ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপার রিখটার স্কেল কী, কীভাবে এল
Published: 30th, March 2025 GMT
প্রতিবেশী মিয়ানমারসহ আটটি দেশে গত শুক্রবার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এই ভূমিকম্পে হাজারো মানুষ মারা গেছে। ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি, এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৭।
কোথাও ভূমিকম্প আঘাত হানলে তার মাত্রা বোঝাতে রিখটার স্কেলের কথা বলা হয়। এটা দিয়ে আমরা ধারণা পাই, ভূমিকম্পটা কতখানি শক্তিশালী বা দুর্বল ছিল।
রিখটার স্কেল কীভাবে ভূমিকম্পের তীব্রতা নির্ধারণ করে আর এটির ব্যবহার কবে থেকে শুরু হলো, তা নিয়ে কমবেশি কৌতূহল রয়েছে পাঠকের মধ্যে।
রিখটার শব্দটি এসেছে মার্কিন ভূকম্পবিদ (সিসমোলজিস্ট) চার্লস রিখটারের নাম থেকে। তিনি ও তাঁর জার্মান-আমেরিকান সহকর্মী বেনো গুটেনবার্গ মিলে ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপার যন্ত্র আবিষ্কার করেন ১৯৩৫ সালে। সে হিসাবে রিখটার স্কেলের বয়স হয়েছে প্রায় ৯০ বছর।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জো জেনস তাঁর ‘ডকুমেন্টস দ্যাট চেঞ্জড দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক পডকাস্টে বলেছেন, রিখটার মূলত একজন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ ছিলেন। তাঁর আগ্রহের অন্যতম জায়গা ছিল ভূমিকম্পের উৎসমূল খুঁজে বের করা। তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণে প্রথম বুঝতে পারেন, উৎসস্থল থেকে আপনি যত দূরে যাবেন, ভূমিকম্পের তীব্রতা তত কমে আসবে।
পাশাপাশি ভূমিকম্পে কতটা শক্তি নির্গত হয়, সেটাও পরিমাপ করে ফেলেন রিখটার। রিখটার মূলত তাঁর স্কেলের ব্যবহার শুরু করেন ১৯৩২ সালে। তারপর তাঁর পর্যবেক্ষণ নিয়ে সিসমোলজিক সোসাইটি অব আমেরিকার বার্ষিক বুলেটিনে একটি লেখা প্রকাশ করলে তা সবার কাছে স্বীকৃতি পায়।
পডকাস্টে রিখটারের বেশ কিছু ব্যক্তিগত তথ্যও দেওয়া হয়েছে। যেমন রিখটার ছিলেন একজন কবি। তাঁর এসপারগাস সিনড্রোম (অস্বাভাবিক স্বরে কথা বলা) ছিল। তিনি ছিলেন নগ্নতাপ্রিয় মানুষ। পিতার সঙ্গে জীবনে একবারই দেখা হয়েছিল রিখটারের। কৈশোরে কিছু সময় তাঁকে স্বাস্থ্যনিবাসে কাটাতে হয়েছিল।
পডকাস্টে বলা হয়, রিখটার ছিলেন কয়েকজন ভূকম্পনবিদের একজন, যাঁরা ভূকম্পবিদ্যাকে একটি বৈজ্ঞানিক ধারার মধ্যে সুবিন্যস্ত করেছিলেন। রিখটার স্কেল আবিষ্কারের পর রিখটার ভবন বিধিমালার উন্নয়ন ও ভূমিকম্পের জন্য প্রস্তুতিবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।
আরেকটি তথ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ইনস্যুরেন্স দাবি আদায়ের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জিওভেরা জানায়, রিখটার ও গুটেনবার্গ দুজন যৌথভাবে রিখটার স্কেল তৈরি করেন। তবে সেটার নামকরণ করা হয় রিখটারের নামে।
রিখটারের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে। পড়াশোনা করেছেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে ভূকম্পবিদ্যা নিয়ে তাঁর আগ্রহ জন্মে। স্ট্যানফোর্ডের পাঠ শেষ করে তিনি চলে যান ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ভূকম্পনবিদ গুটেনবার্গের সঙ্গে। তাঁরা দুজন মিলে ভূকম্পনে কী পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, সেটার ব্যাপকতা কীভাবে নির্ধারণ করা যায়, তা নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে সফলভাবে তাঁরা রিখটার স্কেল তৈরি করেন, যা এখন সবাই ব্যবহার করছে।
রিখটার স্কেল কীভাবে ভূমিকম্প পরিমাপ করে
রিখটার স্কেল ভূমিকম্পের মাত্রা মাপার একটি পদ্ধতি, যা ভূমিকম্পের শক্তি বা কম্পনের তীব্রতা পরিমাপ করে।
যখন ভূমিকম্প হয়, তখন ভূপৃষ্ঠ কাঁপতে থাকে। এই কম্পন সিসমোগ্রাফ নামের একটি যন্ত্র রেকর্ড করে। যন্ত্রে কম্পনের ‘অ্যামপ্লিটিউড’ বা বিস্তার পরিমাপ করা হয়। সিসমোগ্রাফ কম্পনের সর্বোচ্চ উচ্চতা মাপে, যা ভূমিকম্পের শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত।
রিখটার ও গুটেনবার্গ ভূমিকম্পের শক্তি নির্ধারণের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বিশেষভাবে উড-অ্যান্ডারসন টর্শন সিসমোমিটার ব্যবহার করে ভূমিকম্প তরঙ্গ রেকর্ড করেন।
ভূকম্পনের সর্বোচ্চ কম্পনমাত্রা পরিমাপ করে এবং ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল থেকে দূরত্ব হিসাব করে, রিখটার ও গুটেনবার্গ একটি লগারিদমিক স্কেল তৈরি করেন। এই স্কেলে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত ভূমিকম্পকে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সম্পূর্ণ সংখ্যার বৃদ্ধি ভূমিকম্পের কম্পনমাত্রায় ১০ গুণ বেড়ে যায় এবং সেটার ধ্বংসাত্মক শক্তি বাড়ে ৩১ দশমিক ৬ গুণ।
প্রাথমিকভাবে রিখটার স্কেলটি শুধু দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য নকশা (ডিজাইন) করা হয়েছিল। তবে এটি কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্প পরিমাপের মানদণ্ড হিসেবে গৃহীত হয়।
পরবর্তীকালে ভূকম্পবিদেরা রিখটার স্কেলের কিছু সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য মোমেন্ট ম্যাগনিচিউড স্কেল (Mw)-সহ অন্যান্য স্কেল তৈরি করেন, বিশেষত বৃহৎ ভূমিকম্পগুলো পরিমাপের জন্য। তা সত্ত্বেও রিখটার স্কেল এখনো ভূকম্পবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
রিখটার স্কেলের আগে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে ভূমিকম্প মাপা হতো। এর মধ্যে রয়েছে মার্কেলি ইনটেনসিটি স্কেল (১৯০২), রসি ফরেল স্কেল (১৮৭৩) ও চীনের হিস্টরিকাল মেথড। এগুলো মূলত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে ভূমিকম্পকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করত। এ পদ্ধতিতে ভূমিকম্পে কত শক্তি নির্গত হয়, সেটা বের করা যেত না। এগুলো অবশ্য নির্ভুল পরিমাপও ছিল না।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ