বাজেট বাস্তবায়নে সচিবদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বজায় রাখার নির্দেশ অর্থ উপদেষ্টার
Published: 24th, March 2025 GMT
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বজায় রাখতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘আমি তাঁদের বলেছি, বাজেট বাস্তবায়নে তাঁরা যেন জনগণের কল্যাণটা দেখেন এবং সময়মতো সবকিছু করা হয়।’
সচিবালয়ে আজ সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রাক্-বাজেট আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এ কথাগুলো বলেন। বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ২৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের সঙ্গে এ আলোচনা হয় অর্থ উপদেষ্টার। তিনি এরপর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, অর্থসচিব মো.
সচিবেরা কী পরামর্শ দিলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘পরামর্শ ঠিক না। আমি তাঁদের বলেছি, আমাদের বাজেটটা যথাসম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।’ বলেছি, ‘তাঁরা যেন জনগণের কল্যাণটা দেখেন এবং বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকে। আরও বলেছি যে সময়মতো যেন সবকিছু করা হয়।’
আপনি যা বললেন, সব সরকারেরই দর্শন। বাজেট বাস্তবায়িত না হওয়া নিয়ে সচিবেরা কী সমস্যায় ভোগেন বলে আপনাকে জানিয়েছেন—এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আছে, অনেক কারণ আছে।’ একই আমলাতন্ত্র দিয়ে কি বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবেন—এ প্রশ্নেরও জবাব দেননি অর্থ উপদেষ্টা।
এদিকে ২৬ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চার দিনের সফরে চীন যাচ্ছেন। চীনের সঙ্গে কোনো ঋণ চুক্তি হবে কি না, জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘সেগুলো আমি বলব না। ইআরডি সচিব সে সফরে যাচ্ছেন।’
আগামী বাজেটে কোন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য কত টাকা বরাদ্দ থাকছে, তা ইতিমধ্যে ঠিক করেছে অর্থ বিভাগ। বৈঠকে অংশ নেওয়া তিনজন সচিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ সচিবই আগামী বাজেটে তাঁদের মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন। যেমন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এমপিওভুক্তির জন্য তাদের বাড়তি টাকা লাগবে।
সূত্রগুলো জানায়, অর্থ উপদেষ্টা অপচয় রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে শুধু ভবন নির্মাণ, অর্থাৎ অবকাঠামো তৈরিতে সবাই মনোযোগী। এ অবস্থা আর চলতে দেওয়া যাবে না।
সংশোধিত বাজেট নিয়েও কথা উঠেছে আলোচনায়। সচিবেরা বলেছেন, প্রতিবছরই সংশোধিত বাজেট প্রণয়ন করতে দেরি হয়। এমনকি এবারের সংশোধিত বাজেট হতেও দেরি হচ্ছে। এতে বাজেট বাস্তবায়নে সমস্যায় পড়েন তাঁরা। এমন পরিস্থিতির অবসান চাইলে অর্থ উপদেষ্টা তাতে একমত পোষণ করেন।
আগামী বাজেটকে অংশগ্রহণমূলক করতে পাঁচটি প্রাক্-বাজেট আলোচনার উদ্যোগ দেন অর্থ উপদেষ্টা। প্রথমটি হয় ১৬ মার্চ অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে। এরপর প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক এবং ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে হয় আলাদা দুটি প্রাক্-বাজেট আলোচনা। আজ হয়েছে সচিবদের সঙ্গে। আজ মঙ্গলবার অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সঙ্গে রয়েছে প্রাক্-বাজেট আলোচনা।
আগের আলোচনাগুলোর পর অর্থ উপদেষ্টা যেসব কথা বলেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আগামী বাজেট হবে বাস্তবসম্মত। অহেতুক এর আকার বড় করা হবে না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্থানীয় চাহিদাভিত্তিক প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কোটি কোটি ডলারের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে, এমন ধরনের প্রকল্প নেওয়া হবে না এবং আগামী বাজেট হবে ব্যবসাবান্ধব।
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মুহাম্মদ ইলিয়াসের তাবলিগি দর্শন
মানুষের হৃদয়ে ঈমানের আগুন জ্বালানোর প্রয়াসে শায়খ মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (১৮৮৫-১৯৪৪) গড়ে তুলেছিলেন জামায়াতে তাবলিগ, যা বিশ্বব্যাপী দাওয়াতের এক অপূর্ব নজির। তাঁর বাণী ও উপদেশের সংকলন ‘মালফুজাত’ নামে আরবি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, যা তাঁর দাওয়াতি দর্শন ও তরবিয়তি পদ্ধতির এক জীবন্ত দলিল। দামেস্কের দারুল কলম থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থ, শায়খ আদিল হাররাজি আল-ইয়ামানি আন-নাদভির তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত, তাবলিগ জামায়াতে মূল দর্শনের প্রাথমিক উৎস হিসেবে বিবেচিত। এটি শুধু মুহাম্মদ ইলিয়াসের বাণীর সংকলন নয় বরং একটি ঐতিহাসিক ও দাওয়াতি দলিল, যা আধুনিক ইসলামি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে।
‘মালফুজাত’-এর শিক্ষা
শায়খ মুহাম্মদ ইলিয়াসের মজলিস মালফুজাত সংরক্ষণ করেছেন তাঁর শিষ্য মুহাম্মদ মানজুর। তাবলিগ জামায়াতে ছয়টি মূলনীতি—কালিমা, নামাজ, ইলম ও জিকর, ইকরামুল মুসলিমিন, ইখলাস ও নিয়ত এবং আল্লাহর পথে বের হওয়ার ভিত্তিতে গ্রন্থটি রচিত। তিনি তাওহিদকে (আল্লাহর একত্ব) নাজাতের মূল ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তাওহিদের দুর্বলতা মুসলিমদের অধঃপতনের কারণ’। তিনি ফরজ ইবাদতের প্রাধান্য, জিকিরের প্রাচুর্য এবং তাকওয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরজগুলোর মর্যাদা নফলের চেয়ে অনেক উঁচুতে। নফলের উদ্দেশ্য ফরজগুলোর ঘাটতি পূরণ করা’ (মালফুজাত, দারুল কলম, ২০২৫)।
তাঁর দাওয়াতি পদ্ধতি ছিল সরল কিন্তু গভীর। তিনি আল্লাহর পথে বের হওয়াকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যম হিসেবে দেখতেন, যা তাবলিগের একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি রিয়া (লোকদেখানো) ও বিতর্ক এড়ানোর পরামর্শ দেন, বলেন, ‘ইখলাস (খাঁটি আল্লাহর জন্য) ছাড়া কোনো কাজ কবুল হয় না।’ তাঁর দৃষ্টিতে, দাওয়াতের লক্ষ্য হলো আল্লাহর আদেশকে মানুষের স্বভাবে পরিণত করা, যাতে নিষিদ্ধ কাজ তার কাছে অপছন্দনীয় হয়। তিনি জিকিরকে এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রধান উপায় হিসেবে বিবেচনা করতেন।
শায়খ ইলিয়াসের দাওয়াতি পদ্ধতি ছিল তাওয়াজ্জুহ বা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের পরিবর্তে তাজকিয়া (আত্মশুদ্ধি) ও ইখলাসের ওপর কেন্দ্রীভূত। তিনি জটিল তাত্ত্বিক আলোচনার পরিবর্তে সরল নসিহতের ওপর জোর দিতেন। তাঁর মতে, দাওয়াত হবে এমন, যেন ‘আল্লাহর আদেশ মানুষের স্বভাব হয়ে যায়’। তিনি আল্লাহর পথে বের হওয়াকে তুলনা করতেন সাহাবিদের ত্যাগের সঙ্গে, যা দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক উন্নতি আনে। তিনি বলেন, ‘দাওয়াতে আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার ফরজ, কিন্তু কতজন এই ফরজ পালন করে?’ (মালফুজাত, দারুল কলম, ২০২৫)।
আরও পড়ুনসুরা হুমাজাতে চারটি পাপের শাস্তির বর্ণনা০৬ মে ২০২৫ঐতিহাসিক পটভূমি
মুহাম্মদ ইলিয়াস ভারতের কান্ধলায় একটি আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দেওবন্দি সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে তাঁর শৈশব কাটে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, সাধারণ মুসলিমদের ধর্মীয় অজ্ঞতা এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ তাঁর দাওয়াতি চিন্তার পটভূমি। তিনি বিশ্বাস করতেন, শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মুসলিমদের সংস্কার করতে পারবে না। তাই তিনি একটি জনগণভিত্তিক, বিকেন্দ্রীকৃত আন্দোলন শুরু করেন, যেখানে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা দাওয়াতে অংশ নেয়। তিনি নবীর (সা.) মক্কার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হন, যেখানে তিনি ঘুরে ঘুরে মানুষকে দাওয়াত দিতেন। তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) মক্কায় তাওয়াফ করে মানুষকে হকের দাওয়াত দিতেন’ (মালফুজাত, দারুল কলম, ২০২৫)।
গ্রন্থের গঠন ও সম্পাদনা
মালফুজাত তাঁর মজলিসের সংকলন হলেও এটি একটি সুশৃঙ্খল দাওয়াতি দলিল। সম্পাদনা করেছেন আবুল হাসান আলী নাদভি (রহ.)-এর শিষ্য শেখ আদিল হাররাজি। মুফতি মুহাম্মদ তকী উসমানী, ড. খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানি ও নূরুল হাসান রাশিদ কান্ধলভী প্রমুখের মতো পাকিস্তান ও ভারতের শীর্ষস্থানীয় ইসলামবেত্তাদের ভূমিকা গ্রন্থটিকে মহামূল্য করে তুলেছে। তাদের ভূমিকাগুলো গ্রন্থের দাওয়াতি ও ঐতিহাসিক পটভূমি বুঝতে সাহায্য করবে। আলী নাদভির সঙ্গে মুহাম্মাদ ইলিয়াসের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক এবং তাবলিগের বিশ্বব্যাপী প্রভাবও এতে তুলে ধরা হয়েছে।
আজ যখন মুসলিম বিশ্ব নানা সংকটের মুখোমুখি, এই গ্রন্থ আমাদের তাওহিদ, ইখলাস ও তাজকিয়ার প্রতি ফিরে যেতে আহ্বান জানায়। এটি প্রতিটি দাঈ ও মুসলিমের জন্য একটি পাঠ্য, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনকে জীবন্ত করে তুলতে হবে।’
সূত্র: আল-জাজিরা ডটনেট
আরও পড়ুন সুরা ইউসুফের সারকথা১৫ জুলাই ২০২৪