সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে চলতি মাসের প্রথমার্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা শুরু করবে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এর আগে কমিশন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর বিষয়ে দলগুলোর কাছ থেকে মতামত নেবে। দলগুলোও আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ঐকমত্য কমিশন বলছে, গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে তৈরি নির্দিষ্ট ছক দলগুলোর কাছে দু–এক দিনের মধ্যে পাঠানো হবে। দলগুলোর প্রাথমিক মতামত পাওয়ার পর শুরু হবে আলোচনা।

যেসব বিষয়ে ভিন্নমত থাকবে, সেগুলো কী কারণে ভিন্নমত, সামান্য পরিবর্তন করা হলে একমত হয় কি না, এসব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সহসভাপতি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার কথা সেদিন জানানো হয়েছিল—দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে একটি সনদ (জুলাই সনদ) তৈরি করা হবে। এই জুলাই সনদের ভিত্তিতে হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। এর অংশ হিসেবে কমিশন সংস্কার প্রস্তাবের মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে একটি ছক তৈরি করছে। সেখানে প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে দলগুলোর কাছে সুনির্দিষ্ট মতামত চাওয়া হবে। কোনো সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না এবং সেটি কবে নাগাদ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন (নির্বাচনের আগে বা পরে) বলে মনে করে—এসব বিষয়ে দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হবে। দলগুলোর মতামত পর্যালোচনা করে আলোচনা শুরু হবে।

তবে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথক আলোচনার সময়সূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে। আগামী এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের মধ্যে দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা শুরু হবে। কোনো দল জোটগতভাবে আলোচনা করতে চাইলে সে সুযোগও থাকবে। এরপর আবার সব দল/জোটের সঙ্গে একসঙ্গে আলোচনা করা হবে। এর পাশাপাশি সাধারণ জনগণের সঙ্গে আলোচনার একটি উপায় বের করারও চেষ্টা করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়ের কাজে যুক্ত আছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার। তিনি গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নির্দিষ্ট ছকে দু–এক দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। তারা সেগুলোর ওপর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মতামত দেবে। এরপর দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে।

জামায়াতে ইসলামীও ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছে। দলটির সূত্র জানায়, ছয়টি আলাদা গ্রুপ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনার কাজ করছে। তাদের দলীয় পর্যালোচনার কাজ এখনো শেষ হয়নি।

প্রস্তুতি নিচ্ছে দলগুলোও

রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের মতো করে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করছে। বিএনপি সূত্র জানায়, বিএনপি দলীয়ভাবে আলাদা আলাদা সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য ছয়টি কমিটি গঠন করেছিল। সংশ্লিষ্ট কমিটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছে। তবে ‘রাষ্ট্র সংস্কারে’ নিজেদের ৩১ দফা প্রস্তাবকে প্রাধান্য দেবে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির নিজস্ব ৩১ দফা প্রস্তাব আছে। সংস্কার কমিশনগুলো যখন দলের মতামত চেয়েছিল, তখন মতামত দেওয়া হয়েছে। এখন এসব বিষয়ে ঐকমত্য হলে ভালো। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো যার যার প্রস্তাব নিয়ে নির্বাচনে যেতে পারে। জনগণ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে। এর বাইরে কারও কিছু করার ‘ম্যান্ডেট’ নেই।

জামায়াতে ইসলামীও ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছে। দলটির সূত্র জানায়, ছয়টি আলাদা গ্রুপ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনার কাজ করছে। তাদের দলীয় পর্যালোচনার কাজ এখনো শেষ হয়নি।

দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ও দলের প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পৃথক পৃথক আলোচনা হবে। এখনো আলোচনার সুনির্দিষ্ট সময় জানানো হয়নি। তাঁরা এ কাজে সহযোগিতা করবেন।

ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির পর্যালোচনা বা অবস্থান প্রায় প্রস্তুত করা আছে বলে জানিয়েছেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ঐকমত্য কমিশন মতামত চাইলে তা দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে যেমন দলগুলোর কিছু কিছু বিষয়ে মতভিন্নতা আছে, তেমনি সংস্কারের বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া কী হবে, তা নিয়েও ভিন্নমত আছে। যেমন বিএনপি চায় আগে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচিত সংসদ সংবিধান সংশোধন করবে। অন্যদিকে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি চায়, আগে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হোক। তবে দলগুলো আশা করছে, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে এসব বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত আসবে।

ঐকমত্য কমিশন মতামত চাইলে তা দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে ন্যূনতম ঐক্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সনদ করতে হবে। যেসব সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলোর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া কী হবে এবং কত দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে, তা ঠিক করতে হবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটা নিয়েও একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনা। এ লক্ষ্যে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই ছয়টি কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব কমিশনের প্রধানদের নিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পাওয়ার পর ১০-১১ মার্চ নাগাদ আলোচনা শুরু করা যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন। কোন দল কোন বিষয়ে একমত, কোন বিষয়ে দ্বিমত, তা জানার পর আলাদাভাবে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে। যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হবে, সেগুলো নিয়ে আলোচনার তেমন কিছু থাকবে না। যেসব বিষয়ে ভিন্নমত থাকবে, সেগুলো কী কারণে ভিন্নমত, সামান্য পরিবর্তন করা হলে একমত হয় কি না, এসব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দলগ ল র ক ছ সরক র র মত মত চ ব এনপ দলট র

এছাড়াও পড়ুন:

লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কারের বিষয়টি নির্বাচনের মতো গুরুত্ব না পাওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক: এনসিপি

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত হতাশাজনক’ বলেছে দলটি।

আজ শুক্রবার রাতে এনসিপির এক বিবৃতিতে এই প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহউদ্দিন সিফাত বিবৃতিটি পাঠিয়েছেন।

এনসিপির বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে এনসিপি। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি ‘সংসদ নির্বাচন’ বিষয়ে দলটিকে আস্থায় আনতে সফল হয়েছে সরকার। জাতীয় ঐক্য, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে মনে করে এনসিপি।

নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে—এ কথা উল্লেখ করে এনসিপি আরও বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, জুলাই সনদ কার্যকর করা এবং বিচারের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণ-অভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত করবে এবং রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন–আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করবে।

জনগণের দাবি তথা জুলাই সনদ রচনা ও কার্যকর করার আগে নির্বাচনের কোনো তারিখ ঘোষিত হলে তা জনগণ মেনে নেবে না বলে উল্লেখ করেছে এনসিপি। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও জুলাই সনদ রচনা এবং কার্যকর করেই আসন্ন জুলাইকে যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করার উদ্যোগ নিতে সরকারকে জোর দাবি জানাচ্ছে এনসিপি।’

জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে এনসিপি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা মঙ্গলবার আবার শুরু
  • বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ভালো উদ্যোগ নিলেও বিরোধিতা আসে
  • লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কারের বিষয়টি নির্বাচনের মতো গুরুত্ব না পাওয়া অত্যন্ত হতাশাজনক: এনসিপি
  • ইউনূস-তারেকের বৈঠক দেশের মানুষের জন্য স্বস্তির বার্তা, আশার আলো
  • ড. ইউনূস ও তারেকের বৈঠক জাতির জন্য স্বস্তির বার্তা: ১২ দলীয় জোট
  • ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার ও জুলাই সনদ