ভাষাশহীদদের প্রতি আমরা কতটুকু শ্রদ্ধাশীল?
Published: 21st, February 2025 GMT
পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার নিজস্ব একটি স্বকীয়তা আছে। ভাষার মধ্যদিয়ে একটি জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। অনেক শব্দ আছে যেগুলোর ইংরেজি বানান একইরকম হলেও ভৌগোলিক অবস্থান বা উৎপত্তিগত কারণে উচ্চারণগত বা আবেদনগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
এবার সে রকম একটি শব্দ নিয়ে আলোচনা করা যাক। যেমন- ‘পদ্মা’, যার ইংরেজি ‘Padma’। পদ্মা একটি সংস্কৃত শব্দ এবং এর উচ্চারণ হলো পদ্- দাঁ। কেউ যদি ‘Padma’ এর উচ্চারণ করে পদ্-মা তাহলে তা আমাদের শুনতে অত্যন্ত শ্রুতিকটু লাগে। আরেকটি শব্দ যেমন একটি ফুটবল ক্লাব নিয়ে বলা যেতে পারে ‘Real Madrid’। এর স্বাভাবিক উচ্চারণ যদি আমরা বলি ‘রিয়াল মাদ্রিদ’, তাহলে আপাতত মনে হবে ঠিক আছে। কিন্তু তা না, ‘Real’ একটি স্প্যানিশ শব্দ, যেটি দ্বারা বোঝানো হয় ‘Royal’ এবং এর উচ্চারণ হলো রেয়াল। আমরা রেয়াল না বলে রিয়েল বললে তাদের কাছেও শ্রুতিকটু লাগে। তাই ভাষার প্রমিত উচ্চারণ না করলে ভাষার মাধুর্য হারিয়ে যায় এবং শুনতেও খুব বিদখুটে লাগে। আমরা আমাদের ভাষার বিষয়ে অনেকাংশেই সচেতন নই। তাই যারা জানেন তাদের সামনে ভুল উচ্চারিত হলে বিব্রত অনুভূত হয়।
১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে বা ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলার মানুষ নিবেদিত চিত্তে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, অথচ আমরা এই ভাষা ব্যবহারে সচেতন নই। ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও আমরা ভাষার প্রতি কতটুকু যত্নশীল তা কিছু শব্দের উচ্চারণের দিকে লক্ষ্য করলেই উপলব্ধি করতে পারব। বহুল প্রচলিত একটি শব্দ ‘মাতৃভাষা’, যা অনেকে উচ্চারণ করেন মাত্-তৃ-ভাশা, যা ভুল। কারণ ঋ-কার যুক্ত ব্যঞ্জন কখনও দিত্ব উচ্চারণ হয় না। তাই উচ্চারণটি হবে মা-তৃ-ভাশা। অনুরূপ মাতৃত্ব-এর উচ্চারণ মাত্-তৃত্-তো না হয়ে হবে মা-তৃত্-তো, নেতৃত্ব এর উচ্চারণ নেত্-তৃত্-তো না হয়ে হবে নে-তৃত্-তো। ‘আবৃত্তি’ এর প্রমিত উচ্চারণ আ-বৃত্-তি। ওপরের নিয়ম এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে।
ভয়ংকর একটি বিষয় হলো উচ্চারণ প্রমিত না হলে অর্থের পরিবর্তন ঘটে যায়। যেমন- বিকৃত একটি শব্দ, এর উচ্চারণ বি-কৃ-তো। আমরা অনেকে উচ্চারণ করছি বিক্-ক্রি-তো যার অর্থ হয়ে যায় বিক্রয় করা হয়েছে। আবার নিত্য একটি শব্দ, এর উচ্চারণ নিত্-তো এবং এর অর্থ হলো প্রত্যহ। আরেকটি শব্দ ‘নৃত্য’ এর উচ্চারণ হলো নৃত্-তো এবং এর অর্থ হলো নাচ। কিন্তু আমরা ‘নৃত্য পরিবেশন’ উচ্চারণ করি নিত্-তো পো-রি-বে-শন্ যার অর্থ হয়ে যায় প্রত্যহ পরিবেশন।
সতর্ক না হওয়ার কারণে আমরা কি বলছি একবারও কি চিন্তা করছি! প্রায়ই আমরা শব্দের ভুল উচ্চারণ করি। যেমন– আহ্বান কে আমরা আহ্-বান উচ্চারণ করি, জিহ্বা কে আমরা জিহ্-বা উচ্চারণ করি, যা ভুল। কারণ শব্দের আদিতে অ বা আ উচ্চারিত হলে এবং উক্ত শব্দে হ এর সাথে ব-ফলা যুক্ত থাকলে সেই হ এর পরিবর্তে ও এবং ব এর পরিবর্তে ভ উচ্চারিত হয়। তাই আহ্বান এর উচ্চারণ হবে আও্-ভান্, গহ্বর এর উচ্চারণ হবে গও্-ভর্। তবে শব্দের আদিতে ই উচ্চারিত হলে হ এর পরিবর্তে উ এবং ব এর পরিবর্তে ভ উচ্চারিত হবে। তাই জিহ্বা-এর উচ্চারণ হবে জিউ্-ভা এবং বিহ্বল-এর উচ্চারণ হবে বিউ্-ভল্।
দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে? তাহলে আরও সহজ ও প্রচলিত শব্দ নিয়ে বলা যাক। কেউ কেউ মজার ছলে বলেন, বাংলা ভাষা আহত হয়েছে চট্টগ্রাম, আর নিহত হয়েছে সিলেটে। চট্টগ্রাম ও সিলেট ঠিক উচ্চারণ করলেও ঝামেলা করে ফেলি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর ও আমের নগরী রাজশাহী উচ্চারণে। অবচেতন মনে রাজ্-শাহিকে আমরা উচ্চারণ করি রাশ্-শাহি তাই নয় কি? হায়রে কত ভুল আমরা নিজেরাই জানি না! ভাষার প্রমিত উচ্চারণের জন্য আরেকটি বিষয় জানা দরকার তা হলো ধ্বনি ও বর্ণের পার্থক্য। ব্যঞ্জন বর্ণ ৩৯টি হলেও ব্যঞ্জন ধ্বনি কিন্তু ৩৯টি নয়, মাত্র ৩১টি। অর্থাৎ ৮টি বর্ণ আছে যাদের কোন নিজস্ব উচ্চারণ বা ধ্বনি নেই। যেমন–‘ঃ’ বিসর্গ একটি বর্ণ এটি ধ্বনি নয়। এটি শব্দের শেষে বসলে এর উচ্চারণ হয় ‘হ’, আর মাঝখানে বসলে পরবর্তী ব্যঞ্জন দিত্ব হয়। বাঃ-এর উচ্চারণ বাহ্, আঃ-এর উচ্চারণ আহ্। অতঃপর-এর উচ্চারণ অতো-পর না হয়ে হবে অতোপ্-পর্, মনঃকষ্ট-এর উচ্চারণ মনো-কশ্-টো না হয়ে হবে মনোক্-কশ্-টো।
আবার আমরা জানি ব্যঞ্জনবর্ণে ফলা ছয়টি। এই ছয়টি ফলা শব্দের অবস্থান অনুসারে, কখনও উচ্চারিত হয় কখনও হয় না, আবার কখনও যুক্ত ব্যঞ্জনের দিত্ব উচ্চারণ হয়। যেমন- স্বাধীন-এর উচ্চারণ শা-ধিন্, শ্মশান-এর উচ্চারণ শ-শান্। কিন্তু ব-ফলা ও র-ফলা মাঝখানে থাকলে দিত্ব হয়। অদ্বিতীয়-এর উচ্চারণ অ-দি-তি-য়ো না হয়ে হবে অদ্-দি-তি-য়ো, দেশপ্রেম-এর উচ্চারণ দেশ্-প্রেম না হয়ে হবে দেশোপ্-প্রেম্। একত্রিশ-এর উচ্চারণ এক-ত্রিশ না হয়ে হবে একোত্-ত্রিশ্। খটকা লাগছে? তাহলে পরিচিত শব্দ বলি- বিদ্রোহ। এর উচ্চারণ কি বি-দ্রো-হো নাকি বিদ্-দ্রো-হো সবাই জানেন বিদ্-দ্রো-হো কারণ এখানে মাঝখানে র-ফলা আছে, যার কারণে দিত্ব হয়েছে।
হ-এর সাথে ন/ণ যুক্ত হলে আমরা তখনও উচ্চারণে ভুল করি। হ-এর সাথে ন/ণ যুক্ত হলে আমরা অনেকে হ-কে বিলুপ্ত করে দিয়ে ন-এর দিত্ব উচ্চারণ করি। যেমন- চিহ্ন-এর উচ্চারণ করি চিন্-নো, অপরাহ্ণ-এর উচ্চারণ করি অপ-রান্-নো। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না হ-এর সাথে ন/ণ যুক্ত হলে কখনোই হ বিলুপ্ত হবে না; বরং ন/ণ এর উচ্চারণ আগে হবে তারপর হ-এর উচ্চারণ হবে। অর্থাৎ চিহ্ন-এর উচ্চারণ হবে চিন্-হো এবং অপরাহ্ণ -এর উচ্চারণ হবে অপ-রান্-হো।
আমরা প্রত্যহ অসচেতনতার কারণে কিছু অঙ্কের ভুল উচ্চারণ করি। যেমন- চারটা কে আমরা চাট্-টা, সাতটা কে আমরা সাট্-টা উচ্চারণ করে থাকি, যা ব্যাপকভাবে ভুল। এই উচ্চারণের ছলে আমরা একটি স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছি। একটি ব্যঞ্জন বিলুপ্ত হলে অর্থ হারানোর পাশাপাশি কতটা বিদখুটে লাগে তার উদাহরণ হলো পাঁচটা কে যদি আমরা পাট্-টা উচ্চারণ করি। পাঁচটা-এর প্রমিত উচ্চারণ পাঁচ্-টা, অনুরূপ চারটা-এর উচ্চারণ চার্-টা এবং সাতটা-এর উচ্চারণ সাত্-টা। আমরা চারটা থেকে র এবং সাতটা থেকে ত বাদ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারবো না। বিশ্বাস হচ্ছে না তাহলে চলুন উচ্চারণ করে দেখি। প্রয়োজনে রেকর্ড করে দেখতে পারেন আপনার ভুল হচ্ছে নাতো?
একটু বিদ্যুৎ সংযোগের ফলে লাইট বা বাল্ব থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয় ঠিক তেমনি আমরা আমাদের মাতৃভাষা প্রয়োগ ও প্রমিত উচ্চারণের প্রতি একটু সচেতন হলে ভাষাটি গৌরব ও মর্যাদায় মহীয়ান হয়ে থাকবে। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চায়’ না, কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। যেই ভাষার জন্য বাংলার মানুষ জীবন দিয়েছে, সেই ভাষাকে আমরা বিকৃত করে ভাষাশহীদদের কলঙ্কিত করতে পারি না। মাতৃভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমরা কি একটু চাইলে পারি না প্রমিত ভাষায় কথা বলতে? নিশ্চয়ই পারি, নিশ্চয়ই আপনিও পারেন।
এস.
এম. মতিউর রহমান: জনসংযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন, সচিবালয়
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গানের ভুবনে লিজার অন্তহীন পথচলা
শীর্ষ তারকা হওয়ার দৌড়ে কখনও অংশ নিতে দেখা যায়নি তাঁকে। যদিও ২০০৮ সালে ‘ক্লোজআপ ওয়ান: তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় সেরা শিল্পীর মুকুট মাথায় উঠেছিল, তবু ধীরলয়ে পথ হেঁটে গেছেন। নিজের কাজে অতিমাত্রার উচ্ছ্বাসও দেখাননি কখনও। নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন সবসময়। গানে গানে কুড়িয়ে চলেছেন শ্রোতার ভালোবাসা। এ কারণে সমসাময়িকদের চেয়ে আলাদা করে তাঁকে চিনে নেওয়া যায়। বলছি, কণ্ঠশিল্পী সানিয়া সুলতানা লিজার কথা। গানের ভুবনে অন্তহীন পথচলায় যিনি এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছেন প্রায় দেড় যুগের পথ। সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার রহস্যটা কী? শুরুতে যখন এ প্রশ্ন লিজার সামনে তুলে আনা হলো, তখন দেখা গেল, লিজা নিজেই এর উত্তর খুঁজতে বসে গেছেন। এ পর্যায়ে হেসে বললেন, ‘না, এর উত্তর সত্যি জানা নেই। আসলে আমি তো গান গাই শ্রোতার প্রত্যাশা পূরণ আর ভালোবাসা কুড়ানোর জন্য। হ্যাঁ, শিল্পীসত্তাকে খুশি রাখতে গানের চর্চা ধরে রেখেছি বললে ভুল হবে না। তারপরও প্রতিটি আয়োজনে শ্রোতার ভালোলাগা, মন্দলাগাকে প্রাধান্য দিয়েছি। এতে করে কতটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি। সেই জনপ্রিয়তা শুরু থেকে একই রকম আছে কিনা– সেটি তো শ্রোতারা ভালো বলতে পারবেন।’ লিজার এ কথা থেকে বোঝা যায়, যাদের কারণে শিল্পীজীবন বেছে নেওয়া, সেই শ্রোতা তাঁর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। সেখানে তাঁর গানগুলো ছিল চালিকাশক্তি। তবে ১৭ বছরের সংগীতের এ পথচলায় লিজার কণ্ঠে মেলোডি গান বেশি শুনতে পাওয়া গেছে। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই দেড় যুগে নানা ধরনের গান গেয়েছি, তবু কেন জানি শ্রোতারা আমাকে মেলোডি গানের শিল্পীদের দলে রেখে দিয়েছেন। অস্বীকার করব না যে, আমার কণ্ঠে যে ধরনের গান ভক্তরা বেশি শুনতে চান, সে ধরনের গান বেশি গাই। এটিও ঠিক যে, মেলো কিংবা স্যাড-রোমান্টিক গানের প্রতি শ্রোতার ভালোলাগা সবসময় ছিল। এখনও অনেকে মেলোডি ছাড়া গানের কথা ভাবতে পারেন না। এজন্য নিরীক্ষাধর্মী কাজ করলেও আমি চাই না মেলোডি থেকে কখনও দূরে সরে থাকতে। তাই মেলোডি গান যেমন গাইছি, তেমনি গানের নিরীক্ষাও চালিয়ে যাচ্ছি।’ লিজার এ কথা যে মিথ্যা নয়, তা সর্বশেষ প্রকাশিত গানগুলোর শুনলে প্রমাণ মেলে। ক’দিন আগে বিটিভির ‘বৈঠকখানা’ অনুষ্ঠানে ক্লোজআপ ওয়ান তারকা মুহিনের সঙ্গে গাওয়া ‘তোমার নামে’ গানে যে লিজাকে শ্রোতা আবিষ্কার করবেন, তার সঙ্গে মেলানো কঠিন হবে সামজ ও রিজানের সঙ্গে ‘তিতা কথা’ গানের লিজাকে। আরেকটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, ‘খুব প্রিয় আমার’, ‘তুমি এলে’, ‘পূর্ণিমা চাঁদ’ গানগুলোয় লিজা অতীতের গায়কীকে ছাপিয়ে কীভাবে আরও নতুন হয়ে নিজ কণ্ঠ তুলে এনেছেন।
মাঝে কিংবদন্তি শিল্পীদের বেশ কিছু কালজয়ী গানের রিমেকে কণ্ঠ দিয়েও প্রশংসা কুড়িয়েছেন সংগীতবোদ্ধাদের। স্টেজ শো, রেডিও, টিভির আয়োজন থেমে শুরু করে সিনেমার প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে প্রমাণ দিয়েছেন, তিনি অন্যদের চেয়ে কোনোভাবে পিছিয়ে নন। এককথায়, বহমান সময়টিকে সুরেলা করে রেখেছেন অনিন্দ্য কণ্ঠ জাদুতে।
আগামীতেও লিজার কণ্ঠ বাতাসে ভেসে বেড়াবে– এ অনুমান করা যায়।