নারীকে দমন–পীড়নের নতুন পন্থা, কোন সমাধান নেই?
Published: 8th, March 2025 GMT
সাম্প্রতিক কালে নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও ভায়োলেন্সের এক নতুন স্বর্ণালী যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। তা হল সাইবার বুলিং বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হ্যারাসমেন্ট ও ডিজিটাল নির্যাতন।
সাম্প্রতিক কালে এই প্রবণতা সর্বকালের সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। যে কোন ইস্যুতে, যে কোন উদ্দেশ্যে, যে কোন মতানুসারী পুরুষরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হামলে পড়ছেন নারীর ওপর; নারীকে চুপ করানোর, দমন পীড়নের আর শাস্তি দেবার এমন সহজ উপায় বোধ হয় আর নেই। কখনো কখনো দল বেঁধে টার্গেট করে কোন কোন নারীর ওপর এই নির্যাতন চালানো হচ্ছে দিনের পর দিন। আর সবচেয়ে বেশি টার্গেট হচ্ছেন রাজনৈতিক বা সামাজিক ভাবে সক্রিয় নারীরা।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ২০২২ সালে একটি গবেষণায় দেখিয়েছিল যে বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ নারী কোন না কোনভাবে অনলাইন নির্যাতন ও ভায়োলেন্সের শিকার হন। নি: সন্দেহে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সময় থেকে এ পর্যন্ত এই ভায়োলেন্সের হার সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। গণঅভ্যুত্থানের নারী সমন্বয়ক ও সক্রিয় কর্মীদের আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অকল্পনীয় ও অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছি তখন, এখনো তাই দেখছি।
অপরদিকে ছাত্রলীগের নেত্রীবৃন্দ এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের সমর্থক হওয়ার কারণে নারী সাংবাদিক, লেখক, অ্যাকটিভিস্টরাও অনলাইন আক্রমণ থেকে বাদ যান নি মোটেও। উভয় পক্ষের পুরুষরাই প্রতিপক্ষের নারীদের পীড়ন করার জন্য অনলাইন প্লাটফর্মকে বেছে নিয়েছেন ব্যাপক হারে। এমনকি প্রতিপক্ষ পুরুষকে ঘায়েল করার বেলায়ও তাদের পরিবারের বা ঘনিষ্ঠ নারীদের টার্গেট করা হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, তাদের কারও পুরুষ সহযাত্রী বা পথের সাথীকে এসবের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।
অ্যাকশন এইডের গবেষণা অনুযায়ী অনলাইন নির্যাতনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক (৪৭ শতাংশ), তারপর মেসেন্জার (৩৫ শতাংশ)। সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে ফেসবুকে কোন নারীকে নিয়ে আপত্তিকর, নোংরা, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ এবং ঘৃণা বিদ্বেষমূলক কমেন্ট করা (৮০ দশমিক ৪ শতাংশ)।
এর পরেই আছে ইনবক্সে নোংরা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মেসেজ বা ছবি পাঠানো (৫৩ শতাংশ)। ১৭ দশমিক ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে ফেক আইডি খুলে হ্যারাসমেন্টের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। ১১ দশমিক ৮ শতাংশের ক্ষেত্রে নারীদের ফেসবুকের ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য অনুমতি না নিয়ে পোস্ট করা হয়েছে এবং বুলিং করা হয়েছে। ১১ দশমিক ৮ শতাংশ নারী ফেসবুক ওয়ালে বা মেসেন্জারে ক্রমাগত ধর্ষণ বা সেক্সুয়াল এসল্টের হুমকি পেয়েছেন।
ডিজিটাল মব লিঞ্চিং এর এই যুগে ধর্ষকামী পুরুষের জন্য কোন নারীকে অনলাইনে ধর্ষণ করা এখন খুব সোজা। হাতের কাছে না পেলেও নারীকে অনলাইনে প্রহার, ধর্ষণ বা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করতে তেমন কিছু লাগে না, একটা ফেসবুক আইডি থাকলেই চলে।
সুদূর সাতক্ষীরায় বসে একটা স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ঢাকার কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী বা নারী শিক্ষক, উচ্চপদস্থ নারী, এমনকি নারী উপদেষ্টা যে কাউকে মনের সুখে যৌন নির্যাতন করা যায়। এতে কারও কিছু আসে যায় না, কারও কোন বিচারও হয় না, কেউ কোন প্রতিবাদও করে না। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা এ থেকে উল্টো মর্ষকামী আনন্দ গ্রহণ করেন। অনেকে নিজে নির্যাতন না করলেও এগুলো শেয়ার করার মাধ্যমে আরও বেশি ব্যবহারকারীর মধ্যে ছড়িয়ে দেন। বাংলাদেশের মিসোজিনিস্ট পুরুষদের জন্য এমন সুদিন আর কখনো আসেনি।
রাজনীতিতে, খেলার মাঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রে, সামাজিক অ্যাকটিভিজমে বা সেলিব্রেটি দুনিয়ায় নারীকে দমন করার, পীড়ন করার, চুপ করিয়ে দেবার, পিছিয়ে দেবার যে মোক্ষম অস্ত্র বাংলাদেশের পুরুষরা, কখনো কখনো তাদের সহযোগী নারীরাও ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছেন ডিজিটাল দুনিয়ায়, এর শেষ কোথায়?অনলাইন হ্যারাসমেন্ট নারীদেরকে কেবল পরিবার ও সমাজের চোখে হেয়, ব্রিবত ও লজ্জিতই করে না, নারীর ওপর এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী ও ভয়াবহ। আইইউটি বাংলাদেশ এর গবেষক ড মো রুহুল আমিন তাঁর “কজেস এন্ড কনসিকুয়েন্সেস অফ সাইবার বুলিং এগেইনস্ট উইমেন ইন বাংলাদেশ: এ কমপ্রিহেনসিভ স্টাডি” তে বলেছেন অনলাইন নির্যাতনের শিকার নারীরা মানসিক ও ইমোশনাল ডিসট্রেস, ভীতি ও উদ্বেগ, সোশ্যাল আইসোলেশন বা সমাজচ্যুতির দিকে এগিয়ে যান।
অ্যাকশন এইডের মতে ৬৫ শতাংশ তীব্র সাইকোলজিকাল ট্রমা, বিষন্নতা ও উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগেন, ৪২ শতাংশ মত প্রকাশে বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার থেকে সরে আসেন, ২৫ শতাংশ আত্নবিশ্বাস ও আত্নসম্মান হারানোর সমস্যায় ভোগেন। কেউ কেউ হয়তো সেলফ হার্ম এমনকি আত্নহত্যার পথও বেছে নেন। নারীর প্রতি সরাসরি শারিরীক সহিংসতা বা নির্যাতনের চেয়ে এই ডিজিটাল নির্যাতন মোটেও ছোট অপরাধ নয়, অথচ এ বিষয়ে আমরা নীরব। গবেষণা বলছে অনলাইন নির্যাতনের শিকার নারীদের ৮৫ শতাংশই এ বিষয়ে কোথাও কোন অভিযোগ করেন নি, আর ১৫ শতাংশ করে থাকলেও খুব কম সংখ্যক নারীই কোন সুবিচার পেয়েছেন। যে দেশে ধর্ষণেরই বিচার হয় না সেখানে ডিজিটাল ধর্ষণের বিচার চাওয়া বোকামিই বলে মনে হতে পারে, কিন্তু সময় এসেছে এ নিয়ে কথা বলার। ঘুরে দাঁড়ানোর।
এ বছরের ৪ মার্চ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় মাতসুশিমা সুমাইয়া নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে উল্লেখ করেন যে তিনি ক্রমাগত হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি পাচ্ছেন। টানা এই সব হুমকির কারণে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ার কথাও জানান তিনি।
আরও পড়ুননারীর ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি কি শুধুই ‘মব ভায়োলেন্স’২০ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ডা মাহমুদা মিতু এক ফেসবুক পোস্টে লিখেন, “আমার ইনবক্সের গালি আর থ্রেট আর ম্যাসেজ গুলো যদি দেখাতে পারতাম তাহলে যেকোনো সুস্থ মানুষ পাগল হয়ে যেত। সেক্সুয়ালি পার্ভাট লোকের সংখ্যা মারাত্মক হারে বাড়ছে। “শেষ পর্যন্ত তিনি লেখেন-সাধারণ শালীন ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা অরাজনৈতিক মেয়েদের জন্য প্রথম প্রথম এসবে কষ্ট হবে এর পর কেউ গায়ে মাখবেনা। বাংলাদেশের রাজনীতির পথ চলা এমনই! ”
মনে পড়ে গত বছর এক সেমিনারে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও টেক গ্লোবাল ইনস্টিউটের চিফ অফ স্টাফ ফৌজিয়া আফরোজ এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “দেশে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এমনিতে কম। রক্ষণশীল সংস্কৃতি ও সামাজিক আচরণ নারীকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। এর ওপর অপতথ্য ছড়ালে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ আরও সংকুচিত হবার আশংকা থাকে। “তিনি দেখিয়েছিলেন রাজনৈতিক অ্যাকটিভিজম বা নির্বাচনের সময় যারা ক্রমাগত অপতথ্যের শিকার হন ডিজিটাল মিডিয়ায় তার শীর্ষ দশই নারী। ট্রলিং, ডক্সিং, ডিপফেক ছবি ব্যবহার, অন্তরঙ্গ ছবির ব্যবহার, যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য ইত্যাদির মাধ্যমে এই নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক হয়রানির শিকার হয়েছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানে নুসরাত জাহান, উমামা ফাতেমারা যেমন অনলাইন হয়রানির শিকার হয়েছেন, পরবর্তীতে সামিনা লুৎফা, গীতি আরা নাসরিন, সাংবাদিক দীপ্তি চোধুরী, ব্যারিস্টার রুমীন ফারহানা, এমনকি উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পর্যন্ত কেউ ই রেহাই পান নি। যে ভাবে অভিনেত্রী বাঁধন সে সময় সহিংস ডিজিটাল ভায়োলেন্সের শিকার হলেন, সেই একই ভাবে এই সময় এর বিপরীতে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন বা সোহানা সাবাকে ডিজিটাল সহিংসতার শিকার হতে হল। এখানে আক্রমণকারীরা ভিন্ন মতাদর্শী হলেও নারীর চরিত্র হননের বেলায় সবাই এক।
ডিজিটাল প্লাটফর্মে পুরুষকে আক্রমণ করার সময়ও সংশ্লিষ্ট নারীদেরই টার্গেট করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমনটা আমরা আগে ঘটতে দেখেছি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের স্ত্রী বা মেয়র আতিকুল হকের কন্যার বেলায়, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখন দেখি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের মেয়ের ক্ষেত্রেও।
সম্প্রতি তিনি মিডিয়াকে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে তাঁর পরিবারকে এভাবে আক্রমণ করা হবে জানলে তিনি এই পদে আসতেন না। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের একটি ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকের মধ্যে বিশেষ করে টার্গেট হয়েছেন আদৃতা রায়, সেটা তার পিতার পরিচয়ের কারণেই। কোন ব্যক্তি বা পরিবারকে হেয় করতে চাইলে সেই পরিবারটির নারী সদস্যকে বেছে নেয়াটা সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
রাজনীতিতে, খেলার মাঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রে, সামাজিক অ্যাকটিভিজমে বা সেলিব্রেটি দুনিয়ায় নারীকে দমন করার, পীড়ন করার, চুপ করিয়ে দেবার, পিছিয়ে দেবার যে মোক্ষম অস্ত্র বাংলাদেশের পুরুষরা, কখনো কখনো তাদের সহযোগী নারীরাও ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছেন ডিজিটাল দুনিয়ায়, এর শেষ কোথায়?
এই ভয়ংকর সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার নারীরা কোথায়, কার কাছে বিচার চাইবেন, যেখানে কখনো কখনো রাষ্ট্র নিজেই এই ধরণের আচরণকে উৎসাহিত করে চলেছে? শুনেছি দেশে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, আছে সেন্টার ফর ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন এন্ড চিলড্রেন এর ন্যাশনাল হেলপ লাইন, আদৌ কি আমাদের এই ধরণের ডিজিটাল নির্যাতনের বিচার চাইবার কোন জায়গা আছে এদেশে? আছে কি নারীদের সুবিচার পাবার কোন সুযোগ?
তানজিনা হোসেন কথাসাহিত্যিক ও চিকিৎসক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র র ওপর র জন ত ত ব যবহ র পর ব র ফ সব ক র জন য হয় ছ ন দশম ক সবচ য়
এছাড়াও পড়ুন:
কৃষি বিবর্তনের গল্প বলে যে জাদুঘর
বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মূলে রয়েছে কৃষি। এই কৃষির বিবর্তনের গল্প, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন, প্রযুক্তির বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্য যেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার।
সময়ের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে, ভুলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেই হারানো ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও তুলে ধরার প্রয়াসেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম কৃষি জাদুঘর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি জাদুঘর।
আরো পড়ুন:
জাপানের এনইএফ বৃত্তি পেলেন বাকৃবির ২০ শিক্ষার্থী
গোপনে বাকৃবি ছাত্রীদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে সাবেক ছাত্রকে দিতেন আরেক ছাত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) ঠিক সামনেই সবুজ দেবদারু গাছে ঘেরা এক মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এই কৃষি জাদুঘর। প্রকৃতির কোলে যেন কৃষির ইতিহাস কথা বলে এখানে।
২০০২ সালের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মু. মুস্তাফিজুর রহমানের হাত ধরে জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়, যার মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ হোসেন। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম এর উদ্বোধন করেন।
নানা প্রতিবন্ধকতা ও জনবল সংকটের কারণে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও, ২০০৭ সালের ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসাইন মিঞাঁ এটি পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি দেশের কৃষি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির এক জীবন্ত সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত।
৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত এই অষ্টভুজ আকৃতির ভবনটি স্থাপত্যগত দিক থেকেও দারুণ দৃষ্টিনন্দন। প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম, পাশে প্রাচীন সাতটি খনার বচন। প্রবেশমুখের ঠিক পরেই দুটি অফিস কক্ষ, আর একটু ভেতরে এগোলেই দেখা যায় একটি ছাদহীন বৃত্তাকার বাগান, যা প্রাকৃতিক আলোর ছোঁয়ায় উজ্জ্বল। সেই বাগানের চারপাশেই রয়েছে সংরক্ষণশালার বিভিন্ন কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই যেন কৃষির একেকটি অধ্যায়।
জাদুঘরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো বীজ সংগ্রহশালা। এখানে রয়েছে ধান, গম, ভুট্টা, তিসি, চিনাবাদাম, কাউনধান, ফ্রেঞ্চ বিন, ফাবা বিনসহ নানা ফল ও সবজির বীজ। দেখা মেলে বিরল প্রজাতির তৈকর ফলের বীজ, যা একসময় আচার ও জেলি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। রয়েছে বহুল পরিচিত ভ্যান্না বীজ, যার তৈল দিয়ে কসমেটিক ও ঔষধি পণ্য তৈরি হয়।
মাটির নানা প্রকার নমুনা, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সার, এমনকি পাহাড়ি চাষাবাদের মডেলও স্থান পেয়েছে এখানে।
শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও দর্শনার্থীদের শিক্ষার জন্য প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন ফসল রোগের চিত্র, আক্রান্ত বীজ, ও ব্যাকটেরিয়ার নমুনা। এ অংশের এক বিশেষ আকর্ষণ আড়াই কেজি ওজনের এক বিশাল মিষ্টি আলু, যা দর্শনার্থীদের বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
জাদুঘরের আরেক অংশ যেন এক ক্ষুদ্র প্রাণিবিজ্ঞান জাদুঘর। এখানে প্রদর্শিত আছে বুনো মহিষ, হরিণের শিং, গরু, অজগর ও গোখরা সাপের কংকাল। রয়েছে সংরক্ষিত কালো মেটো ইঁদুর, ধারাই সাপ, এবং কচ্ছপের খোল ও কঙ্কাল।
উপরে তাকালে দেখা যায় এক বিশাল প্রিজার্ভড শকুন, সে যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। রয়েছে প্লাটিপাসের কংকালও, যা এক বিরল প্রাণীর বাস্তব নিদর্শন। প্রতিটি নমুনাই যেন দর্শনার্থীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল ফসল বা জমির নয়, এটি প্রকৃতি ও প্রাণের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যও এখানে তুলে ধরা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। এক কক্ষে সাজানো আছে ঢেকি, কুলা, পানের ডাবর, হুকা, হারিকেন, কুপি বাতি, গরুর গাড়ির মডেল, এমনকি মাছ ধরার পুরোনো যন্ত্রও। রয়েছে তবলা, বেহালা, আদুরী, ক্রাম ও নাতকসহ বিভিন্ন দেশীয় বাদ্যযন্ত্র।
এক পাশে দেখা যায় ‘গিলা’, যা একসময় বর-কনের গোসল অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো। এখনকার তরুণ প্রজন্ম হয়তো নামটিও জানে না, অথচ এটি ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ।
আরো রয়েছে কৃষকের বসতবাড়ির পূর্ণাঙ্গ মডেল, যা দেখতে যেন একেবারে বাস্তব কৃষকের ঘর। এখানে দেখা যায় কৃষকের হালচাষের দৃশ্য, রান্নাঘর, ধান রাখার গোলা, গরুর খোঁয়াড় এবং গৃহিণীর সাজানো রান্নার জায়গা। যেন একবারে গ্রামের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে দেয়াল আর মডেলের মধ্যে।
প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছে পুরনো মাইক্রো কম্পিউটার, ডট প্রিন্টার, পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র, ঘাণি, ডিঙি নৌকা, কাঁঠের তৈরি গরুর গাড়ি, তালগাছের কুন্দা ও উপজাতিদের পোশাক। এক পাশে ঝুলছে হরিণের চামড়া, অন্য পাশে সাজানো উপজাতীয় কৃষি উপকরণ, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
এই উপকরণগুলো কেবল প্রযুক্তির বিবর্তনের ইতিহাস নয়, বরং কৃষির সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনধারার মেলবন্ধনের প্রতীক।
জাদুঘরের আরেক বিশেষ প্রদর্শনী হলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সময়ের মুদ্রার সংগ্রহ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এগুলো দেখে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জাদুঘরের প্রতিটি কোণ যেন বলে, কৃষিই বাংলাদেশের প্রাণ। এখানকার প্রতিটি উপকরণ, প্রতিটি মডেল, প্রতিটি নমুনা কৃষির বিকাশ ও মানুষের সংগ্রামের গল্প বহন করে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে কৃষির অতীত ঐতিহ্য থেকে বর্তমান প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যন্ত এক নজরে দেখতে পান।
বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “এটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে উপকরণসমৃদ্ধ কৃষি জাদুঘর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে এটিকে দোতলা ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে, যেখানে কৃষি ভিত্তিক ১৪টি জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষি উপকরণ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে।”
তিনি আরো বলেন, “দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে টিকিট ব্যবস্থা চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং জাদুঘরের রক্ষণাবেক্ষণেও ভূমিকা রাখবে।”
এই কৃষি জাদুঘর শুধু কৃষি উপকরণের প্রদর্শনী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের কৃষি সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি ও মানুষের সম্পর্কের এক সজীব দলিল। শহরের কোলাহল আর কংক্রিটের ভিড় থেকে বেরিয়ে কেউ যদি এখানে আসে, তবে মুহূর্তেই যেন হারিয়ে যায় মাটির গন্ধে, কৃষকের ঘামে, বাংলার গ্রামীণ জীবনের সহজ সরল সৌন্দর্যে।
জাদুঘরটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এবং প্রতি শনিবার বন্ধ থাকে। সময় সুযোগে একবার ঘুরে গেলে দেখা মিলবে বাংলাদেশের কৃষির হাজার বছরের গল্প, যা মাটি, ঘাম, বীজ আর ঐতিহ্যের বন্ধনে গাঁথা এক অনবদ্য ইতিহাস।
ঢাকা/মেহেদী