বানজারা কন্যা মোনালিসার জীবনে নতুন মোড়, বৈষম্য জয় করে দেখালেন আলোর পথ
Published: 17th, February 2025 GMT
বানজারা সম্প্রদায়ের কন্যা মোনালিসা। পড়ালেখা শেখেননি। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন ফুুলের মালা। কিন্তু একটা কুম্ভমেলা জীবন বদলে দিল মোনালিসার। ভারতের উত্তরপ্রদেশের কুম্ভমেলায় ফুলের মালা বিক্রি করা এই তরুণী পরিচিতি লাভ করেন ‘মহাকুম্ভ ভাইরাল গার্ল’ হিসেবে। কোন এক নেটিজেনের ক্যামেরায় নজর কাড়ে মোনালিসার মোহময় বাদামি চোখ। এরপর থেকে গ্ল্যামার দুনিয়া হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। সম্প্রতি চলচ্চিত্র পরিচালক সানোজ মিশ্র তাকে ‘দ্য ডায়রি অব মণিপুর’ সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। এখন তার জীবনের সংগ্রাম ও সাফল্য নতুন করে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
এমনকি বানজারা বা বেদে সম্প্রদায়ের মেয়েটি ভাবতেও পারেনি তার জীবনের গল্প একদিন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং এই যাত্রা শুধু তার নিজের নয়, বরং আধুনিক যুগে উপেক্ষিত ও নিপীড়িতদের জন্য এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
মোনালিসার জন্ম হয়েছিল ভারতের অন্যতম প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বানজারা সম্প্রদায়ের এক পরিত্যক্ত প্রান্তিক গ্রামে। তার পরিবার ছিল বেদে সম্প্রদায়ের, যাদের ইতিহাস অনেকটাই অন্ধকার। সমাজের মূলধারা তাদের সবসময় অস্বীকার করেছে। তারা ইতিহাসের পাতায় কখনো স্বীকৃতি পায়নি, বরং উপেক্ষিত ও নিপীড়িত থেকেছে। তাদের জীবন দীর্ঘদিন ধরে দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং সামাজিক বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে।
এই সম্প্রদায় একসময় ব্যবসা ও পরিবহন কাজে নিয়োজিত ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ১৮৭১ সালের ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট-এর আওতায় তাদের "অপরাধী জনগোষ্ঠী" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই সময় থেকে সমাজের মূলধারা তাদের দূরে ঠেলে দেয়, এবং দারিদ্র্যই তাদের জীবনের একমাত্র বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। দারিদ্র্য, শিক্ষা ও মৌলিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ এখনো জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
মোনালিসা ছোটবেলায় দেখেছিল তার পরিবারকে দারিদ্র্যের শিকার হয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে। তাদের দিন কাটতো ভিখারি বা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে। এসবের মধ্যে, পড়াশোনার কোনো স্থান ছিল না। তবে মোনালিসা অন্যরকম ছিল। সে জানত, সে অন্য সবার মতো হতে চায় না। তার চোখে ছিল এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন।
এ বছর মহাকুম্ভ মেলায় মোনালিসা ফুল বিক্রি করতে গিয়েছিল। তার গভীর নীল চোখ এবং স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলতে থাকা ব্যক্তিত্ব সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু তার সুন্দর চেহারা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও, তার পরিচয় জানার পর অনেকেই তার কাছ থেকে মালা কিনতে চাইতেন না। তার সম্প্রদায়ের প্রতি সমাজের নেতিবাচক মনোভাব তাকে বারবার অপমানিত করেছে। কিন্তু এই রকম কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও মেয়েটি হাল ছাড়েননি।
একদিন হঠাৎ পরিচালক সানোজ মিশ্রের সঙ্গে দেখা হয় তার। সিনেমা নির্মাতা মিশ্র তার মধ্যে এক বিশেষ কিছু দেখতে পেলেন। মোনালিসা যে এক অনন্য সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। সেই মুহূর্তেই একটি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ দিলেন। শুধু তার সৌন্দর্যের কারণে নয়, বরং তার আত্মবিশ্বাস এবং সংগ্রামী মানসিকতার জন্যই তিনি মোনালিসাকে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মিশ্র তাকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
মিশ্র তাকে অক্ষর শেখানো শুরু করলেন। একদিন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, মিশ্র তাকে অক্ষর শেখাচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে তিনি লিখতে ও পড়তে শিখছেন। ভিডিওটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এই ভিডিওটি দেখে অনেকেই তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহের প্রশংসা করেছেন। এই সেই মোনালিসা, যার জীবন ছিল খুব কঠিন, এখন এক নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিলেন। তার সংগ্রাম, তার শিক্ষা এবং তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সারা দেশে আলোচিত হতে লাগল।
আজ, মোনালিসা শুধু মহাকুম্ভ মেলার "ফুল বিক্রেতা" হিসেবে পরিচিত নয়। তিনি হয়ে উঠেছেন একটি প্রতীক, যা কঠিন পরিস্থিতি, দারিদ্র্য, এবং বৈষম্যের মধ্যেও সম্ভব। মোনালিসা শিখিয়েছে যে, জীবনে যদি সঠিক সুযোগ এবং সহায়তা পাওয়া যায়, তাহলে জীবনের এক একটি অধ্যায় বদলে যেতে পারে। সে এখন একজন অভিনেত্রী, একজন শিক্ষার্থী, এবং সবচেয়ে বড় কথা, সে একটি অনুপ্রেরণা। তার জীবনের গল্প শুধু তার নিজের নয়, বরং সকল প্রান্তিক মানুষের জন্য এক নতুন আশার বাতিঘর হয়ে উঠেছে।
মোনালিসার জীবনের সংগ্রাম অনেকাংশে মিল পাওয়া যায় বিশিষ্ট লেখক লক্ষ্মণ গায়কোয়াড়ের সঙ্গে, যিনি বানজারা সম্প্রদায়ের প্রথম শিক্ষিত ব্যক্তিদের একজন। তার আত্মজীবনীমূলক বই "উচ্ছক্কা"-তে তিনি তার জীবনসংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, কীভাবে তার পরিবার ও সমাজ শিক্ষাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করত। ছোটবেলায় তিনি স্কুলে যেতে শুরু করলে তার সম্প্রদায়ের মানুষ তাকে অপয়া বলত। তবে গায়কোয়াড় সব প্রতিকূলতা জয় করে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে লেখক ও সমাজকর্মী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তার বই "উচ্ছক্কা" আজ ভারতের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং অনেক প্রান্তিক মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মোনালিসা শুধু নিজের জীবনের পরিবর্তন নয়, বরং সমগ্র বানজারা সম্প্রদায়ের জন্য এক নতুন আশার আলো। তার ভাইরাল হওয়া শুধু তার সৌন্দর্যের কারণে নয়, বরং তার সংগ্রামী জীবনের কারণে মানুষ তাকে গ্রহণ করছে। তার শিক্ষা ও অভিনয়ের পথে যাত্রা আবারও প্রমাণ করে কারো জীবন বদলে দিতে একটি সুযোগ এবং একটি সহানুভূতিশীল হাত যথেষ্ট।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার গল্প ছড়িয়ে পড়ার ফলে অনেকেই এখন বানজারা সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। মোনালিসার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় সমাজে যারা উপেক্ষিত, তাদের মধ্যে অজস্র প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। তার সংগ্রাম, তার অভ্যন্তরীণ শক্তি, এবং তার শিক্ষা-ভিত্তিক পরিবর্তন একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। আজকের মোনালিসা আর ফুল বিক্রেতা নয়। সে এখন একটি নতুন সম্ভাবনার প্রতীক। তার গল্প একদিন পরিণত হবে অন্যদের জীবন পরিবর্তনকারী গল্পে।
এটি শুধু মোনালিসার গল্প নয়, এটি শিক্ষার শক্তি, আত্মবিশ্বাসের জয়, এবং মানবতার রূপান্তরের গল্প। এই কাহিনী প্রমাণ করে দেয় জীবনে পরিবর্তন আনতে যদি সঠিক সুযোগ ও সহায়তা দেওয়া হয়, তবে একেকটি জীবন হয়ে উঠতে পারে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর গল্প।
তাই মোনালিসার নাম আজ একটি পরিচিত নাম। তার সংগ্রামের এই নতুন অধ্যায় অনেকের জীবনে নতুন আলো নিয়ে এসেছে। তার কাহিনী এক জীবন্ত প্রমাণ যে, যে কোনো পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব, যদি সাথে থাকে সঠিক পথপ্রদর্শক। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা পেলে, বানজারা সম্প্রদায়ের শিশুরাও শিক্ষিত হয়ে উন্নত ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ বন র স ত র জ বন র জ বন র স ন দর র পর ব ত র পর র জন য একদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
গুম করা হতো তিনটি ধাপে
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিদের কীভাবে গুম করা হতো, সেটি গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কমিশন বলেছে, ‘তিন স্তরের পিরামিড’–এর মাধ্যমে গুমের বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হতো।
এই পিরামিডের সর্বোচ্চ স্তরে ছিল ‘কৌশলগত নেতৃত্ব’। যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ছিলেন।
পিরামিডের দ্বিতীয় স্তরে ছিলেন বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। আর পিরামিডের তৃতীয় স্তরে থাকা বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশনের কাছে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।
আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থায় গত সাড়ে ১৫ বছরে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যেখানে গুমের ঘটনায় নীরব সম্মতি থাকার বিষয়টি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছিল বিষয়টি (গুমের মতো গুরুতর অপরাধেও নীরব থাকা)। গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি তখন অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো না।
■ গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে ১,৮৫০ অভিযোগ এসেছে। ■ যাচাই-বাছাই হয়েছে ১,৩৫০টি। ■ এখনো নিখোঁজ ৩৪৫ জন।গুমের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার মধ্যে নীরবতা কেন ছিল, তা খুঁজেছে কমিশন। এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে তখন বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার ভেতরে বিষয়টি (গুম) অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো না। বরং সেগুলোকে হয়তো একটি বৃহত্তর অভিযানের অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে, যা বাহিনীর অভ্যন্তরে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ এবং ‘জনশৃঙ্খলা রক্ষার’ প্রয়োজনে স্বাভাবিক ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এসব কাজকে বিচ্যুতি নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের নির্দেশ অনুযায়ী নিয়মিত দায়িত্ব হিসেবেই পালন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত একজন কর্মকর্তার নথিতে তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের (পরে পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে অবসরে যান, এখন পলাতক) মূল্যায়ন ছিল, ওই কর্মকর্তা কর্মদক্ষতার দিক থেকে ‘খুবই সন্তোষজনক’ এবং তাঁর নেতৃত্বগুণ ‘উচ্চমানের’।
ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে বেনজীর আরও লিখেছিলেন, তিনি ‘ভদ্র’, ‘সৎ স্বভাবের’ এবং ‘অত্যন্ত দক্ষ’। ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে নথিতে কোনো নেতিবাচক তথ্য লেখা হয়নি। যদিও তিনি গুমের ঘটনায় জড়িত ছিলেন।
অবশ্য অন্য একজন কর্মকর্তার বিষয়ে নথিতে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অনেক অভিযোগ লেখা আছে। এমনকি সেখানে বিস্তারিতভাবে বলা আছে, ওই কর্মকর্তা নিয়মিতভাবে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন পরিচালক জিয়াউল আহসানের (পরে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার বা এনটিএমসির মহাপরিচালক হন, এখন কারাগারে) কাছে ‘ফিশ থেরাপি’ (মাছ উপহার) পাঠাতেন। তবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে তাঁর জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো তথ্য নথিতে উল্লেখ নেই।
গণ–অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে। এই কমিশনকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনাগুলো তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ (সত্য উন্মোচন) শীর্ষক প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। সেখানে গত ১৫ বছরে সংঘটিত বিভিন্ন গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।
কমিশনের প্রতিবেদনে একটি বন্দিশালায় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করা একজনের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। বন্দিশালায় প্রথম গিয়ে ওই প্রহরী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘বন্দীদের সাথে কখনো স্বাভাবিক আচরণ করা যাবে না, যেটা স্বাভাবিক মানুষের সাথে করা হয়। তাদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে, সব অধিকার থেকে। যাতে সে কষ্ট অনুভব করতে পারে।’
ওই প্রহরী কমিশনকে বলেছেন, বন্দিশালার দায়িত্ব থেকে তিনি অব্যাহতি চেয়েছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয়েছিল, দায়িত্ব পালন না করলে তাঁর প্রাণের ঝুঁকি আছে।
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে গুমগত ৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুমে জড়িত ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনই ডিজিএফআইয়ের (প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর) সাবেক মহাপরিচালক এবং একজন সাবেক পরিচালক। তাঁরা হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদীন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী, মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদ-উল-ইসলাম।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ছয় কর্মকর্তা যখন ডিজিএফআইয়ের উচ্চ পদে ছিলেন, তখন সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও হাসিনুর রহমান এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান গোপন বন্দিশালায় আটক ছিলেন।
মেজর জেনারেল পদমর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তা গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে স্বীকার করেছেন, তিনি যখন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিটিআইবি) পরিচালক ছিলেন, তখন আমান আযমীর গুমের বিষয়ে তিনি সাইফুল আলম ও আহমেদ তাবরেজ শামসকে জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া ডিজিএফআইয়ের একজন কর্মকর্তা কমিশনকে বলেছেন, আমান আযমী ও মাইকেল চাকমাকে গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা ডিজিএফআইয়ের অন্তত তিনজন কর্মকর্তা গত নভেম্বর পর্যন্ত পিআরএলে (অবসরোত্তর ছুটি) ছিলেন। তাঁরা তখনো সেনা আইনের অধীন ছিলেন। বিশেষ করে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাঁদের সেনাবাহিনীর অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ত। এখন তাঁদের হদিস নেই।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা সমন্বিতভাবে অন্যায় নির্দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। কারণ, কর্মকর্তারা অন্যায় আদেশ মানতে বাধ্য নন। এই নীতির কথা সবাই জানতেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কর্তব্যে চরম অবহেলা ছিল। তাঁরা অধস্তনদের দিকনির্দেশনা বা মানসিক সহায়তার কোনো উদ্যোগ নেননি।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ন্যায়সংগত আদেশ পালন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে কোনো অন্যায় আদেশ পালনে কেউ বাধ্য নন। গুম–খুনের আদেশ যাঁরা বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁদের বিচক্ষণতার অভাব রয়েছে। এসব অন্যায় আদেশ বাস্তবায়ন করা তাঁদের দায়িত্ব নয়, সেটি তাঁরা অনুধাবন করতে পারেননি। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল।