সাম্প্রতিক কালে নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও ভায়োলেন্সের এক নতুন স্বর্ণালী যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। তা হল সাইবার বুলিং বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যারাসমেন্ট ও ডিজিটাল নির্যাতন।

সাম্প্রতিক কালে এই প্রবণতা সর্বকালের সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। যে কোন ইস্যুতে, যে কোন উদ্দেশ্যে, যে কোন মতানুসারী পুরুষরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হামলে পড়ছেন নারীর ওপর; নারীকে চুপ করানোর, দমন পীড়নের আর শাস্তি দেবার এমন সহজ উপায় বোধ হয় আর নেই। কখনো কখনো দল বেঁধে টার্গেট করে কোন কোন নারীর ওপর এই নির্যাতন চালানো হচ্ছে দিনের পর দিন। আর সবচেয়ে বেশি টার্গেট হচ্ছেন রাজনৈতিক বা সামাজিক ভাবে সক্রিয় নারীরা।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ২০২২ সালে একটি গবেষণায় দেখিয়েছিল যে বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ নারী কোন না কোনভাবে অনলাইন নির্যাতন ও ভায়োলেন্সের শিকার হন। নি: সন্দেহে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সময় থেকে এ পর্যন্ত এই ভায়োলেন্সের হার সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। গণঅভ্যুত্থানের নারী সমন্বয়ক ও সক্রিয় কর্মীদের আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অকল্পনীয় ও অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছি তখন, এখনো তাই দেখছি।

অপরদিকে ছাত্রলীগের নেত্রীবৃন্দ এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের সমর্থক হওয়ার কারণে নারী সাংবাদিক, লেখক, অ্যাকটিভিস্টরাও অনলাইন আক্রমণ থেকে বাদ যান নি মোটেও। উভয় পক্ষের পুরুষরাই প্রতিপক্ষের নারীদের পীড়ন করার জন্য অনলাইন প্লাটফর্মকে বেছে নিয়েছেন ব্যাপক হারে। এমনকি প্রতিপক্ষ পুরুষকে ঘায়েল করার বেলায়ও তাদের পরিবারের বা ঘনিষ্ঠ নারীদের টার্গেট করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, তাদের কারও পুরুষ সহযাত্রী বা পথের সাথীকে এসবের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।

অ্যাকশন এইডের গবেষণা অনুযায়ী অনলাইন নির্যাতনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক (৪৭ শতাংশ), তারপর মেসেন্জার (৩৫ শতাংশ)। সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে ফেসবুকে কোন নারীকে নিয়ে আপত্তিকর, নোংরা, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ এবং ঘৃণা বিদ্বেষমূলক কমেন্ট করা (৮০ দশমিক ৪ শতাংশ)।

এর পরেই আছে ইনবক্সে নোংরা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মেসেজ বা ছবি পাঠানো (৫৩ শতাংশ)। ১৭ দশমিক ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে ফেক আইডি খুলে হ্যারাসমেন্টের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। ১১ দশমিক ৮ শতাংশের ক্ষেত্রে নারীদের ফেসবুকের ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য অনুমতি না নিয়ে পোস্ট করা হয়েছে এবং বুলিং করা হয়েছে। ১১ দশমিক ৮ শতাংশ নারী ফেসবুক ওয়ালে বা মেসেন্জারে ক্রমাগত ধর্ষণ বা সেক্সুয়াল এসল্টের হুমকি পেয়েছেন।

ডিজিটাল মব লিঞ্চিং এর এই যুগে ধর্ষকামী পুরুষের জন্য কোন নারীকে অনলাইনে ধর্ষণ করা এখন খুব সোজা। হাতের কাছে না পেলেও নারীকে অনলাইনে প্রহার, ধর্ষণ বা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করতে তেমন কিছু লাগে না, একটা ফেসবুক আইডি থাকলেই চলে।

সুদূর সাতক্ষীরায় বসে একটা স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ঢাকার কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী বা নারী শিক্ষক, উচ্চপদস্থ নারী, এমনকি নারী উপদেষ্টা যে কাউকে মনের সুখে যৌন নির্যাতন করা যায়। এতে কারও কিছু আসে যায় না, কারও কোন বিচারও হয় না, কেউ কোন প্রতিবাদও করে না। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা এ থেকে উল্টো মর্ষকামী আনন্দ গ্রহণ করেন। অনেকে নিজে নির্যাতন না করলেও এগুলো শেয়ার করার মাধ্যমে আরও বেশি ব্যবহারকারীর মধ্যে ছড়িয়ে দেন। বাংলাদেশের মিসোজিনিস্ট পুরুষদের জন্য এমন সুদিন আর কখনো আসেনি।

রাজনীতিতে, খেলার মাঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রে, সামাজিক অ্যাকটিভিজমে বা সেলিব্রেটি দুনিয়ায় নারীকে দমন করার, পীড়ন করার, চুপ করিয়ে দেবার, পিছিয়ে দেবার যে মোক্ষম অস্ত্র বাংলাদেশের পুরুষরা, কখনো কখনো তাদের সহযোগী নারীরাও ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছেন ডিজিটাল দুনিয়ায়, এর শেষ কোথায়?

অনলাইন হ্যারাসমেন্ট নারীদেরকে কেবল পরিবার ও সমাজের চোখে হেয়, ব্রিবত ও লজ্জিতই করে না, নারীর ওপর এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী ও ভয়াবহ। আইইউটি বাংলাদেশ এর গবেষক ড মো রুহুল আমিন তাঁর “কজেস এন্ড কনসিকুয়েন্সেস অফ সাইবার বুলিং এগেইনস্ট উইমেন ইন বাংলাদেশ: এ কমপ্রিহেনসিভ স্টাডি” তে বলেছেন অনলাইন নির্যাতনের শিকার নারীরা মানসিক ও ইমোশনাল ডিসট্রেস, ভীতি ও উদ্বেগ, সোশ্যাল আইসোলেশন বা সমাজচ্যুতির দিকে এগিয়ে যান।

অ্যাকশন এইডের মতে ৬৫ শতাংশ তীব্র সাইকোলজিকাল ট্রমা, বিষন্নতা ও উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগেন, ৪২ শতাংশ মত প্রকাশে বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার থেকে সরে আসেন, ২৫ শতাংশ আত্নবিশ্বাস ও আত্নসম্মান হারানোর সমস্যায় ভোগেন। কেউ কেউ হয়তো সেলফ হার্ম এমনকি আত্নহত্যার পথও বেছে নেন। নারীর প্রতি সরাসরি শারিরীক সহিংসতা বা নির্যাতনের চেয়ে এই ডিজিটাল নির্যাতন মোটেও ছোট অপরাধ নয়, অথচ এ বিষয়ে আমরা নীরব। গবেষণা বলছে অনলাইন নির্যাতনের শিকার নারীদের ৮৫ শতাংশই এ বিষয়ে কোথাও কোন অভিযোগ করেন নি, আর ১৫ শতাংশ করে থাকলেও খুব কম সংখ্যক নারীই কোন সুবিচার পেয়েছেন। যে দেশে ধর্ষণেরই বিচার হয় না সেখানে ডিজিটাল ধর্ষণের বিচার চাওয়া বোকামিই বলে মনে হতে পারে, কিন্তু সময় এসেছে এ নিয়ে কথা বলার। ঘুরে দাঁড়ানোর।

এ বছরের ৪ মার্চ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় মাতসুশিমা সুমাইয়া নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে উল্লেখ করেন যে তিনি ক্রমাগত হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছেন। টানা এই সব হুমকির কারণে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ার কথাও জানান তিনি।

আরও পড়ুননারীর ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি কি শুধুই ‘মব ভায়োলেন্স’২০ ঘণ্টা আগে

সম্প্রতি নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ডা মাহমুদা মিতু এক ফেসবুক পোস্টে লিখেন, “আমার ইনবক্সের গালি আর থ্রেট আর ম্যাসেজ গুলো যদি দেখাতে পারতাম তাহলে যেকোনো সুস্থ মানুষ পাগল হয়ে যেত। সেক্সুয়ালি পার্ভাট লোকের সংখ্যা মারাত্মক হারে বাড়ছে। “শেষ পর্যন্ত তিনি লেখেন-সাধারণ শালীন ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা অরাজনৈতিক মেয়েদের জন্য প্রথম প্রথম এসবে কষ্ট হবে এর পর কেউ গায়ে মাখবেনা। বাংলাদেশের রাজনীতির পথ চলা এমনই! ”

মনে পড়ে গত বছর এক সেমিনারে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিউটের চিফ অফ স্টাফ ফৌজিয়া আফরোজ এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “দেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এমনিতে কম। রক্ষণশীল সংস্কৃতি ও সামাজিক আচরণ নারীকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। এর ওপর অপতথ্য ছড়ালে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ আরও সংকুচিত হবার আশংকা থাকে। “তিনি দেখিয়েছিলেন রাজনৈতিক অ্যাকটিভিজম বা নির্বাচনের সময় যারা ক্রমাগত অপতথ্যের শিকার হন ডিজিটাল মিডিয়ায় তার শীর্ষ দশই নারী। ট্রলিং, ডক্সিং, ডিপফেক ছবি ব্যবহার, অন্তরঙ্গ ছবির ব্যবহার, যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য ইত্যাদির মাধ্যমে এই নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক হয়রানির শিকার হয়েছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানে নুসরাত জাহান, উমামা ফাতেমারা যেমন অনলাইন হয়রানির শিকার হয়েছেন, পরবর্তীতে সামিনা লুৎফা, গীতি আরা নাসরিন, সাংবাদিক দীপ্তি চোধুরী, ব্যারিস্টার রুমীন ফারহানা, এমনকি উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পর্যন্ত কেউ ই রেহাই পান নি। যে ভাবে অভিনেত্রী বাঁধন সে সময় সহিংস ডিজিটাল ভায়োলেন্সের শিকার হলেন, সেই একই ভাবে এই সময় এর বিপরীতে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন বা সোহানা সাবাকে ডিজিটাল সহিংসতার শিকার হতে হল। এখানে আক্রমণকারীরা ভিন্ন মতাদর্শী হলেও নারীর চরিত্র হননের বেলায় সবাই এক।

ডিজিটাল প্লাটফর্মে পুরুষকে আক্রমণ করার সময়ও সংশ্লিষ্ট নারীদেরই টার্গেট করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমনটা আমরা আগে ঘটতে দেখেছি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের স্ত্রী বা মেয়র আতিকুল হকের কন্যার বেলায়, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখন দেখি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের মেয়ের ক্ষেত্রেও।

সম্প্রতি তিনি মিডিয়াকে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে তাঁর পরিবারকে এভাবে আক্রমণ করা হবে জানলে তিনি এই পদে আসতেন না। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের একটি ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকের মধ্যে বিশেষ করে টার্গেট হয়েছেন আদৃতা রায়, সেটা তার পিতার পরিচয়ের কারণেই। কোন ব্যক্তি বা পরিবারকে হেয় করতে চাইলে সেই পরিবারটির নারী সদস্যকে বেছে নেয়াটা সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।

রাজনীতিতে, খেলার মাঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রে, সামাজিক অ্যাকটিভিজমে বা সেলিব্রেটি দুনিয়ায় নারীকে দমন করার, পীড়ন করার, চুপ করিয়ে দেবার, পিছিয়ে দেবার যে মোক্ষম অস্ত্র বাংলাদেশের পুরুষরা, কখনো কখনো তাদের সহযোগী নারীরাও ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছেন ডিজিটাল দুনিয়ায়, এর শেষ কোথায়?

এই ভয়ংকর সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার নারীরা কোথায়, কার কাছে বিচার চাইবেন, যেখানে কখনো কখনো রাষ্ট্র নিজেই এই ধরণের আচরণকে উৎসাহিত করে চলেছে? শুনেছি দেশে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, আছে সেন্টার ফর ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন এন্ড চিলড্রেন এর ন্যাশনাল হেলপ লাইন, আদৌ কি আমাদের এই ধরণের ডিজিটাল নির্যাতনের বিচার চাইবার কোন জায়গা আছে এদেশে? আছে কি নারীদের সুবিচার পাবার কোন সুযোগ?

তানজিনা হোসেন কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র র ওপর র জন ত ত ব যবহ র পর ব র ফ সব ক র জন য হয় ছ ন দশম ক সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

চাঁদাবাজ রিয়াদের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ মিশনপাড়া

নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র মিশনপাড়ায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি, হুমকি ও হয়রানিমূলক মামলার ভয়ঙ্কর এক চক্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন সাধারণ মানুষ।

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, রিয়াদ  দীর্ঘদিন ধরেই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে দোকান বসানো পর্যন্ত সবকিছুতেই চাঁদা দাবি করেন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা।

চাঁদা না দিলে থেমে যায় কাজ, চলে হামলা, পরে দেওয়া হয় সাজানো মামলা। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন রয়েছে রহস্যজনকভাবে নীরব।

স্থানীয়রা বলছেন, রিয়াদ নিজে কোনো রাজনৈতিক আদর্শের লোক না হলেও, একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাঁদের ব্যবহার করেন নিজের স্বার্থে।

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় রিয়াদ এতটাই দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করেন যে, থানায় একাধিক অভিযোগের পরও তাঁর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অন্যতম আসামিও এই রিয়াদ। সেইসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় তাঁর নামে একাধিক চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মামলা রয়েছে।

এমনকি তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু তারপরও তিনি দিব্যি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আদায় করে চলেছেন চাঁদা, দখল করে নিচ্ছেন জমি, দোকান।

মিশনপাড়ায় বর্তমানে যেসব ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় প্রতিটির কাজেই বাধা দেওয়া হয়েছে রিয়াদের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাড়ির মালিক বলেন, “আমরা পরিবার নিয়ে এখানে থাকি।

নিজের পৈতৃক জমিতে ভবন নির্মাণ করছি। হঠাৎ একদিন ৪-৫ জন যুবক এসে জানায়, বসের অনুমতি ছাড়া কাজ হবে না। পরে রিয়াদ নিজেই ফোন করে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। না দিলে মালামাল ফেলে দেওয়া, শ্রমিকদের মারধরের হুমকি দেয়।”

এই অভিজ্ঞতা শুধু একজনের নয়। অন্তত ৮-১০ জন ভবন মালিক এবং কয়েকজন ঠিকাদার একই ধরনের ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য, রিয়াদের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়মিতভাবে ১ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করে। কেউ না মানলে থেমে যায় কাজ, চলে হামলা-মামলা আর হয়রানির স্বীকারে।

মিশনপাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, রিয়াদ এলাকায় একটি ভয়ঙ্কর ‘মিনি মাফিয়া নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলেছেন। ভবন নির্মাণ, দোকান বসানো, এমনকি ফুটপাতে ব্যবসা করতেও তাঁকে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় চলতে থাকে ভয় দেখানো, ভাঙচুর, এমনকি জীবননাশের হুমকি। অনেকেই বলেন, তাঁরা যেন জিম্মি হয়ে পড়েছেন রিয়াদ ও তাঁর চক্রের হাতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, “আমার পৈতৃক জমিতে ভবন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছি। ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। না দিলে শ্রমিকদের মারধর করবে বলে হুমকি দিয়েছে। থানায় গিয়ে অভিযোগ করলাম, কিন্তু কিছুই হয়নি। বরং রিয়াদ খবর পেয়ে হুমকি দিয়ে চাঁদার পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে।”

একজন ঠিকাদার বলেন, “ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে আমাদের এখন বেশি খরচ হয় রিয়াদকে সামলাতে। কোনো আইন-শৃঙ্খলা নেই। যে যেখানে ইচ্ছা চাঁদা চাচ্ছে, না দিলে মামলা, মারধর। কোথাও নালিশ করতে পারি না, বরং নালিশ করলেই বিপদ আরও বাড়ে।”

আরেকজন ঠিকাদার বলেন, “রিয়াদ এখন এলাকাবাসীর গলার কাঁটা। কাজ শুরু করলেই তার লোকজন এসে বলে, বসের অনুমতি লাগবে। চাঁদা না দিলে মালামাল উধাও, শ্রমিক পালায়, পরে থানায় গিয়ে দেখি আমার নামে নাকি মারামারির মামলা!”

ভুক্তভোগীরা জানান, শুধু ভীতি ও চাঁদাবাজি নয়, রিয়াদ ও তাঁর সহযোগীরা একটি সংঘবদ্ধ আইনি হয়রানির চক্রও তৈরি করেছেন। কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে বা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে উল্টো তাঁদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। পরবর্তীতে সেই মামলা আপোষে নিষ্পত্তির জন্য আবারও দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, রিয়াদের এতোসব অপরাধ কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নেওয়ায় মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে, কেন এই নীরবতা? তাঁর নামে একাধিক মামলা ও ওয়ারেন্ট থাকার পরও কীভাবে তিনি খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়ান? পুলিশ কি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে আড়াল করছে?

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমরা অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তাধীন। অপরাধী হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে এলাকাবাসীর দাবি ভিন্ন।

তাঁরা বলছেন, শুধু অভিযোগ নয়, ভিডিও প্রমাণ, অডিও ক্লিপস, এমনকি লিখিত অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাননি তাঁরা। বরং অভিযোগ জানানোর পর হুমকির মাত্রা বেড়ে যায়। অনেকে ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বা কাজ বন্ধ রেখেছেন।

রিয়াদের বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপর আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

স্থানীয় কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছেও বহুবার গেছেন এলাকাবাসী। কিন্তু কেউই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসেননি। বরং অনেকে অভিযোগ করেন, রিয়াদ একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক গ্রুপের ‘অঘোষিত কার্যকর্তা’ হিসেবে কাজ করেন, এবং সেই পরিচয়ের কারণেই তাঁকে ঘিরে রয়েছে এক ধরনের অদৃশ্য নিরাপত্তা।

মিশনপাড়ার এই অবস্থা এখন পুরো নারায়ণগঞ্জ শহরের নিরাপত্তা ও সুশাসনের জন্য ভয়ঙ্কর এক সংকেত হয়ে উঠেছে। নাগরিক সমাজের প্রশ্ন , যদি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও একাধিক মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার না করা হয়, তবে আইনের শাসন কোথায়? 

সচেতন মহলের দাবি, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে রিয়াদ ও তাঁর চক্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তখন শুধু মিশনপাড়া নয়, নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রতিটি প্রান্তেই গড়ে উঠবে এমন চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট।

এখনই সময় রিয়াদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার, নয়তো ঘটতে পারে ভয়ংকর অপ্রীতিকর কোন ঘটনা। আক্রান্ত হতে পারে ভুক্তভোগীরা।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চাঁদাবাজ রিয়াদের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ মিশনপাড়া
  • পুতিন এমন কিছু চান, যা তিনি কখনোই পাবেন না