ৭:২০ (রাত) এয়ারপোর্ট ফ্লাইওভার থেকে নামতেই দেখলাম ৬ জন একসাথে মাঝখান দিয়ে হাঁটতেসে, অবাক হইয়া দেখলাম কী করে। হঠাৎ ৬ জনের একজন একটা গাড়িকে টার্গেট করে বাকিদের ডাক দিল যাতে অ্যাটাক করে। এখন বলতে পারেন সবাই আমি কেন আটকাইলাম না! কারণ, আমি একা ছিলাম কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি, ঠিক ১০০ গজ সামনেই ২ জন পুলিশ দাঁড়ানো ছিল রেকার নিয়ে, আমি সামনে গেলাম পুলিশকে বললাম কাহিনি, বলতেসে উনার সময় নাই। মেজাজ খারাপ হয়ে গেসিলো পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়ায় অকথ্য ভাষায় গালাগালি করলাম বাট লাভ হলো না, ওরা চুপ ছিল! আমিও বুঝলাম আসলে ওদেরকে বলে লাভ নাই। মনে কষ্ট নিয়া চলে আসছি বাসায়। আপনারা চাইলে আমাকে কমেন্টে গালাগালি করতে পারেন ফর নট স্টপিং দ্য থাগস (দুষ্কৃতকারীদের না থামানোর জন্য)! আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করেন আমিন!’

ঘটনা তিন: ৫ ফেব্রুয়ারিতেই দেওয়া আরেকটি পোস্টে শাহারিয়ার পিয়াস বলছেন, ‘চৌরাস্তা, গাজীপুর রাত ৩.

২৪ মিনিট দুই ছিনতাইকারী অটোরিকশা আটকানোর চেষ্টা করে; কিন্তু আমার গাড়ি দেখে দুজন দুদিকে সরে যায়। খেয়াল করলে দেখতে পারবেন তাদের হাতে বড় ধারালো অস্ত্র ছিল।’

পোস্টের সঙ্গে তিনি গাড়ির সামনে লাগানো ক্যামেরায় রেকর্ড করা ভিডিও যুক্ত করেছেন, যেখানে যেখা যাচ্ছে একটি অটোরিকশার দুই পাশ থেকে দুজন দ্রুত সরে যাচ্ছেন। ভিডিওতে তাদের হাতে থাকা লম্বা ধারালো অস্ত্রটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ঘটনা চার: একই দিনে শাহানা পারভীন শিখা একটি ভিডিও পোস্ট করে লিখেছেন, ‘রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী কুতুবখালী দাগু খান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে রাস্তায় রাতের চিত্র।’

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে চারজন যুবক একজন লোককে জবরদস্তি করে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। এ সময় ছিনতাইকারীদের একজনকে চাপাতি হাতে লোকটিতে একটি কোপ দিতেও দেখা যায়।

ঘটনা পাঁচ: মো: রউফুল ইসলাম ৪ ফেব্রুয়ারির একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘সিলেট থেকে লাশ নিয়ে যাওয়ার পথে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে ডাকাতি।’

পোস্টের সঙ্গে দেওয়া ভিডিওতে ডাকাতি–পরবর্তী অবস্থায় বিপর্যস্ত মানুষগুলোকে দেখা যাচ্ছে।

ফেসবুকে এ রকম আরও অনেক গ্রুপের মধ্যে মাত্র একটি গ্রুপের তিন দিনের কয়েকটি পোস্টের চিত্র এটি। পরিসংখ্যানবিদ না হয়েও ধারণা করা যায়, সামগ্রিক চিত্রটি আসলে কতটা ভয়াবহ। একটু খুঁজলেই এমন আরও অনেক উদাহরণ মিলবে। সেই তালিকা দীর্ঘ করা অনাবশ্যক।

এই খণ্ডচিত্র থেকেই আমাদের সড়ক-মহাসড়কের বর্তমান অবস্থাটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের বোঝা না–বোঝায় কিছুই যায়–আসে না। কোনো কালেই, কোনো সরকারের আমলেই তা যায়–আসেনি। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, কতটা আমলে নিচ্ছেন, জননিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় কত নম্বরে…এমন অনেক বিষয়ের ওপরই নির্ভর করছে আমাদের মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর করদাতাদের ভাগ্য।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোতে বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানার কথার জবাবে বলেছেন, সরকার ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোর ডেটা (উপাত্ত) সংগ্রহ করছে। তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা শফিকুল আলমের বক্তব্যে আস্থা রাখতে চাই। আমরা জানতে চাই, সেই উপাত্ত কী বলছে? তার ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? আমাদের জান-মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কে দেবে?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, গত শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে সারা দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। মূলত গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে একটি সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

পরদিনের পত্রিকায় দেখলাম গাজীপুরে ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযানে ৪০ জনকে (রোববার পর্যন্ত সারাদেশে গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ৩০৮ জন) আটক করা হয়েছে। গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) চৌধুরী মো. যাবের সাদেক বলেছেন আটক ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে ফ্যাসিস্ট সরকারের লোক। আমরা চাই ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজনের পাশাপাশি ছিনতাইকারী-সন্ত্রাসীদেরও ধরা হোক, যারা আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে দুঃসহ করে তুলছে।

আগেও আমরা দেখেছি, ছিনতাই-ডাকাতি বা সন্ত্রাসী হামলার মতো বিষয়গুলোকে আমলে না নিয়ে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিতে। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, মানুষের মনের কষ্ট, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাগুলো জানার-বোঝার চেষ্টা করুন। তাদের কথা শুনুন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বিষয় আপনারা আমলে নিয়েছেন, নিচ্ছেন। সেটা পুরস্কার প্রদানই হোক, বা কাউকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর মতো সিদ্ধান্তই হোক। এখন নিরাপত্তাহীন মানুষের শঙ্কার কথাগুলো শুনুন। সরাসরি সম্ভব না হলে অন্তত ফেসবুকে চোখ রাখুন। এটুকুই অনুরোধ।

গোলাম কিবরিয়া গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র আম দ র র একট

এছাড়াও পড়ুন:

সবাই ভেবেছিলেন কিশোরী ডুবে গেছে, ১০ দিন পর ফোন করে জানাল সে গাজীপুরে আছে

১০ দিন আগে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মরা কালিগঙ্গা নদীতে গোসল করতে গিয়েছিল কিশোরী সোহানা খাতুন। বাড়িতে ফিরে না আসায় পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসী তাকে খুঁজতে শুরু করেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নদীতে অভিযান চালিয়েও তার সন্ধান পায়নি। তবে গত বুধবার রাতে মাকে ফোন করেছে সোহানা; জানিয়েছে সে গাজীপুরে প্রাক্তন স্বামীর কাছে আছে।

নিখোঁজ হওয়া কিশোরীর নাম সোহানা খাতুন। তার বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের বাঁশগ্রাম কারিগর পাড়ায়। তার বাবা গোলাম মওলা ও মা শিরিনা খাতুন।

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯ জুলাই দুপুরে বাড়ির পাশের মরা কালিগঙ্গা নদীতে গোসল ও কাপড় ধুতে গিয়েছিল সোহানা। দীর্ঘ সময়েও না ফেরায় তার মা নদীর ধারে যান; দেখেন, সোহানার কাপড় পড়ে আছে। এরপর স্বজন ও এলাকাবাসী তাকে খুঁজতে শুরু করেন। খবর পেয়ে ওই রাতে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল নদীতে উদ্ধার অভিযান চালায়। পরদিন খুলনা ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ১২ ঘণ্টা অভিযান চালিয়েও তার সন্ধান না পেয়ে অভিযান স্থগিত করে। ২১ জুলাই এক কবিরাজ এনে নদীতে খোঁজার চেষ্টাও করেন সোহানার বাবা–মা।

এমন অবস্থায় বুধবার রাতে হঠাৎ সোহানা তার মায়ের ফোনে কল দিয়ে জানায়, সে ঢাকার গাজীপুরে তার প্রাক্তন স্বামীর কাছে রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান সোহানার বাবা গোলাম মওলা। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম, মেয়ে নদীতে ডুবে গেছে। সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি করেছি। এমনকি কবিরাজও এনেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ বুধবার আমার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানায়, সে প্রাক্তন স্বামীর কাছে আছে। আমরা বিষয়টি গতকাল রাতে পুলিশকে জানিয়েছি।’ বিষয়টি বুঝতে না পেরে সবাইকে কষ্ট দেওয়ার জন্য তিনি ক্ষমা চান।

স্থানীয় লোকজন জানান, প্রায় দুই বছর আগে খালাতো ভাই কুতুব উদ্দিনের সঙ্গে পালিয়ে যায় সোহানা এবং দুজন বিয়ে করে। তবে বনিবনা না হওয়ায় তিন মাস আগে সোহানা তাকে তালাক দিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। নদীতে নিখোঁজ হওয়ার ‘নাটক’ করে সে পালিয়ে গেছে।

এ বিষয়ে কুমারখালী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আমিরুল ইসলাম বলেন, শুরুতে পরিবারের লোকজন জানিয়েছিল, নদীতে গোসলে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে সোহানা। গতকাল আবার তার বাবা জানিয়েছে, মেয়ে গাজীপুরে প্রাক্তন স্বামীর কাছে আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ