মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। পশ্চিম ইউরোপের পাঁচটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এমনটাই মনে করেন বলে এক জরিপে উঠে এসেছে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বৈঠক হয়। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সও বৈঠকে ছিলেন। বৈঠকে ট্রাম্প-ভ্যান্স জুটি জেলেনস্কির ওপর চড়াও হন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের শীর্ষ নেতাদের মধ্যকার নজিরবিহীন এই বাগ্‌যুদ্ধের ঘটনার পর কিয়েভের জন্য মার্কিন সামরিক সহায়তা স্থগিত করেন ট্রাম্প। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প সম্পর্কে পশ্চিম ইউরোপীয়দের শঙ্কার মনোভাব উঠে এল জরিপে।

জরিপটি করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারনেটনির্ভর জরিপকারী সংস্থা ইউগভ। পশ্চিম ইউরোপের পাঁচ দেশ ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাজ্যে জরিপটি করা হয়। জরিপ পরিচালনার সময়কাল ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ।

জরিপ পরিচালনার সপ্তাহটি ছিল বেশ নাটকীয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্প-ভ্যান্স জুটির সঙ্গে জেলেনস্কির বাগ্‌যুদ্ধের পর ২ মার্চ যুক্তরাজ্যের লন্ডনে শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন ইউরোপীয় নেতারা।

বৈঠকে ইউরোপীয় নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎসহ ইউরোপের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। চার দফা পরিকল্পনা প্রকাশ করে তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে ইউক্রেনের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন।

ইউগভের জরিপে দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের মধ্যে একটি সংখ্যালঘু অংশই কেবল মনে করেন, কিয়েভের পাশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি সরে গেলে বাকি পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনকে সমর্থন দিতে সক্ষম হবে। তবে উত্তরদাতাদের মধ্যে তুলনামূলক খুব কমসংখ্যকই ইউরোপীয় মিত্রদেশগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়েছেন জরিপে।

ইউক্রেন ও ইউরোপকে বাইরে রেখেই রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করে দিয়েছে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র। জরিপে দেখা গেছে, বেশির ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন, কিয়েভ বা ইউরোপকে শান্তি আলোচনা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য। অনেক উত্তরদাতা মনে করেন, শান্তি চুক্তির পরও রাশিয়া সম্ভবত আবার ইউক্রেনে আক্রমণ চালাবে।

রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে এক মাসের আংশিক যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যের একটি প্রস্তাবের কথা সামনে এনেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। প্রস্তাব অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে ইউক্রেনে ইউরোপীয় স্থলসেনা (শান্তিরক্ষী) মোতায়েন করা হবে। তবে ইউক্রেনে ইউরোপীয় শান্তিরক্ষী মোতায়েনের বিষয়ে ফ্রান্স-যুক্তরাজ্যের প্রস্তাবের ব্যাপারে ইউগভের জরিপে বিভক্ত মতামত উঠে এসেছে।

ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের আপাত প্রতীয়মান জোটের প্রেক্ষাপটে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, পশ্চিম ইউরোপের পাঁচটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউরোপের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য খুব বড় বা মোটামুটি বড় হুমকি হয়ে উঠেছেন।

ইতালির ক্ষেত্রে এই মনোভাব প্রকাশ করেছেন ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা, যা ফ্রান্সে ৬৯ শতাংশ, জার্মানিতে ৭৪ শতাংশ, স্পেনে ৭৫ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যে ৭৮ শতাংশ।

অন্যদিকে ইতালির ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে হুমকি হিসেবে অভিহিত করেন। জার্মানির ক্ষেত্রে তা ৭৯ শতাংশ, ফ্রান্সে ৮০ শতাংশ, স্পেনে ৮৭ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যে ৮৯ শতাংশ।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র ইউর প য় র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা

লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।

সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।

আরো পড়ুন:

আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র

মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা

চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।

তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।

শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।

তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।

তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।

ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।

রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।

“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”

“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”

“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”

টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”

“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।” 

সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ