‘মামলার সাধ মিটাইমু’ বলে একই পরিবারের তিন সদস্যকে কুপিয়ে জখম, মালামাল লুট
Published: 26th, March 2025 GMT
মৌলভীবাজারের জুড়ীতে দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে কাতারপ্রবাসীসহ একই পরিবারের তিন সদস্যকে কুপিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ১৬ লাখ টাকার মালামাল লুটের অভিযোগ উঠেছে।
গতকাল মঙ্গলবার গভীর রাতে উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের হালগরা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আহত ব্যক্তিদের সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন আবদুল মোতালিব (৩৬), তাঁর স্ত্রী রোকসানা বেগম (৩০) ও ভাই আবদুল আজিজ (২৬)। তাঁদের মধ্যে মোতালিব কাতারপ্রবাসী। সম্প্রতি তিনি দেশে এসেছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, গতকাল দিবাগত রাত তিনটার দিকে ছয় সদস্যের একদল দুর্বৃত্ত তাঁদের বসতঘরের পেছনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। এর মধ্যে একজনের মুখোশ পরা ছিল। তাদের হাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের দেশি অস্ত্র। সাহ্রির জন্য ওই সময় পরিবারের কয়েকজন সদস্য জেগে ছিলেন। একপর্যায়ে দুর্বৃত্তরা ‘মামলার সাধ মিটাইমু’ বলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রথমে মোতালিবকে কোপ দেয়। স্বামীকে রক্ষা করতে গেলে তারা রোকসানাকেও কুপিয়ে জখম করে। এ সময় ‘আর মামলা করলে জানে শেষ করি দিমু’ বলেও তারা হুমকি দেয়। এরপর পাশের কক্ষে গিয়ে আবদুল আজিজকেও কুপিয়ে আহত করে তারা। পরে তারা বিভিন্ন কক্ষের আলমারি ও ড্রয়ার ভেঙে প্রায় এক লাখ টাকা, ১০ ভরির মতো স্বর্ণালংকার, ৫টি দামি মুঠোফোন ও ঈদ উপলক্ষে কেনা নতুন জামাকাপড় লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় পরিবারের সদস্যদের চিৎকার ও কান্নাকাটি শুনে আশপাশের লোকজন ছুটে যান। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে পুলিশ।
আজ সকাল সাতটার দিকে ঘটনাস্থলে মোতালিবের মা হাসনা বেগম জানান, তাঁদের বাড়ির সামনের রাস্তা নিয়ে প্রতিবেশী যুক্তরাজ্যপ্রবাসী রফিক মিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। এ নিয়ে মামলা-মোকাদ্দমা হয়েছে। সম্প্রতি সরকারি জরিপকারকের (সার্ভেয়ার) মাধ্যমে মাপজোখ করে তাঁরা রাস্তার মালিকানা বুঝে পান। দুর্বৃত্তরা ঘটনার সময় মামলার কথা উল্লেখ করায় তাঁরা ধারণা করছেন, এ ঘটনার পেছনে প্রতিপক্ষের যোগসাজশ থাকতে পারে।
আজ সকালে অভিযুক্ত রফিক মিয়ার বাড়িতে গিয়ে সেটি ফাঁকা দেখা যায়। তিনিসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও যুক্তরাজ্যে থাকেন। তবে আছকির মিয়া নামের এক ব্যক্তি বাড়িটি দেখাশোনা করেন। তাঁকে খোঁজ করে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।
ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানান জুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদুল আলম ভূঁইয়া। তিনি বলেন, চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আহত ব্যক্তিরা লিখিত অভিযোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নোয়াখালীর কৃষকেরা কেন হাইব্রিড ধানবীজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন
দুই একর জমিতে জিংকসমৃদ্ধ ব্রি-৭৪ জাতের ধান চাষ করেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা এলাকার কৃষক মো. মোস্তফা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি উদ্ভাবিত এই জাতের প্রতি হেক্টরে ফলন হয়েছে ৯ দশমিক ২৩ মেট্রিক টন, যা বাজারে থাকা যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বেশি।
নিজের খেতে চোখজুড়ানো সোনালি ধান দেখে অনেক বেশি উচ্ছ্বসিত কৃষক মোস্তফা। কারণ, বাজার থেকে কেনা হাইব্রিড ধান থেকে বীজ করা যায় না। কিন্তু ব্রি উদ্ভাবিত এই ধান থেকে অনায়াসে বীজ তৈরি করতে পারবেন তিনি। এতে থাকবে না বীজ কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। সেই সঙ্গে ধানগুলো জিংকসমৃদ্ধ হওয়ায় পরিবারের জিংকের ঘাটতিও দূর হবে। মোস্তফা বলেন, আগামী দিনে তিনি আরও বেশি পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ করবেন।
মোস্তফার মতো একই এলাকার আরেক কৃষক ওমর ফারুকও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট(ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ব্রি-৯২ চাষ করেছেন দুই একর জমিতে। বীজ ও সারসহ এ পর্যন্ত তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ হাজার টাকা। খেতের ধান এরই মধ্যে পাকা শুরু করেছে। ফলনের যে অবস্থা দেখছেন, তাতে মনে হচ্ছে, একরে ফলন হবে কমপক্ষে ১৭০ মণ। যার বাজারমূল্য দেড় লাখ টাকার বেশি।
ওমর ফারুকের খেতে ব্রির এই উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ দেখে এরই মধ্যে আশপাশের এলাকার অনেক কৃষক যোগাযোগ করেছেন বীজ নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা হাইব্রিড চাষ করে ঝুঁকিতে পড়তে চান না। নিজের বীজে নিজেই স্বয়ংসম্পন্ন হতে চান। তাই ওমর ফারুক ঠিক করেছেন, উৎপাদিত ধান থেকে ২৫ মণ রেখে দেবেন বীজের জন্য। এই বীজ বিক্রি করে বাড়তি আয় হবে তাঁর।
শুধু কৃষক হাজি মোস্তফা কিংবা ওমর ফারুকই নন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকেরা চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষ করে সফলতার মুখ দেখেছেন। পাচ্ছেন হাইব্রিড ধানের চেয়েও বেশি ফলন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর গ্রামের কৃষক মাহফুজা বেগম ও আশরাফ হোসেন দম্পতির খেতে চাষ করা ডায়াবেটিক রোগীদের সহনীয় ব্রি-১০৫ জাতের ধানের ফলন পাওয়া গেছে হেক্টরপ্রতি ৮ দশমিক ২ টন, যা বাজারের হাইব্রিড বীজের সমান। এই ধানেরও বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন কৃষকেরা।
চলতি বোরো মৌসুমে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে নতুন জাতের ব্রি ধানের ৪৯০টি প্রদর্শনী খামার করেছে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন-পিকেএসএফের স্থানীয় সহযোগী প্রতিষ্ঠান সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব প্রদর্শনীতে ব্রি উদ্ভাবিত ৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। এই জাতের ধানগুলো উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধী এবং বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ।
কৃষকেরা জানান, এত দিন তাঁরা বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড ও দেশীয় উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাতের ধানের বীজ কিনে আবাদ করে আসছেন। এবার এসবের বাইরে ব্রি উদ্ভাবিত উফশী ২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ ধান আবাদ করেছেন অনেকে। এর মধ্যে হাইব্রিড বীজের প্রতি কেজির দাম ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা। আর ব্রির উফশী ধানের বীজ ৫০-১০০ টাকায় পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রতি একর জমিতে চাষ করতে হাইব্রিড ধানের বীজ লাগে ৬ কেজি এবং উফশী জাতের বীজ লাগে ১০ কেজি। এসব বীজের মধ্যে হাইব্রিড প্রতি একরে উৎপাদন হয় ৯০ মণ, উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ব্রি-২৮, ২৯, ৫০ ও ৫৫ উৎপাদন হয় ৭০-৭৫ মণ।
পিকেএসএফের কৃষি ইউনিট পরিচালিত সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার কৃষিবিদ শিবব্রত ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, নোয়াখালী অঞ্চলের ৯৫ শতাংশ কৃষক বোরো মৌসুমে মূলত বাজারের হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভর থাকেন। আর দেশীয় উদ্ভাবিত ব্রি ধান জাত আবাদ করেন মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধান রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অনেক কৃষকই লোকসানের মুখে পড়ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রি উদ্ভাবিত নতুন ব্রি-ধানগুলোর ফলন হাইব্রিডের মতো ফলন দেয় এবং কিন্তু রোগবালাই নেই বললেই চলে। এতে কৃষকের খরচ কমে। লাভ হয়, আর বীজও থাকে নিজের হাতে।
ব্রির উচ্চফলনশীল জাতের নতুন জাতের ধান চাষের কথা বলতে গিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মীরা রানী দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ব্রি-উদ্ভাবিত বিভিন্ন পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ধানগুলো চাষাবাদে কৃষকদের মধ্যে তাঁরা ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করছেন। এর প্রধান কারণ হলো, এসব ধান চাষ করলে একদিকে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ হবে, অন্যদিকে কৃষকেরা নিজেরা নিজেদের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবেন। তা ছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত এসব ধানে রোগবালাইয়ের আক্রমণ হাইব্রিডের তুলনায় কম এবং ফলন হাইব্রিডের সমান কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাইব্রিড থেকেও বেশি।
এ বিষয়ে ব্রির ফেনীর সোনাগাজীর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্রি এ পর্যন্ত ১১৫টি জাত আবিষ্কার করেছে। আগে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যের অভাব দূর করা, ফলন বাড়ানো। বর্তমানে আমাদের উদ্দেশ্য খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা। খাবার যাতে পুষ্টিমানসম্পন্ন হয়। অধিকাংশই আমিষ ও ভিটামিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম এবং ফলমূল। কিন্তু এসব সবাই কিনে খেতে পারেন না। যেহেতু ভাত প্রধান খাদ্য, এখন আমাদের যে জাতগুলো, এগুলো উদ্ভাবনে পুষ্টির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।’ নতুন জাতগুলো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, সেই সঙ্গে হাইব্রিডের প্রতি নির্ভরতা কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।