মাগুরার কন্যাশিশুটি জীবন দিয়ে কী শেখাল?
Published: 13th, March 2025 GMT
মাগুরায় ধর্ষণের শিকার ৮ বছর বয়সী শিশুটি শেষ পর্যন্ত মারা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে। আসলে শিশুটি মারা যায়নি; তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। অতটুকু প্রাণ এত অত্যাচার সইবে কীভাবে?
৮ বছরের শিশুটি ৫ মার্চ মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গভীর রাতে ধর্ষণের শিকার হয়। বোনের স্বামীর সহায়তায় বোনের শ্বশুর মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছিল। শিশুটির বোন ওই ধর্ষণের পূর্বাপর ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা সভ্য সমাজে কল্পনা করা কঠিন।
এ ঘটনার এক সপ্তাহেরও কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই বয়সের কাছাকাছি অন্তত পাঁচ শিশুর ধর্ষণের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে; যেখানে অভিযুক্তদের কেউ ধর্ষণের শিকার শিশুর প্রতিবেশী, আবার কেউ নিকটাত্মীয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে ৩ হাজার ৪৩৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৩৯ জনের বয়স ৬ বছরের কম; ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে আছে ৯৩৩ জন। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিচিতদের দ্বারাই শিশুরা যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়। মূলত নিকটাত্মীয়ের প্রতি যে বিশ্বাস থাকে, তা ব্যবহার করেই এসব অপকর্ম হয়।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই; কিন্তু আদালতের নির্দেশনার পরও কমছে না নারীর প্রতি সহিংসতা। গত মাসেই ১০৭ নারী ও কন্যাশিশু নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এক মাসে ৫৩ জন ধর্ষণের শিকার, যাদের মধ্যে ৩৮ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ২৯১টি ঘটনা ঘটেছে, যা আগের মাসের তুলনায় ২২টি বেশি। এমএসএফ জানায়, জানুয়ারি মাসের চেয়ে ফেব্রুয়ারিতে ১১টি বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ফেব্রুয়ারিতে ৪২টি ধর্ষণ, ১৩টি দলবদ্ধ ধর্ষণ, ৩টি ধর্ষণ ও হত্যা, ১১টি ধর্ষণচেষ্টা, ৩২টি যৌন নিপীড়ন, ৩১টি শারীরিক নির্যাতন, ৩টি নির্যাতন ও ৭০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
মনে পড়ে, ২০১৬ সালে দিনাজপুরে যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে ৫ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সাইফুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আদালত থেকে জামিন নিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছে সে। এ ঘটনায় ক্ষোভ সৃষ্টি হলেও আসামিকে আবার কারাগারে পাঠানোর মতো কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ওই শিশুর বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আসামি চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করে। স্ত্রী ও মেয়ে এখন ঘর থেকে বের হতে চান না।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনে গাজীপুরের শ্রীপুরে আরেকটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বনের ভেতর নির্জন স্থানে আরমান মিয়া নামে এক ব্যক্তি শিশুটিকে ধর্ষণ করে সে দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে তার ভিডিও ক্লিপ তিন বন্ধুকে পাঠিয়েছে। ওই ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে এলাকাবাসী পুলিশের জিম্মায় দেন। একই দিনে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় মোজাম্মেল হক মানিক নামে এক শিক্ষক।
আমাদের দেশে ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুর পরিচিত; হয় তার আত্মীয়, বন্ধু বা বিশ্বস্ত কেউ। শিশুদের ওপর ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়ন নিয়ে ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবইউজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাতেও বলা হয়েছে, দুর্বৃত্তরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীর পরিচিত কেউ।
আমাদের আইনে ছেলেশিশু ধর্ষণের ব্যাপারে কিছু বলা নেই! আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী ছেলেশিশুরা যে ধর্ষণের শিকার হতে পারে– এই ধারণাটাই স্বীকৃত নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২৪ সালেই ছেলেশিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি; ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে তিনটি। ছেলেশিশুরা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলেশিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও খুব কম ক্ষেত্রে এ নিয়ে সচেতনতা দেখা যায়।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা মেট্রোপলিটনের শিশুদের ওপর সংঘটিত যৌন সহিংসতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। শিশু কোন পরিবেশে থাকছে, সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, সুবিধাবঞ্চিত বা বিপজ্জনক স্থানে থাকা শিশুরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। একই কথা বলা হচ্ছে নিম্নবিত্ত শ্রেণির ক্ষেত্রেও।
ফুলের মতো পবিত্র যেসব শিশুর আমাদের স্নেহ ও ভালোবাসা পাওয়ার কথা; কেন কেউ কেউ তাদের ভোগ্য ভেবে নেয়? এই যে এত এত দর্শন; কীসের অবক্ষয় আমাদের আজ খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে? এ জন্য মূল্যবোধের ক্রমাগত অবক্ষয়; পরিবার, সমাজ, শিক্ষাঙ্গন ও রাজনীতির অবক্ষয়ের পাশাপাশি মোটা দাগে শিশু পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতাই প্রকাশ পাচ্ছে এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে। আর এই শিশুরা বারবার জীবন দিয়েও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারছে না সমজের অবক্ষয়!
আশিক মুস্তাফা: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা ভিন্ন
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিস্তর অভিযোগ ছিল বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, বেআইনি আটকসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের। রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ধ্বংস করে সেগুলোকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডসহ গুম ও অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছে, সেটি নিশ্চিতভাবেই ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। কিন্তু এ সরকারের ১৪ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, মব সহিংসতায় মৃত্যুসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোও সমানভাবে উদ্বেগজনক।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’–এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৪ মাসে ৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি—৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল; আর গত তিন মাসে ঘটেছে ১১টি। ৪০ জনের মধ্যে গুলিতে মারা গেছেন ১৯ জন, নির্যাতনে মারা গেছেন ১৪ জন, পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। গত তিন মাসে যে ১১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন; সেখানে পুলিশ, যৌথ বাহিনী ও সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) অক্টোবর মাসের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বর মাসে কারা হেফাজতে যেখানে ৮ জন মারা যান, এক মাস পর সেখানে ১৩ জন মারা গেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও কারা হেফাজতে মৃত্যুর এই তথ্য যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দেয়, একই সঙ্গে জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করে। মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের প্রতিশ্রুতি আর মাঠের বাস্তবতার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, সেই চিত্রই পরিষ্কার করে তুলে ধরে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসে মব সহিংসতা ও রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যুর পরিসংখ্যানও দিয়েছে অধিকার। এ সময়ে মব সহিংসতায় ১৫৩ জন এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৮১ জন নিহত হয়েছেন। এমএসএফ জানাচ্ছে, সেপ্টেম্বর মাসে ৫২টি ও অক্টোবর মাসে ৬৬টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কোনো পরিসংখ্যানই স্বস্তিদায়ক নয়। এই চিত্র সরকারের দুর্বলতা ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ভঙ্গুরতারই প্রতিচ্ছবি। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ও ভারত থেকে পুশ ইন ঠেকাতে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতেও সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক চর্চার বাইরে গিয়ে দেখার অবকাশ নেই। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে লেখা খোলাচিঠিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক ছয়টি মানবাধিকার সংগঠন, ছয়টি নির্বিচার গ্রেপ্তার বন্ধ এবং গ্রহণযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহার ও খারিজের আহ্বান জানিয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যুর মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের লাগাম টানতে হলে অবশ্যই সবার আগে বাহিনীগুলোর ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কারের প্রশ্নটি সে কারণেই সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর তাদের সুপারিশে র্যাব বিলুপ্তি এবং বিজিবিকে সীমান্ত রক্ষা ও ডিজিএফআইকে সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া বাস্তবে কোনো সংস্কার করতে পারেনি। ফলে নির্বাচন–পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের আমলেও বাহিনীগুলোকে রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে।
শুধু প্রতিশ্রুতি আর কথায় নয়, বাস্তবেও মানবাধিকার রক্ষায় সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যুর অবসান হতে হবে।