ফাগুনের হাওয়া বইছে। তারিখটা ১৭ ফেব্রুয়ারি। হাওয়ার সঙ্গে উড়ছে ধুলো। সেসব ধূলিকণার আবরণে ঢাকা পড়েছে গাছপালার সবুজ পাতা, পথপ্রান্তর। সিলেট শহর থেকে চলেছি গোলাপগঞ্জের দিকে। পথের দুপাশে মাঠের শর্ষেগুলো সব কাটা হয়ে গেছে। বেশির ভাগ মাঠই ফাঁকা—ধূলি, কুয়াশা, ঘোলাটে রোদ, মেঘের ছায়া সব মিলিয়ে শূন্য মাঠগুলো যেন খাঁ খাঁ করছে। এর মধ্যে কিছু মাঠে, পথের কোলে মাচায় চলছে সবুজের ফালি ফালি ছোঁয়া। কোনো কোনো মাঠে সূর্যমুখী ফুল ফুটেছে। তবে সবুজের বেশির ভাগই শিমখেত। দেখতে দেখতে গোলাপগঞ্জের লক্ষ্মণাবাদ ইউনিয়নের চৌধুরী বাজারে গিয়ে হাজির হলাম। রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় বসে গাদা করে রাখা শিমগুলোকে বাছাই করছে কয়েকজন লোক, ঝুড়ি বোঝাই করে কেউ কেউ শিম ও শিমের বিচি বেচছে। গাড়ি থেকে নেমে তাঁদের কাছে এগিয়ে গেলাম।
পঞ্চাশোর্ধ্ব সিরাজউদ্দিন, তিনি খেতের শিম তুলে নিয়ে এসেছেন বাজারে বিক্রি করতে। বললেন, ‘এ শিমের খুব চাহিদা। বিশেষ করে বিদেশে। বাছাই করে আমরা ভালো ভালো শিমগুলো বিদেশে পাঠিয়ে দিই। আমাদের লন্ডনি ভাইয়েরা এসব শিম খেতে খুব পছন্দ করেন। শিমের নাম গোয়ালগাদ্দা।’ তিনি জানালেন, ১৯৮০ সাল থেকে তিনি এ শিমের চাষ করে আসছেন। তবে তিনি তাঁর বাপ-দাদাদেরও এ শিম চাষ করতে দেখেছেন। তখন খুব অল্প আকারে বাড়ির আশপাশে এ শিমের চাষ হতো। এখন অনেক মাঠেই এ শিমের চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে তিনি তিন বিঘা জমিতে এ শিমের চাষ করেছেন। অগ্রহায়ণের প্রথম থেকে শিম তুলছেন, তুলবেন এপ্রিল পর্যন্ত। বৃষ্টি নামলেই বন্ধ হবে শিম তোলা। প্রায় ছয় মাস ধরে ফলন দেয়, এমন আর কোনো শিমের জাত এ দেশে নেই। প্রতি সপ্তাহে তিনি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ কেজি শিম তোলেন। নিজেরাই বীজ রাখেন এবং সে বীজ দিয়ে আবার পরের মৌসুমে চাষ করেন।
গোলাপগঞ্জের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.
এ দেশে যেসব সবজি চাষ হয়, তার প্রায় সবই হাইব্রিড জাতের। কিন্তু শিমের কোনো হাইব্রিড জাত নেই। এ দেশে কত জাতের শিম আছে, তার কোনো সঠিক গবেষণা বা সমীক্ষা নেই। নলডক, নলি, হাতিকান, চিটাগং, রূপবান, আউশা, রঙ্গিমা, পুঁটি, খিরনলী, তক্তা, ঘিকাঞ্চন, ছেই, কাইকা, মটর, সিরা, বাইমা, বাইন, নরসিংদী, চটকা, সিন্দুর, কার্তিকা, আশ্বিনা, বৌকানী, সূর্যমুখী ইত্যাদি নানা জাতের দেশি শিম এ দেশে রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও ইপসা ১০টি আধুনিক উচ্চফলা জাতের শিম উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু সিলেটের গোয়ালগাদ্দা শিমটা যেন সব জাতের মধ্যে সেরা। এ জাতের শিম ১২ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়, চওড়া হয় ৪-৫ সেন্টিমিটার, চ্যাপটা ও পাতলা, কিছুটা ঢেউখেলানো, সবুজ ত্বক ও কালচে বেগুনি শিরবিশিষ্ট, কচি শিম নরম ও সুস্বাদু, বীজের রং কালো। গাদা করে শিম ধরে বলে মনে হয় তা থেকে নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাদ্দা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘গোয়ালগাদ্দা শিমের স্বাদ ও অধিক ফলনে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই সিলেটের বাইরে নিয়ে এর বীজ দিয়ে চাষের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোন রহস্য জানি না, সিলেটের মতো সেখানে এ শিমের স্বাদ হয় না। এ শিমকে তাই সিলেটের জিআই কৃষিপণ্য হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা যেতে পারে। দেশের অন্য স্থানে চাষ সম্প্রসারণেও পরীক্ষা করা যায়। যেহেতু বিদেশেও এ শিমের চাহিদা রয়েছে, তাই উত্তম কৃষিচর্চা বা জিএপি প্রটোকল ঠিক করে শতভাগ নিরাপদ সবজি হিসেবে এ জাতের শিম উৎপাদন ও রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া দরকার।’
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের
এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।
চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।
টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর।
গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।
দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত।
শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।
মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।
সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।