অন্য দেশ, অন্যের দেশ, কিছু বলা আমার ঠিক না হয়তো! কিন্তু আজ (লিখতে লিখতে এত সময় চলে গেল যে আজ এখন গতকাল হয়ে গেছে) ঢাকায় বকেয়াবেতন চাইতে গিয়ে পুলিশের লাঠি খাওয়ার যে দৃশ্য দেখি, তা কোনো একক দেশের কথা বলে না। এই সময়ের কথা বলে, বর্ডার-অতিক্রান্ত এক ভূগোলের কথা বলে, একটা সিস্টেমের কথা বলে। তারপর দেখি খবর, সন্‌জীদা খাতুন চলে গেলেন। সেও আসলে কোনো একক দেশের খবর না। এই খবরকে আমি আমার মনে মনে জানা-চেনা-কাঙ্খিত বঙ্গদেশের খবর বলে বুঝি। আমার কান তখন এই গানই শুনতে চায়, যে গান আমিও গাই, এই ভাবে পারি না যদিও। 

আমি সন্‌জীদা খাতুনকে আমাদের এখানে, ছোটোদের পাঠশালা শামিলে একাধিকবার দেখেছি, তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রশিক্ষণে যোগ দিয়েছি, অযথা প্রশ্ন করেছি, খানিক ঔদ্ধত্যের সুরে এবং তিনি ধৈর্য্য ধরে উত্তর দিয়েছেন। আমি একমত হইনি। সেই ভিন্নমতে কথা থেমে যায়নি। তার কিছুদিন পর পিঠে ব্যাগ নিয়ে এধার ওধার ফিল্ড রেকর্ডিংয়ে গেছি যখন বাংলাদেশে, ঢাকায় আমাকে এবং আমার সহকর্মীকে হোটেলে ঘর দিতে চায়নি নানাবিধ কাগজপত্র এবং declaration ছাড়া, সন্‌জীদা আপা তখন সস্নেহে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন ছায়ানটের একটা গেস্ট রুমে। (আমাদের আগে দেবেশ রায় ছিলেন সেই ঘরে, যে দেবেশ রায়ের লেখার কেন্দ্রজুড়ে প্রান্ত মানুষের দখল; বাংলার এক অন্য ইতিহাস বলেন তিনি। এই কথা বলে রাখাটাও জরুরি মনে করছি, যেহেতু মানুষ নানান ভাবে কিছু বলা, কিছু বেশি করে বলা আর অনেক কিছু না-বলা দিয়ে ইতিহাস রচনা করে থাকে। তাই কিছু কথার রেকর্ড রেখে যাওয়াটাও জরুরি মনে হয়)। যাই হোক, আমাকে ছায়ানটে আমাদের কাজ নিয়ে বলতে বলেছিলেন সন্‌জীদা খাতুন। 

আমি ১৫-১৬ বছর বা তারও আগের কথা বলছি, ডিটেল কিছু ভুল হয়ে যেতে পারে। এইটুকু অবশ্যই মনে আছে যে, সেদিন নানান কথার ভিতরে আমি রামপ্রসাদী গান, 'আসার আশা ভবে আসা, আসা মাত্র হলো' থেকে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের 'আশায় আশায় বসে আছি, ওরে আমার মন/কখন তোমার আসবে টেলিফোন'- এর জটিল ও সহজ যাত্রাপথের কথা বলেছিলাম, সঙ্গে গান বাজিয়ে শুনিয়েছিলাম। আমার ঢাকার বন্ধুরা অবাক হয়ে বলেছিলেন, 'তুমি ছায়ানটে মহীন বাজায়ে দিলা?! ওরা তো মৌলবাদী, আর এক রকমের মৌলবাদী।' মজা করেই বলেছিলেন জানি, কিন্তু এই বলার ভিতরে একটা ধরে নেওয়াও ছিল। মৌলবাদী? কী জানি? আমি তো তেমন বুঝিনি। I had seen glimpses of a rare open mind--যে মন বহু মনকে ধারণ করতে পারে। এই গেল একটা দিক। আবার, নালন্দায় ছোট ছোট বাচ্চারা যেসব কবিতা বলতো সকালবেলায়, দেশ নিয়ে, স্বাধীনতা নিয়ে, যুদ্ধ নিয়ে, একাত্তরের শত্রুদের নিয়ে- ঘুম ভেঙে তা শুনে আমি ভাবতাম, এ কেমন indoctrination? আবার এও ভাবতাম, আমি কী জানি যুদ্ধের কথা, যুদ্ধ থেকে উঠে আসা দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা? অনেক পরে শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় মোমেনার মায়ের সেই 'থুক দিই থুক দিই' বদদোয়া পড়ে আমার এই চিন্তাই দৃঢ়তা পেয়েছে যে, আমি আসলে সবটা বুঝতে পারবো না। কারণ আমি আসলেই অন্যের কথা বলছি। আমি বাইরের লোক। সব কিছু political correctness দিয়ে বিচার করা যায় না। Political reality and political correctness are not always compatible.

 

যে ব্যক্তিমানুষ এবং সংগঠন ইতিহাসের বহু পর্ব পার করে এসেছে, তার গল্প কোনোভাবেই সহজ সরল হতে পারে না। সে নিরন্তর turmoil-এর ভিতরে থাকে। বিশেষ করে যে মূক থেকে মুখরতার দিকে যাত্রা করেছে, যার ইতিহাস পরাধীনতা, ভাষাহীনতা (silenced/banned period) থেকে গোপন যাপন (underground, subversive life) পার করে স্বাধীন দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠানিক ভাষায় (language of power) রূপান্তরিত হয়েছে, যে জীবন দিয়ে এইসব extreme pointকে ছুঁয়ে এসেছে, সে জানে তার সংকট ঠিক কোথায়। আমি 'তার সংকট'-এ  'তার' শব্দের ওপর জোর দিচ্ছি। রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক একজনের সংকট এক রকমের হয়। যেখানে প্রতিষ্ঠান ব্যাপারটাই নড়বড়ে, state যেখানে fragile, সেখানে প্রতিষ্ঠা সব সময়ই সাময়িক। আমার মনে হয়, যে একবার ভাষা হারিয়েছিল, সে এও জানে যে, কোনো সময় সে আবার সাইলেন্সড্‌ হতে পারে। তখন নিয়মের কড়াকড়ি তার জন্য এক অস্তিত্বের লড়াই হয়ে যায় হয়তো । তখন সে হয়তো কিছুটা অনড়, rigid হয়ে যায়। Discipline, indoctrination become important. 

শুনেছি ছায়ানটের হিজাব নিয়ে নিজস্ব পলিসি ছিল/আছে। এর সত্য মিথ্যা আমি জানি না। কিছু কিছু ভিডিওতে আমি দেখেছি মেয়েরা হিজাব পরে গাইছে। তবে ছায়ানটের বেশির ভাগ মেয়েই মাথা ঢাকে না। এখন, এটা কোনো নিয়মের জন্য নাকি এটা তাদের choice, আমি জানি না। অনেক আগে ঢাকার এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, তার বড় ভাই আর ভাবী গান শিখতে যেতেন ছায়ানটে, কাজ থেকে বাড়ি ফিরে শাড়ি পরে পাজামা পরে যেতে হতো, কারণ তেমনই নিয়ম ছিল (আজও আছে কি না জানি না, হয়তো নেই)। কেন এই কড়াকড়ি? শিখবে তো গানই! আমি হয়তো বুঝতে পারি না। Maybe I can afford not to understand. Not everyone has that choice. 

যেমন ঊর্মিদিরা [ঊমি রহমান] বলতেন, ওঁরা একাত্তর দেখে এসেছেন তাই সালোয়ার কামিজের ব্যাপারে ওঁদের একটা resistance কাজ করে। এখন, একথা আমি তো ঠিক বুঝতে পারবো না। আমি তো কত সময়ই সালোয়ার পরি, আমার বন্ধুরা পরে। ঊর্মিদির resistance আমি কতটা অনুভব করি? আসলে, সংকটের ভিতর দিয়ে না গিয়ে বাইরে থেকে prescription দিয়ে দেওয়াটা  সহজ।বছর খানেক আগে, আমাদের শেষ কথোপকথনে ঊর্মিদি বলেছিলেন, ঢাকায় গিয়ে দেখি, শাড়ি পরা মানুষ কত কম রাস্তায়। আক্ষেপের সুর ছিল ওঁর গলায়। একই মানুষ Nayanika Mookherjee'র  সাম্প্রতিক গবেষণা নিয়ে আলোচনা সভায় চুপ করে ছিলেন এবং শেষে বলেছিলেন, একাত্তর নিয়ে আমি কিছু বলতে পারি না। কষ্ট হয়। এই যে জুলাই-এর পর মানুষ বলছে যে এমনটা যে দেখেছে সে কী করে ভুলে যাবে? কী করে ক্ষমা করবে? বিষয়গুলো ঠিক একই রকম আসলে। হয়তো সে জন্যই inclusivity'র prescriptionটা  বাইরে থেকে দেওয়া যত সহজ, মানুষ ততটা সহজে সব কিছু মেনে নিতে পারে না। তারা আগের সময়ে ফিরতে চায় না, তাই নিয়ম করে আর নিয়মভঙ্গকারীর প্রতি কঠোর হয়। 

এত কিছু ভাবা হয়ে ওঠে না আমাদের। তার চেয়ে ধরে নেওয়াটা সহজ। আমাদের ধরে-নেওয়াগুলো সচরাচর সামাজিক তথা রাজনৈতিক হয় । Sometimes it might be pure ignorance and unintentional, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ধরে  নেওয়া আসলে prejudiceকে প্রকাশ করে, বা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু, অনেক ভয়ঙ্কর কিছু । Something far more sinister, utterly evil. যেমন, ধরে নেওয়া হলো যে একটি মুসলমান ছেলে যখন একটা টিফিন বাক্স খুলছে, তখন তার মধ্যে নিশ্চয় গরুর মাংস আছে। মহান মোদি পোশাক দেখে মানুষকে চেনার নির্দেশ দিয়েছেন । অতএব, ধর ধর, মার মার। অন্য কোথাও কারো কপালের টিপ থেকে ধরে নেওয়া হয় যে সে কতটা অত্যাচারী শাসকের সমর্থক, কতটা ধর্মকক্ষচ্যুত এবং পরদেশমুখী । এমতাবস্থায় কেউ আবার টিপ পরেন লড়াইয়ের চিহ্ন হিসেবে। আমার এক non-Sikh বন্ধু দিল্লীতে শিখ নিধনের পর মাথায় পাগড়ি বাঁধতেন দীর্ঘদিন। সে ছিল এক ধরে নেওয়ার সামনে তাঁর বুক-টানটান দাঁড়ানো। যেমন আবু সাঈদ দাঁড়িয়েছিলেন। সনজীদা খাতুন শুনেছি ঘুমের ভিতরে দেখে নিতেন কপালের  টিপ জায়গা মতন আছে কি না। 

একবার কেতকী কুশারি ডাইসন বলেছিলেন, মনে আছে, যে a monolingual world is a sad world.  এই মর্মেই কিছু বলেছিলেন, আমি হুবহু উদ্ধৃতি দিচ্ছি না। সব কিছুই যে এখন ইংরেজিতে পড়তে হয়, সেই প্রসঙ্গে কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু language বলতে এখানে আসলে মুখের ভাষা যেমন, তেমনি চলনের, বলনের, যাপনের, আরাধ্যের রূপ, রূপহীনতা, প্রার্থনার ভাষা, সবই বোঝায়। অথচ আমরা ভাবি সব এক রকম হয়ে যাওয়াতেই বুঝি শান্তি, সব এক রকম করে ফেলাটাই নিরাপদ। A Country of the Blind বলে H. G. Wells-এর গল্পে যে লোকটা পথ হারিয়ে অন্ধদের দেশে গিয়ে পৌঁছেছিল, সেখানে তার প্রেম হয়েছিল একটি মেয়ের সঙ্গে। সে দেশে সবাই রাতে কাজ করতো আর দিনে ঘুমোত। লোকটি তার প্রেমিকাকে রং-এর গল্প শোনাতো, যে রং মেয়েটি কখনও দেখেনি। তারপর সমাজ বললো, সবই ঠিক আছে, কেবল ওর চোখ দুটোতেই সমস্যা, সেগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। তখন, সেই চোখ বন্ধ করে দেবার আগের রাতে, লোকটি আবার পথ ধরলো। এ দেশ তার জন্য নয়। 

সনজীদা খাতুনের 'এখনো গেল না আঁধার' গানটি ২০০১-এ কলকাতায় গেয়েছিলেন, তার আগে ঢাকার রমনা বটমূলে ২০০১-এর ১৪ই এপ্রিল ছায়ানটের পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সময় মঞ্চের ঠিক সামনেই পর পর দুটি শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৯২-এ অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধবংস হয়েছিল, তার দশ বছর পর ২০০২-এ গুজরাতে গোধরার ট্রেনে আগুন এবং গোধরা-পরবর্তী মুসলমান নিধনযজ্ঞ ঘটবে। এই গান এমনই একটি সময়ে গাওয়া হয়েছিল। কিছুদিন আগে বন্ধু অলকানন্দা গুহ এই ফেসবুকেই একটি পোস্টে লিখেছিলেন এই রেকর্ডিং-এর ইতিহাস: '[রমনার বিস্ফোরণের] কিছুদিন পর কলকাতার উপকণ্ঠে উত্তরপাড়ায় আয়োজিত রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের এক বিপুল সমাবেশে আমন্ত্রিত হয়ে আসেন ছায়ানটের কর্ণধার রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সনজীদা খাতুন। দেড়ঘন্টার সেই বিদ্যুৎস্পর্শী একক সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু করেছিলেন তিনি এই গানটি দিয়ে। "এখনো গেল না আঁধার"। 

অবশ্যই শুরুতে ঐ বিস্ফোরণ-কাণ্ডের উল্লেখ করে, ঘটনাটির ঐতিহাসিক রাজনৈতিক তাৎপর্যের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে।
এই রেকর্ডিংটি অমিতেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে ঠিক পরের দিন উত্তরপাড়ারই এক স্টুডিওয় গৃহীত হয়, আরো নটি গানের সঙ্গে। [...] আজকের দিনে, [...] স্মরণ করা যাক্  সংকটে-সম্পদে যুদ্ধে-শান্তিতে পথ হারানো মানব আত্মার এই আর্তনাদ, এই আহ্বান।'

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ম ত চ রন র জন ত ক বল ছ ল ন ছ য় নট আম দ র র কর ড ক রকম

এছাড়াও পড়ুন:

খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা শুরু

সব জল্পনার অবসান হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সোমবার বিএনপি ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে দলের দুই শীর্ষ নেতার নির্বাচন করা এবং তাঁদের নির্বাচনী আসনগুলো নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচন করবেন।

তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, অনেক আগে থেকেই এমন আলোচনা আছে। তবে অসুস্থতার কারণে এবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। আবার তাঁর নিজেরও নির্বাচন করার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।

দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী শঙ্কা, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে রাজি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নেতা-কর্মীরা আনন্দিত।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নানা কারণে আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে নির্বাচনের গুরুত্বটা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে, সেটা মোকাবিলায়ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রভাব ফেলবে।

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সোমবার ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাকি ৬৩টি আসনে প্রার্থিতা পরে ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থগিত রাখা কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।

ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যরা হলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), আবদুল মঈন খান (নরসিংদী-২), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), ইকবাল হাসান মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা-৩) এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন (দিনাজপুর-১)।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। প্রয়োজন বোধ করলে স্থায়ী কমিটি প্রার্থিতা পরিবর্তন করতে পারবে।

এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রার্থী ঘোষণার আগে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সভা হয়। সেখানে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকেরাও উপস্থিত ছিলেন।

এবারের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁকে ফেনী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে, সে আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব, সালাম জানাব।’

যে কারণে ঢাকার সাতটি আসন ফাঁকা

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনী সমঝোতার জন্য আসনগুলোতে প্রার্থিতা স্থগিত রাখা হয়েছে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাতটি আসনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের জন্য অন্তত তিনটি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নামও আছে।

তবে এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

ঢাকা-৯ আসন স্থগিত রাখা হলেও সেটা কার জন্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খানকে (সোহেল) প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলে আলোচনা আছে।

ঢাকা-১৪: মায়ের ডাক-এর সানজিদা

ঢাকা-১৪ আসনে এবার প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এস এ খালেকের ছেলে এস এ সিদ্দিক (সাজু)। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ব্যক্তিদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামকে (তুলি) প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। এই আসনে ইতিমধ্যে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান)। তিনি আট বছর গুম ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে দলটি অভ্যন্তরীণ জরিপসহ সাংগঠনিক উপায়ে প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম প্রকাশ করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল বিএনপি।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিগত ১৫-২০ বছর ভোট দিতে পারেনি। এখন জাতি উৎসাহিত হচ্ছে ভোটের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি পূরণ করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করে একটা বড় পদক্ষেপ নিল। ইতিমধ্যে অনেকে মাঠে চলে গেছেন, এ ঘোষণার পর বাকিরাও মাঠে যাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে।

১০ নারী প্রার্থী

ঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন দশজন। এর মধ্যে অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকিরা হলেন সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর, ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, যশোর–২ আসনে সাবিরা সুলতানা, ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম ও নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন।

মনোনয়ন না পেয়ে দুই মহাসড়ক অবরোধ

মাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করে কামাল জামান মোল্লাকে। এর প্রতিবাদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা রাত আটটার দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর অনুসারীরা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ