আমাদের সুলতানারা স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্ন দেখাচ্ছে
Published: 20th, February 2025 GMT
সোয়া শ বছর আগে বেগম রোকেয়া তাঁর একটি স্বপ্নের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন সুলতানা’স ড্রিম গ্রন্থে। সুলতানা নামের আড়ালে বেগম রোকেয়া নারীস্থান নামের একটি দেশের গল্প বলেছেন, যেখানে দেশ চালায় নারী, ঘর সামলায় পুরুষ। সেখানে কোনো যুদ্ধ নেই, কোনো দ্বন্দ্ব নেই। নারীরা সেখানে উড়ন্ত গাড়ি চালায়, সূর্যতাপে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
না, নারীস্থান নামের কোনো দেশ নেই। আজও অধিকাংশ নারী গৃহবন্দী। কিন্তু মুক্ত হওয়ার, সমতা অর্জনের যে স্বপ্ন বেগম রোকেয়া সোয়া শ বছর আগে দেখেছিলেন, তা এখনো দীপ্যমান। সম্প্রতি বাংলাদেশের পাঁচজন মেয়ে দল বেঁধে হিমালয়ের চূড়াদেশ জয় করে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা গেঁথে রেখে এসেছে। এটিই শীতকালে হিমালয়ের দুর্গম লাংটাং শৃঙ্গে দলবদ্ধ নারী আরোহীদের প্রথম সফল অভিযান। এই পাঁচজন এক অসম্ভবকে সম্ভব করে জানিয়েছে, ‘বেগম রোকেয়ার শিক্ষা আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে মেয়েদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা হয় না। সুলতানার স্বপ্নই আমাকে হিমালয় অভিযানের প্রেরণা জুগিয়েছে।’ হিমালয় বিজয় শেষে কাঠমান্ডুতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাঁচজনের পক্ষে এ কথা জানিয়েছে ইয়াসিম লিসা।
২০২৪ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনেসকো সুলতানা’স ড্রিমকে ‘বিশ্বস্মৃতি নিবন্ধন’–এ (ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি রেজিস্ট্রার) অন্তর্ভুক্ত করে। সে সময় সংস্থাটি জানিয়েছিল, ১০০ বছর আগে লেখা হলেও যে নারীস্থান রোকেয়া কল্পনা করেছিলেন, তার অনেক কিছুই এখন বাস্তব। সৌরবিদ্যুৎ এখন ঘরে ঘরে। বিমানে চড়ে আমরা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে উড়ে বেড়াচ্ছি।
কিন্তু যা এখনো বাস্তব নয় তা হলো, নারীর সমতা। বিশ্বে তেমন দেশের সংখ্যাই বেশি, যেখানে নারী নয়, ক্ষমতার কেন্দ্রে পুরুষ। শুধু তা–ই নয়, পুরুষদের চেষ্টা যেভাবে সম্ভব মেয়েদের ঘরে আটকে রাখা। দুই হাজার বছর আগে এথেন্সের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রশাসনে নারীর কোনো ভূমিকা ছিল না। এই একুশ শতকে এসে নারীরা ভোটাধিকার পেয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতাও অর্জন করেছে। কিন্তু তাদের অধিকার সংকোচনের চেষ্টার শেষ নেই। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের চলতি রক্ষণশীল রিপাবলিকান নেতৃত্ব পারিবারিক মূল্যবোধের দোহাই দিয়ে নারীর গর্ভপাতের অধিকার রদ করেছে। যুক্তি তুলে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছেন, নারীদের স্থান বাইরে নয়, ঘরে। তাদের প্রধান কাজ সন্তান উপহার দেওয়া।
বস্তুত নারীর অধিকারের ব্যাপারে পৃথিবীর কমবেশি সব দেশেই অধিকাংশ পুরুষের এক যুক্তি, মেয়েদের স্থান ঘরে (অর্থাৎ হেঁশেলে)। যে পাঁচ বাঙালি মেয়ে হিমালয় জয় করলেন, তাঁদের একজনের নাম সুলতানা রেখা। রেখা বলেছেন, ‘আমরা হিমালয় জয়ে যাচ্ছি শুনে অনেকে বলেছে, পাহাড় জয় করে কী হবে! মেয়েদের এমন কাজ করতে হবে কেন?’
লক্ষ করুন, যে কথা জেডি ভ্যান্সের, সেই একই কথা বাংলাদেশের অসংখ্য পুরুষেরও। সম্প্রতি জয়পুরহাটে মেয়েদের দুটি ফুটবল দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল, তা নিয়ে কী তুলকালাম কাণ্ড! এক পক্ষের আপত্তি ও হট্টগোলের কারণে মেয়েদের খেলাটি পণ্ড হয়ে যায়। পরে চারদিকে আপত্তি উঠলে পুলিশি পাহারা বসিয়ে আবার খেলাটি আয়োজন করা হয়।
ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দু–একটি দেশ বাদ দিলে পৃথিবীর সব দেশেই ক্ষমতার কেন্দ্রে পুরুষদের আধিপত্য। সবার এক যুক্তি, মেয়েদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিলে মহা অনাচার হবে। নীতিনিষ্ঠা সব গোল্লায় যাবে। অথচ বাস্তবে ছবিটা কিন্তু উল্টো। শিক্ষাক্ষেত্রে বলুন, রাজনীতি বা ব্যবসার কথা বলুন, মেয়েদের যখনই সুযোগ দেওয়া হয়েছে, পুরুষের চেয়ে অনেক ভালো ফল দেখিয়েছে তারা। সব প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে মেয়েরা এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষায় এগিয়ে। বাংলাদেশে ২০২৩ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায়
মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে পাসের হারে ও জিপিএ–৫ পাওয়ায় এগিয়ে।
একই অবস্থা যুক্তরাজ্যে। একদম প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যন্ত সেখানে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা এগিয়ে। বিষয়টা ব্রিটিশদের এতটাই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে যে গত বছর সে দেশের পার্লামেন্টে এমপিরা ছেলেরা কেন পিছিয়ে, এ ব্যাপারে সরকারকে রীতিমতো জেরা করেন। পুরুষেরা চাক বা না চাক, মেয়েরা এগোচ্ছে। কিন্তু তাদের টেনে নামানোর চেষ্টার অন্ত নেই। অগ্রসর দেশের উদাহরণ হিসেবে আমরা আগে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেছি। এই স্পেকট্রামের অন্য প্রান্তে আফগানিস্তান। সেখানে নতুন আইন হয়েছে, যাতে মেয়েদের প্রাথমিক পর্যায়ের পর স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চাকরি করার তো প্রশ্নই উঠছে না, বাইরে বের হওয়াও বারণ।
রংপুরে বেগম রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। দাবি উঠেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলাতে হবে। কারণটা বোঝা কঠিন নয়। একটি রাজনৈতিক দল দাবি করেছে, রাষ্ট্রের বা সরকারের প্রধান হিসেবে নারীকে তারা গ্রহণ করবে না।
এ ধরনের নানা বাধা আছে ঠিকই, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মেয়েরা এগিয়েছে, এগোচ্ছে। নানা ক্ষেত্রে তারা সাফল্য পেয়েছে সব উপেক্ষা গায়ে না মেখে। যেমন ক্রিকেটে ও ফুটবলে তারা আন্তর্জাতিক শিরোপা পেয়েছে। গত বছর মেয়েরা প্রথমবার সাফ ফুটবলে শিরোপা জেতার সময় দলের ফাইনাল খেলা দেখতে ফুটবল বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা মাঠে যাওয়ার প্রয়োজনটুকু পর্যন্ত দেখেননি। সে অবজ্ঞা উপেক্ষা করে মেয়েরা কিন্তু ঠিকই জয় ছিনিয়ে এনেছে। সুযোগ পেলে আরও কত জয়–ই না তারা অর্জন করবে।
যে হিমালয় অভিযানে বাংলাদেশের পাঁচ নারী অংশ নেয়, সেটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সুলতানা’স ড্রিমস আনবাউন্ড’ বা ‘সুলতানার বন্ধনহীন স্বপ্ন’। এই পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী মেয়েটির নাম অর্পিতা দেবনাথ। কাঠমান্ডুতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সে বলেছে, ‘এই অভিযানের আগে আমি বড় কোনো লক্ষ্য অর্জনের কথা ভাবতে পারতাম না; কিন্তু এখন আমার লক্ষ্য অবাধ, বন্ধনহীন।’
আমাদের সুলতানারা স্বপ্ন দেখছে। সুযোগ পেলে তারা ঠিক আকাশ ছোঁবে। তাদের উড়তে দিন।
● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব গম র ক য় ফ টবল ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।