ঢাকায় তিন দিনের ডিসি সম্মেলন চলছে বলে কয়েক দিন ধরে ডিসিদের খবর সংবাদমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। যে কারণে এ নিবন্ধ লিখতে হচ্ছে, তা হলো, রোববার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, এবারের ডিসি সম্মেলনে তারা আইনি ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। এ জন্য ৬৪ ডিসি এবং ৮ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স লিয়াজোঁ অফিসারের পদ দ্রুত সৃষ্টি করতে বলেছেন তারা, যা নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্ক উঠেছে। 

ডেপুটি কমিশনার বা ডিসিকে বাংলায় বলা হয় জেলা প্রশাসক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে যখন এ পদটি তৈরি হয়, তার নাম ছিল ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর। জেলার কর-খাজনা আদায়ের কাজ দেখভাল করা ছিল তাঁর প্রধান দায়িত্ব। তৎকালীন কৃষিভিত্তিক সমাজে এ পদের খুব গুরুত্ব ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্র যখন অনেকটাই শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর হয়ে উঠেছে, তখন জেলা কালেক্টরের গুরুত্ব আগের মতো থাকার কথা নয়। এই শূন্যতা ভরাট করার লক্ষ্যেই ডিসি হয়ে যান ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক, যদিও ডেপুটি কমিশনারের বাংলা জেলা প্রশাসক হতে পারে না। শুধু তাই নয়, জেলার প্রশাসক হতে গিয়ে ডিসি হয়ে উঠছেন জেলার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এক সময় জেলা পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাকেও পদমর্যাদায় সমান হওয়া সত্ত্বেও ডিসির খবরদারি মানতে হতো। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে নানা কারণে সর্বস্তরে পুলিশের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুলিশকে তা আর করতে হচ্ছে না। কিন্তু জেলা পর্যায়ে অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাকেই ডিসির খবরদারি মানতে হয়। এ নিয়ে শেষোক্তদের মধ্যে অসন্তোষও কম নয়। এর পরও প্রায় প্রতিবছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিরা তাদের ক্ষমতার পরিধি আরও বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন। 

এবারের ডিসি সম্মেলন চব্বিশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এক বিশেষ সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অধিকাংশ জেলার ডিসি পদে পরিবর্তন আসে। নতুন ডিসি নিয়োগ নিয়ে অসন্তোষের জেরে সেপ্টেম্বরে সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। ডিসি পদে কত মধু, এতে বোঝা যায়। 
জেলার নির্বাচন ও অন্যান্য প্রশাসনিক কাজ যেহেতু ডিসির আওতাধীন, সেহেতু জেলা প্রশাসকরাও যে বিগত সরকারের অনেকের ‘অপকর্মে’ সহযোগী ছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। দীর্ঘসময় ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। গত দেড় দশক ডিসিরা এক ধরনের সরকারি দলের নেতার মতো আচরণ করেছেন। ক্ষমতার বলয়ে থাকা ডিসিরা কতটা খেয়ালখুশিমতো প্রশাসন পরিচালনা করতেন, আমার নিজেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে।

কয়েক বছর আগের কথা। তখন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হিসেবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ভাইভা দিতে গেলাম। তখন চাঁদপুরে জেলা প্রশাসক ছিলেন মাজেদুর রহমান খান। তিনি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বোর্ড গঠন করলেন পাঁচ-ছয়জনের। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমরা যারা সাক্ষাৎকারপ্রার্থী ছিলাম, দেখলাম একজন একজন করে না নিয়ে ১০-১২ জনের একটা গ্রুপ করে ডাকছেন। আমাদের গ্রুপে সম্ভবত ১০ জন ছিলেন। এর মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়েই ছিলেন। ডিসি সাহেব বোর্ড-প্রধান। সবাই একসঙ্গে সালাম দিয়ে প্রবেশ করলাম। সবার উদ্দেশে বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন করছেন, উত্তরও সবাই একসঙ্গে দিয়েছেন। আবার ল্যাপটপে গানের কয়েক কলি ছেড়ে বলা হলো, পরের কলি কী, কে গেয়েছেন এই গান। সবাই একসঙ্গে উত্তর দিলাম। এভাবে কিছুক্ষণ থেকে আমাদের সবার একসঙ্গে ভাইভা শেষ। ডিসির সে ভাইভায় আমি উত্তীর্ণ হতে পারিনি। সম্মিলিতভাবে সাক্ষাৎকার নিয়ে কীরূপে তিনি প্রার্থী বাছাই করলেন, আমার জানা নেই।
ডিসিদের ক্ষমতার বলয়ে এটা সামান্য ঘটনাই বলা চলে। কারণ জেলার অন্য প্রায় সবার ওপরেই ছড়ি ঘোরান। এমনকি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাদের দ্বন্দ্বের কথা আমরা জানি। তাদের ক্ষমতার কাছে অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও অসহায়। অথচ সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই প্রাধান্য থাকার কথা। তা ছাড়া ডিসিরা প্রশাসন ক্যাডারের হওয়ায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্যাডারের ওপরেও সহজে কর্তৃত্ব ফলান। যে কারণে মাঠ পর্যায়ের অন্যান্য সরকারি দপ্তরে তাদের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ বিরাজমান।

যেখানে ডিসিদের ক্ষমতা সমপর্যায়ের, অন্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মর্যাদার সঙ্গে সমন্বয় করা দরকার, সেখানে ডিসিদের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানোর প্রবণতা অগ্রহণযোগ্য। এ কারণেই সেখানে সংস্কার জরুরি। আমরা দেখেছি, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে ‘জেলা প্রশাসক’ পদবি পরিবর্তন করে ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কমিশনার’ করার সুপারিশ করেছেন। সেই সংস্কার কতটা বাস্তবায়ন হয়– নিশ্চয় দেখার বিষয়। এ সরকারের অল্প সময়ে বাস্তবায়ন নিশ্চয় কঠিন। সে জন্য রাজনীতিকদের ঐকমত্য দরকার। কিন্তু আরও জরুরি, ডিসিদের মানসিকতার পরিবর্তন। সাংববিধানিকভাবে সব সরকারি চাকরিজীবীই জনগণের সেবক। জেলা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে জনসেবার মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অন্য ক্যাডারের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখাও দরকার। বর্তমানে ডিসিদের হাতে যে ক্ষমতা আছে, তা ব্যবহার করে তিনি চাইলে জেলায় ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন আনতে পারেন।

তিন দিনের ডিসি সম্মেলন রোববার উদ্বোধন করেছেন প্রধান উদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূস। উদ্বোধন অনুষ্ঠানেই তিনি পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন তথা যাচাই বন্ধের ঘোষণা দেন। জেলার পাসপোর্টও ডিসিরাই তদারকি করেন। এভাবে নাগরিক হয়রানির যেসব উপলক্ষ আছে, সেগুলো বন্ধে ডিসিরা উদ্যোগী হতে পারেন। সচিবালয়ে থাকা সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তার চেয়ে জেলা প্রশাসকের সরাসরি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়। সে জন্য ডিসিদের সদিচ্ছা থাকলে সাধারণ মানুষকে প্রশাসনিক জটিলতা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করা সম্ভব। ডিসি সম্মেলনে সুপারিশের ক্ষেত্রে এ বিষয় প্রাধান্য পেলে মানুষ উপকৃত হতে পারে।

মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ র ক ষমত র অন য ন য সরক র র একসঙ গ কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের কিস্তির প্রস্তাব উঠছে আইএমএফ পর্ষদে

আগামী ২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের সভায় বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ ও পঞ্চম দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের প্রস্তাব উঠছে। সভায় অনুমোদন হলে একসঙ্গে দুই কিস্তির ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ শুক্রবার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের সভার এ তারিখ নির্ধারণের তথ্য প্রকাশ করেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ পর্ষদের বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির পর্যালোচনা প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে।

বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা দিতে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে।

২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ২৩৯ কোটি ডলার।

আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও শর্ত পরিপালন নিয়ে বিশেষত টাকা–ডলার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া নিয়ে  জটিলতা তৈরি হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল শর্ত পালনের অগ্রগতি পর্যালোচনায় ঢাকায় আসে। তবে সমঝোতা না হওয়ায় চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হয়।

সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতা হয় এবং বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং পর্ষদ সভার অনুমোদন সাপেক্ষে ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৭৬ কোটি ডলার বাড়তি ঋণ চেয়েছে। বাড়তি ঋণ যোগ হলে মোট দাঁড়াবে ৫৪০ কোটি ডলার। বিবৃতিতে বিনিময় হার, রাজস্ব আদায়, ব্যাংক খাতসহ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুই বাংলাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে: জয়া আহসান
  • জামের সঙ্গে খাবেন না যেসব খাবার
  • তদন্ত প্রতিবেদন দিতে এক মাস সময় বাড়ালেন ট্রাইব্যুনাল
  • কেন এবার একসঙ্গে পেকে যাচ্ছে ক্ষিরশাপাতি, আম্রপালি, ল্যাংড়া
  • শরীরের পাঁচ থেকে সাতটি অঙ্গ একসঙ্গে ব্যথা হয় যে কারণে
  • বাবাকে একটি সুন্দর দিন উপহার দিতে যা যা করতে পারেন
  • ফেনীতে একসঙ্গে তিন সন্তানের জন্ম দিলেন গৃহবধূ 
  • আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের কিস্তির প্রস্তাব উঠছে আইএমএফ পর্ষদে
  • এবার বাগ্‌দানের কথা নিজেই জানালেন ডুয়া
  • দেশের ক্রিকেট নিয়ে সাকিবের সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে মিরাজের