গোলপাতা আহরণে ডাকাত, সমন্বয়ক, সাংবাদিকদের নামেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ
Published: 12th, March 2025 GMT
সুন্দরবনে চলতি মৌসুমে গোলপাতা আহরণে পদে পদে ঘুষ দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ বাওয়ালিদের। তাঁদের দাবি, বন কর্মকর্তাদের তো বটেই, ডাকাত দল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সাংবাদিকদের নামেও ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। গোলপাতা আহরণের জন্য নৌকাপ্রতি সরকারকে যে টাকা রাজস্ব দিতে হয়, ঘুষ দিতে হচ্ছে এর কয়েক গুণ বেশি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাওয়ালিরা লোকসান বাঁচাতে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত গোলপাতা নৌকায় করে আনছেন। গোলপাতার আড়ালে আনছেন বিভিন্ন গাছের খণ্ড। এতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়ছে সুন্দরবন। অনেক বাওয়ালি লোকসানে পড়ে তাঁদের গোলপাতার ব্যবসা বন্ধ করার ঘোষণাও দিয়েছেন।
কয়রা নদীর তীরে বাঁধা নৌকা থেকে গোলপাতা নামানোর ফাঁকে বাওয়ালি খলিলুর রহমান বলেন, ‘যে ভাত খায়, সে ঘুষও খায়। বনে ঢুকলি ফরেস্টারগে ঘুষ দিতিই হবে। না হলি নানান হয়রানি। জরিমানা তো গুনতি হবে। যাঁরা এখন নতুন করি দেশ আরেকবার স্বাধীন করিছে, তাঁরাও টাকা খায়। আগের চাইতে এখন আরও বেশি ঘুষ দিতি হচ্ছে।’
বাওয়ালিদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা জেলার সংগঠক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বাওয়ালিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় আমাদের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এমন কোনো কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন–সংশ্লিষ্ট কারও বিরুদ্ধে এমন কোনো কর্মকাণ্ডের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তি প্রদানে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সমন্বয়কদের নামে যাঁরা চাঁদাবাজি করছেন, তাঁদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
নির্ধারিত রাজস্বের বাইরে বাওয়ালীদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান। গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে গাছ কাটা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবেন না বাওয়ালিরা। এমনকি নৌকায় ঝুল হিসেবেও কাঠ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা কাটার মৌসুম শুরু হয় ৩ ফেব্রুয়ারি। শেষ হবে ৩১ মার্চ। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৮৯টি নৌকায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরছেন বাওয়ালিরা। একেকটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। আহরণ করা প্রতি কুইন্টাল গোলপাতার জন্য বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়।
মঙ্গলবার সকালে সুন্দরবনসংলগ্ন শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, বাওয়ালিরা নদীর বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে স্তূপ আকারে কেটে আনা গোলপাতা সাজিয়ে রাখছেন। নদীর পাড়ে বাঁধা রয়েছে গোলপাতাবোঝাই বড় বড় নৌকা। এসব নৌকায় ৫০০ মণ গোলপাতা বোঝাইয়ের মাত্রা বেঁধে দেওয়া হলেও একেকটি নৌকায় ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ পাতা বোঝাই করা। নৌকার চারপাশে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা। গোলপাতার ঝাঁপির নিচে সুন্দরী, পশুরসহ মূল্যবান গাছের খণ্ড।
নৌকা থেকে গোলপাতা নামাচ্ছেন বাওয়ালিরা। মঙ্গলবার সকালে কয়রা উপজেলার কয়রা নদীর তীরে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’