বিষণ্নতা ও মাদকের গ্রাস, পর্নোতে ঝুঁকছে কিশোর-কিশোরী
Published: 11th, March 2025 GMT
শ্যামলীর বেসরকারি চাকরিজীবী শামসুল আলমের দশম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে কয়েক মাস ধরে উদ্ভট পোশাক পরছে, উল্টাপাল্টা আচরণ করছে। কেন এ রকম করছে, তার কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ছেলেটি টিকটক ও রিলসের প্রতি আসক্ত হয়ে ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করছে। এসএসসির প্রস্তুতির সময় ছেলের এমন আচরণে চিন্তিত হয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন তিনি।
অবসরে কিশোরী মেয়ের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন লিলি আক্তার। মেয়ে মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিলস দেখছিল। হঠাৎ বিশেষ অঙ্গভঙ্গির একটি ভিডিও সামনে চলে এলে বিব্রত হয়ে মায়ের দিকে তাকায় ১৩ বছর বয়সী মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেড়ে নিয়ে বন্ধ করে দেন লিলি। মেয়ের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিয়ে বলতে গিয়ে এ ঘটনার বর্ণনা দেন রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা লিলি। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই চাকরিজীবী হওয়ায় যোগাযোগ রক্ষার জন্য মেয়ের হাতে ফোন তুলে দিতে হয়েছে তাদের। লিলি আক্তার বলেন, কিছুদিন আগে ইউটিউবে প্রাপ্তবয়স্ক কিছু রিলস দেখে সেও ওই ধরনের ভিডিও তৈরি করতে চায়। অনেক কিছু বলে বুঝিয়ে তাকে থামাই।
শুধু লিলি ও শামসুল নন, সন্তানদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নিয়ে বর্তমানে বেশির ভাগ অভিভাবকই চিন্তিত। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোয় প্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্ট বাড়ছে। যৌনতায় ভরা দৃশ্য ও কুরুচিপূর্ণ সংলাপের প্রদর্শন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই ধরনের কনটেন্ট বিনোদন হিসেবে প্রদর্শিত হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সীর ওপর পড়ছে বলে মনে করছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এসবের ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে পারিবারিক বন্ধন। বাড়ছে নৈতিক অবক্ষয়। উগ্র আচরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা, খুন, জখম, রাহাজানি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ দিন দিন বেড়ে চলছে। মাদকে ঝুঁকছে কিশোর-কিশোরী। বিষণ্নতা গ্রাস করছে। বাড়ছে আত্মহত্যার ঝুঁকি।
সাইকোলজিক্যাল হেলথ অ্যান্ড ওয়েলনেস কেয়ারের (পিএইচডব্লিউসি) মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অন্তরা অন্তু বলেন, কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম, যারা এখনও নিজেদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন নয়, তারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে।
অন্তু বলেন, রিলস খুব স্বল্প সময়ের হয়। একজন মানুষ যখন সবসময় এগুলো দেখতে থাকে, তখন তার দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখার সক্ষমতা কমে যাবে। এটার প্রভাব পড়ালেখা ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে পড়ছে। এ ধরনের ঘটনা সারাবিশ্বে পাওয়া যাচ্ছে এবং এগুলো নিয়ে গবেষণা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তিনি বলেন, কিশোর-কিশোরীর মধ্যে সামাজিক মাধ্যমের চটকদার বিষয়গুলোর প্রতি আকর্ষণ বোধ করা স্বাভাবিক। ফোনে আসক্তি অনেক সময় পরিবার থেকেও শুরু হতে পারে। যখন একটি শিশু দেখে বাবা-মা বা পরিবারের সবাই ফোন স্ক্রল করছে, তখন সেও তাতে আগ্রহী হয়। এ ছাড়া অনেক সময় বাবা-মাও সন্তানকে শান্ত রাখতে গিয়ে তাদের হাতে ফোন তুলে দিচ্ছেন, যেটা পরে আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীল কনটেন্ট দেখা তরুণদের মধ্যে বিষণ্নতা বাড়ছে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে না পারায় তারা সহজেই হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। একসময় এই হতাশা তাদের আত্মঘাতী চিন্তার দিকে নিয়ে যায়। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন প্রকাশিত ২০২১-২২ সালে পরিচালিত একটি অনলাইন সমীক্ষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তির ফলে ৬৫ দশমিক ১৬ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগতে থাকা মানুষ পাওয়া গেছে।
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, বাইরের দেশে যৌন শিক্ষার ভালো-মন্দ দিক যেভাবে পরিচয় করানো হয়, শেখানো হয়, আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র। বিষয়টি এখনও ট্যাবু হয়েই আছে। সামাজিক ট্যাবু ও নিষেধাজ্ঞার বিষয়গুলো তরুণ-তরুণীদের আরও বেশি আগ্রহী করে তুলছে। এটা আইন দিয়ে ঠেকানোর চেয়ে সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের সম্পর্কের বোঝাপড়াটা জরুরি।
তিনি বলেন, কোন বয়সে কোন বিষয় ও কনটেন্ট দেখা এবং জানা জরুরি, তা শিশুকাল থেকেই শিক্ষার একটি প্রক্রিয়া। এটা হুট করে বন্ধ বা খুলে দেওয়ার বিষয় না।
গত কয়েক বছরে পর্নোসহ ৩০ হাজারের বেশি অশ্লীল ওয়েবসাইট বন্ধ করেছে বিটিআরসি। এর পরও সামাজিক মাধ্যমের রিলস, পেজ ও গ্রুপের মাধ্যমে এসব ছড়িয়ে পড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত আইন থাকলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনেকাংশেই দুর্বল। অশ্লীল ভিডিও সরাতে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব স্পষ্ট। আবার সামাজিক মাধ্যমগুলো দীর্ঘদিন ধরে এগুলো নিয়ে কাজ করছে বলে জানালেও বাস্তবে এর প্রভাব খুব সামান্যই।
আইনজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীলতা ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি আইন রয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটি (২০০৬) ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বেআইনি কার্যক্রম, মিথ্যা তথ্য প্রচার, সাইবার বুলিং এবং মানহানিকর পোস্ট শেয়ার করা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে পরে সংশোধনও করা হয়। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের (২০১২) মাধ্যমে পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট তৈরি, বিতরণ ও সংরক্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮) তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য প্রচার বা মানহানিকর পোস্টের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রণীত হয়েছে। এসব আইনে কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে। কাগজে-কলমে এসব আইন বিদ্যমান থাকলেও সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীলতা প্রতিরোধে এগুলোর প্রয়োগ যৎসামান্য।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি) অশ্লীল ও অসামাজিক কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে বলে জানান সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। তিনি জানান, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করে যাচ্ছেন। এগুলো পুরোপুরি নির্মূল করা না গেলেও কীভাবে ন্যূনতম পর্যায়ে আনা যায়, সে বিষয়ে কাজ চলছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সমকালকে বলেন, সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীল কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে। তবে যেই পদক্ষেপ নেওয়া হোক না কেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট বন্ধ না করে এগুলো পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব নয়। সরকার যেহেতু ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে, তাই ইন্টারনেট কখনও শাটডাউন করা হবে না। সে জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অশ্লীল কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক কনট ন ট ব যবহ র ধরন র সরক র আসক ত
এছাড়াও পড়ুন:
ইসির ভূমিকা তদন্তে কমিটি গঠন করার নির্দেশ
বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার ও সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে কমিটি গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে এ-সংক্রান্ত আলোচনা শেষে এমন নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে ।
এই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফররাজ হোসেন ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
বৈঠকে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে যে অতীতের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনে কর্মকর্তাদের ভূমিকা তদন্ত করা এবং তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।
জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই সনদবৈঠকে কমিশন সদস্যরা জুলাই সনদ তৈরির কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। শিগগিরই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সবাই জুলাই সনদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আশা করি, আগামী জুলাই মাসের মধ্যে আমরা এটি জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারব।’
‘প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে’বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর লন্ডন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটির যাঁদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, তাঁরা সংস্কার নিয়ে জানতে চেয়েছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা খুব আগ্রহী। তাঁরা বিস্তারিতভাবে ঐকমত্য কমিশনের কাজ নিয়ে তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) সঙ্গে আলোচনা করেছেন, মতামত দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যেখানেই গিয়েছি, সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, “আমরা আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারব তো?” আমাদের প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। পোস্টাল ব্যালট এবং আর কী কী অপশন আছে, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।’