অলাত এহ্সান: ৯০তম জন্মদিনে আপনি ছায়ানট-এ গেয়েছিলেন।

ন্‌জীদা খাতুন: হ্যাঁ, খালি গলায় একটা দৃষ্টান্ত দিয়েছিলাম আরকি। ঘরে বসে গাই নিজের মতন করে, কারণ গানের স্কেলটা লো হয়ে গেছে। এই স্কেলে কেউ বাইরে গাইবে না। তবে গাইলে গাওয়া যায়।

দেখো, আমার সবচেয়ে ভালো সময় কাটে ছায়ানটের যারা রবীন্দ্রসংগীতের শিক্ষক, তারা আমার কাছে আসে সপ্তাহে চার দিন। ওদের আগেই আমি একটা গান দিয়ে রাখি, ওরা তুলে আসে। সঠিক স্কেলে সবাই তুলে আসতে পারে না সব সময়। সেগুলো বোঝাতে হয়। স্পর্শস্বরকে অর্ধস্বর করে ফেলে, অর্ধস্বরকে স্পর্শস্বর করে ফেলে। এগুলো বোঝাতে হয়। বোঝাই, তাদের গানের বিশ্লেষণ করি। গানে নিয়ে মোটিভেশনের কথা বলতে হয়। এসব বলে, করে আমার সময় কেটে যায়।

আব্বা অনেক গান শুনতেন। গুনগুন করতেন, তবে তাঁর সুর ঠিক থাকত না, তালও ভালো পরাতেন না। আমরা শুনে হাসতাম।

অলাত: আপনার কি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে গান শেখার সুযোগ হয়েছিল?

সন্‌জীদা খাতুন: নজরুলকে আমি দেখিইনি। আমি তখন অনেক ছোট। নজরুলের জীবনের প্রেমের এক অধ্যায় বইটা যিনি লিখেছেন, আমাদের সৈয়দ আলী আশরাফ, বাবাকে লেখা নজরুলের চিঠিগুলো তিনি আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, নিয়ে বইটা তিনি লিখেছিলেন। সেই বইতে আমাদের পরিবারের একটা ছবি আছে, সেখানে আমার ওপরের যে বোন, সে নজরুলের কোলে বসে আছে। আমার তখন জন্ম হয়নি। বড়দি নজরুলের কোলে বসে গান শিখেছেন, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই.

..’ ওকে কোলে বসিয়ে সভায় গাইয়েছেন।

বর্ধমান হাউসের (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) একটা পুকুর ছিল, এখনো আছে, প্রায় মজে গেছে, ওই পুকুরটার ধারে বসে নজরুল রাত ১২টায় বাঁশি বাজাতেন। বাবা তো নজরুল বলতে অজ্ঞান ছিলেন, বন্ধু, মতিহার। বাবাকে তিনি ডাকতেন ‘মতিহার’। বলতেন, তোমার নাম মোতাহার কে রেখেছেন? তুমি তো মতিহার।

বড়দি একবার ওই পুকুরে গোসল করতে গিয়ে তাঁর হাতের সোনার বালা পড়ে গিয়েছিল। নজরুল সেই রাত ১২টায় ঘাটে বসে বাঁশি বাজাতে বাজাতে দেখেন কি, তলায় কী চকচক করছে। ডুব দিয়ে তুলে নিয়ে এসেছেন বালাটা।

অলাত: পরিবারের ভেতর নারীদের, মানে আপনাদের বিকাশ কেমন ছিল?

সন্‌জীদা খাতুন: আব্বা আমার অনেক পরিচর্যা করেছেন। আমি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত উনার কোলে উঠে পড়েছি। তাঁর ধারণা হয়েছিল, আমার সাহিত্য বোধ আছে। আর আমার সেজদি ছিলেন, আব্বা মনে করতেন, তাঁরও সাহিত্য বোধ আছে। তাঁর যে বইটা সঞ্চরণ নামে, ওই বইটা আমাকে আর আমার সেই বোনকে উৎসর্গ করেছিলেন। ছোট থেকেই সেই বই পড়েছি।

যা কিছু লিখতাম, আব্বাকে দেখাতম। কবিতা লিখলে দেখাতাম। এমনি ছন্দে কবিতা লিখলে তাঁর আপত্তি ছিল না। একবার গদ্য কবিতা লিখেছি। দেখে বললেন, এটা কী হয়েছে, ঘোড়ার ডিম! আমাদের একটা বেলগাছ ছিল, তার পাতার ফাঁকে ফাঁকে জালের মতো তলায় ছায়া পড়েছিল। খুব ভালো লাগছিল। সেই অনুভূতি নিয়েই একটা কিছু লিখেছিলাম। আব্বা এমন বললেন যে জন্মেও আর গদ্য কবিতা লিখতে যাইনি। তিনি তো একটু সেকেলে।

অলাত: আপনার বাবা কাজী মোতাহার হোসেন কি অনেক গান শুনতেন?

সন্‌জীদা খাতুন: আব্বা অনেক গান শুনতেন। গুনগুন করতেন, তবে তাঁর সুর ঠিক থাকত না, তালও ভালো পরাতেন না। আমরা শুনে হাসতাম।

অলাত: কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, তিনি নাকি একাধিকবার ‘এই কাজীর’—কাজী মোতাহার হোসেন—সঙ্গে দাবা খেলার জন্যই ঢাকা এসেছেন?

সন্‌জীদা খাতুন: আব্বা নজরুলের সঙ্গে দাবা খেলেছেন খুব। তাঁকে একবার বোধ হয় ইন্টারন্যাশনাল একটা দাবা প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে ছিলেন। ভালোবাসতেন তো। নজরুল তো আব্বাকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখেছিলেন।

রণজিৎ অধিকারী: মুসলিম সাহিত্য সমাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন—কাজী আবদুল ওদুদ, মোতাহার হোসেন চৌধুরী। তাঁরা কি আসতেন আপনাদের বাসায়?

সন্‌জীদা খাতুন: কাজী আবদুল ওদুদকে আবার আব্বা ভীষণ ভালোবাসতেন। তাঁরা কিন্তু একই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। আব্বা তাঁকে চাচা বলতেন, গ্রাম সম্পর্কে চাচা। কোনো আত্মীয়তার সম্পর্কও থাকতে পারে। আমার আব্বা কাজী আবদুল ওদুদকে পায়ে ধরে সালাম করতেন। খুবই সম্মান করতেন। আর কাজী আবদুল ওদুদ, আমার মনে আছে, কলকাতায় একবার তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। আমার আব্বা তো ঢাকায়, আমি কলকাতায় থেকেছি তো, খোঁজখবর করে গেছি সেখানে।

রণজিৎ: ১৯৫২ সালে, ২১ ফেব্রুয়ারির পরের দিন সম্ভবত, আপনি একটা জায়গায় হেঁটে গিয়ে সভা করলেন, সেখানে আপনার মা বোধ হয় সভাপতি ছিলেন।

সন্‌জীদা খাতুন: হ্যাঁ। সভাপতি করেছিলেন মাকে, সবাই মিলে। সেই তো প্রথম গুলিবর্ষণ ঢাকায়, ভয়েই সবাই কাতর। আমি হেঁটে যাচ্ছি, আমার মা দেখছেন, মেয়েটা তো জেদি আছে! তখন চট করে আমার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলেন। পথে পুরানা পল্টনের ওখানটায়, তখন পুরানা পল্টনে মিটিং-সিটিং হতো—ওইখানে সব মিলিটারি ট্রাক থাকত। আর ট্রাকে সব অবাঙালি মিলিটারি ডিউটিতে। তারা আমাদের দুই মহিলাকে হেঁটে যেতে দেখে, আমাদের ভয় দেখানো জন্য মাটিতে খুব পা দাপাচ্ছে। আমার মা তা দেখে উল্টো দিকে দৌড় দিলেন। আমি ঘুরে মাকে দেখলাম, দেখে আবার চলতে থাকি। মা আবার ঘুরে দেখেন যে আমি হাঁটছি, আবার তিনি হাঁটলেন আমার সঙ্গে। এই করে গিয়েছিলেন। তাই বলে মা তো রাজনীতির কিছুই বোঝেন না। একেবারে গৃহিণী, আর মেয়ের জন্য সঙ্গে গেছেন। কিন্তু সেখানে বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন, বেগম দৌলতুন্নেছা ছিলেন, রোকাইয়া আনোয়ার বলে একজন ছিলেন। অনেক ভালো ভালো নাম করা লোকজন থাকতেও কেউ সভাপতি হতে চান নাই।

অলাত: সাংস্কৃতিক চর্চার কারণে বেগম সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম—তাঁদের পরিবারের সঙ্গে তো আপনাদের সখ্য ছিল।

সন্‌জীদা খাতুন: হুম। সুফিয়া কামাল আবার আমার বাবাকে ‘আব্বু’ বলতেন। আমরা সবাই তাঁকে খালাম্মা বলতাম। আর তাঁর মেয়েরা—লুলু, আমার কাছে আসতই। আর ছোটটা, সুলতানা কামাল, টুলু, ও তো শান্তিনিকেতনে গেল একবার, নয় মাসের কোর্স করতে গেল কলাভবনে। শান্তিনিকেতনে আমার একটা রুম ছিল, ও আমার রুমেই কাটিয়েছে সারা সময়, থেকে গেছে আমার কাছে।

একবার খালাম্মা গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে, বেড়াতে। আমরা গেলাম। সবাই মিলে পার্কে যাব আরকি। তখন আমি হাঁটতে পারছিলাম না, খালাম্মাও হাঁটতে পারেন না। একটা চৌবাচ্চা দেখে, চৌবাচ্চার ধারে বসেছিলাম। আমার খারাপ লাগছে, খালাম্মা হরিণ দেখতে টিআর পার্কে যেতে পারলেন না। আমি তখন গান গাইছি। এমন সময় খালাম্মা আমার গায়ে হাত দিয়েছেন। তাকিয়ে দেখি হরিণ এসে চৌবাচ্চায় পানি খাচ্ছে। খালাম্মার হরিণ দেখা হয়ে গেল। হরিণ এ রকমই, গান শুনে যে ওরা কত কাছে আসে, এ অভিজ্ঞতাও হলো।

অলাত: আর জাহানারা ইমাম?

সন্‌জীদা খাতুন: জাহানারা ইমাম থাকতেন বোধ হয় আজিমপুরের ১৫ নম্বর বিল্ডিংয়ে। আর আমার বড়দি থাকতেন তার নিচতলায়, ওটা কলোনি। দাওয়াতে-টাওয়াতে বড়দি তাঁর বাসায় যেতেন। তিনি আবার ভীষণ সোশ্যাল ছিলেন। তিনি রেডিওতে প্রোগ্রাম করতেন, রেডিওর লোকদের সব দাওয়াত করতেন। বড়দি সেখানে খুব ইজি ফিল করতেন না।

জাহানারা ইমামকে আমি খুব খুব শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর যে একাত্তরের দিনগুলি, সেটা তো বটেই, তার আরেকটা বই আছে অসাধারণ, অন্য জীবন।

অলাত: রণেশ দাশগুপ্ত, সত‍্যেন সেনের সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু একই সময়ে আপনারা ছায়ানট করছেন, আর তাঁরা রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী করছেন।

সন্‌জীদা খাতুন: উদীচীর অনেক অনুষ্ঠানে অনেক বক্তৃতা করেছি, অনেক উপদেশ দিয়েছি ওদের। অনেক দিন উপদেষ্টা ছিলাম। কিন্তু এরপরে, কিছু দিন আগে, উদীচীর ভেতর এত নোংরামি দেখে, অনেক গোলমাল, আমি বলেছি, আমাকে তোমরা কোনো কিছুতে ডাকবে না, কোনো কিছুতে রাখবে না। ওরাও আমার ওপর চটা।

সত্যেনদা এখান থেকে শান্তিনিকেতনে চলে গিয়েছিলেন কেন? কারণ, রাজনীতিতে তিনি কোনো পরিষ্কার রাস্তা দেখছিলেন না, তিনি যেখানে রাজনীতি করতেন। সারা জীবন তো কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, রণেশদাও করেছেন, তিনিও করেছেন। আসলে সত্যেন সেন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ওখানে, শান্তিনিকেতনে। কারণ, এখানে আর থাকা যাচ্ছিল না। রণেশদাও তা–ই। রণেশদা কলকাতার যেখানে ছিলেন, সেই জায়গাটা আমি চিনি। কারণ, ওখানে আমরা রিহার্সাল করতাম, মুক্তিযুদ্ধের গানের।

অলাত: রণেশ দাশগুপ্ত সম্ভবত আত্মীয়ের কাছে থাকতেন!

সন্‌জীদা খাতুন: না, বোনের কাছে থাকতেন সত্যেনদা। আর রণেশদা একটা খালি পোড়োবাড়ির মতো বাড়িতে থাকতেন, পরে। আগে হয়তো বোনের বাড়ি বা কারও কাছে থাকতেন, জানি না। ওই বাড়িটার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সিঁড়িটা কাঁপত। আর মেঝেগুলো ছিল সব ফাটা। ওই বাড়িতে থাকতেন রণেশদা। আর কী যে দুর্দশা ছিল ওখানকার টয়লেটের। ওখানে তাঁদের পক্ষেই থাকা সম্ভব।

অলাত: এখন সেভাবে শিল্পী হচ্ছে না, সবাই পারফমার হয়ে যাচ্ছে—ছায়ানটে এই ধরনের সমস্যা আছে?

সন্‌জীদা খাতুন: না, শিল্পীও হচ্ছে কিছু। ছায়ানট থেকে ইফ্ফাতারা দেওয়ান, সেলিনা মালেক চৌধুরীর গলা ছিল, নষ্ট হয়ে গেছে। বেনু যাকে বললাম সেই মাহমুদুর রহমান, তারপরে শাহীন মাহমুদ—তখন মাহমুদ ছিল, এখন অন্য রকমের নাম নিয়েছে—এ রকম অনেকে আছে। এই যে শাকিল (খায়রুল আনাম), নজরুলগীতি গায় এখন, ছায়ানটে শিখেছে। ছায়ানট থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিদেশে ছিল প্রায় আঠারো বছর, ফিরে এসে আবার ছায়ানট। ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক ছিল পঁচিশ বছর।

অলাত: ছায়ানটের শুরুর দিকে সন্তোষ গুপ্ত, কলিম শরাফী কি যুক্ত ছিলেন?

সন্‌জীদা খাতুন: সন্তোষ গুপ্তের সঙ্গে আমার ততটা যোগাযোগ ছিল না। যদিও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে একটা বই বের হয়েছে। তাতে রেকর্ড করা আমার একটা গান আছে। সন্তোষ গুপ্ত করতেন কি, আমার গান পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, কলিম শরাফীর গান শোনো, যেন কথা বলছে, এত সুন্দর। কলিম শরাফীর তো তুলনা নেই। ভরাট গলা। গলার আলাদা একটা ব্যাপার ছিল—অর্থ বুঝে বুঝে হয়।

আমার বয়স তো তখন অনেক কম। আমি গান করি একটা মিনমিনে গলা, সমু গলা, তাঁর পছন্দ ছিল না। সেটা আমি জানতাম। বলেছিলেন একবার। তাঁর সঙ্গে আমার সে রকম ঘনিষ্ঠতা কখনো হয়নি।

অলাত: কলিম শরাফীর সঙ্গে আপনার হৃার্দিক সম্পর্ক ছিল নিশ্চয়?

সন্‌জীদা খাতুন: কলিম শরাফী আমাকে গান শিখিয়েছিলেন। সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল ১৯৫৪ সালে, সাহিত্য সংসদ থেকে। সেই অনুষ্ঠানে গাওয়ার জন্য আমাকে অনেক কথা বলেছিলেন। তিনি অনেক কথা বলতেন, যেগুলো আমার ভালো লাগত। তাঁর আছে বেশি করে গান শিখেছিল আমার ছোট বোন ফাহমিদা। আমি ততটা সুযোগ পাইনি। আসলে আমি অর্গানাইজেশন নিয়ে এত বেশি ব‍্যস্ত থাকতাম সব সময়।

অলাত: সাংস্কৃতিক চর্চার বলি আর আন্দোলনের ঝান্ডা বলি, ছায়ানট তো নিজেই বড় একটা কেন্দ্র।

সন্‌জীদা খাতুন: হ্যাঁ। বড় একটা প্রতিষ্ঠান। ওটা হচ্ছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলে, ওই যে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন, তিনি আমাকে খবর পাঠিয়েছিলেন, বলেছিলেন, কি সুফিয়া কামাল আর সন্‌জীদা খাতুন ছায়ানট করবে? ওটা (ছায়ানট) আমার হাতে দিক, দেখিয়ে দেব। এ কথাটা আমাকে চা খেতে ডেকে বলেছিলেন শামসুল হুদা চৌধুরী। লায়লা আঞ্জুমান আরার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল তখন। আমরা শুনলেই দিগ্‌বিদিক তাকাতাম। কারণ, সরকারের সঙ্গে ঘেঁষা মানেই একটা ছাপ পড়ে যাওয়া। আমরা কখনোই কোনো সরকারের সঙ্গে ঘেঁষিনি।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বল ছ ল ন নজর ল র আম র স অন ক গ ছ য় নট থ কত ন র আম র র জন ত হয় ছ ল আম দ র র একট বলত ন একব র করত ন আপন র

এছাড়াও পড়ুন:

খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা শুরু

সব জল্পনার অবসান হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সোমবার বিএনপি ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে দলের দুই শীর্ষ নেতার নির্বাচন করা এবং তাঁদের নির্বাচনী আসনগুলো নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচন করবেন।

তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, অনেক আগে থেকেই এমন আলোচনা আছে। তবে অসুস্থতার কারণে এবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। আবার তাঁর নিজেরও নির্বাচন করার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।

দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী শঙ্কা, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে রাজি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নেতা-কর্মীরা আনন্দিত।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নানা কারণে আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে নির্বাচনের গুরুত্বটা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে, সেটা মোকাবিলায়ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রভাব ফেলবে।

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সোমবার ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাকি ৬৩টি আসনে প্রার্থিতা পরে ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থগিত রাখা কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।

ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যরা হলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), আবদুল মঈন খান (নরসিংদী-২), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), ইকবাল হাসান মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা-৩) এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন (দিনাজপুর-১)।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। প্রয়োজন বোধ করলে স্থায়ী কমিটি প্রার্থিতা পরিবর্তন করতে পারবে।

এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রার্থী ঘোষণার আগে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সভা হয়। সেখানে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকেরাও উপস্থিত ছিলেন।

এবারের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁকে ফেনী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে, সে আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব, সালাম জানাব।’

যে কারণে ঢাকার সাতটি আসন ফাঁকা

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনী সমঝোতার জন্য আসনগুলোতে প্রার্থিতা স্থগিত রাখা হয়েছে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাতটি আসনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের জন্য অন্তত তিনটি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নামও আছে।

তবে এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

ঢাকা-৯ আসন স্থগিত রাখা হলেও সেটা কার জন্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খানকে (সোহেল) প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলে আলোচনা আছে।

ঢাকা-১৪: মায়ের ডাক-এর সানজিদা

ঢাকা-১৪ আসনে এবার প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এস এ খালেকের ছেলে এস এ সিদ্দিক (সাজু)। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ব্যক্তিদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামকে (তুলি) প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। এই আসনে ইতিমধ্যে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান)। তিনি আট বছর গুম ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে দলটি অভ্যন্তরীণ জরিপসহ সাংগঠনিক উপায়ে প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম প্রকাশ করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল বিএনপি।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিগত ১৫-২০ বছর ভোট দিতে পারেনি। এখন জাতি উৎসাহিত হচ্ছে ভোটের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি পূরণ করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করে একটা বড় পদক্ষেপ নিল। ইতিমধ্যে অনেকে মাঠে চলে গেছেন, এ ঘোষণার পর বাকিরাও মাঠে যাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে।

১০ নারী প্রার্থী

ঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন দশজন। এর মধ্যে অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকিরা হলেন সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর, ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, যশোর–২ আসনে সাবিরা সুলতানা, ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম ও নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন।

মনোনয়ন না পেয়ে দুই মহাসড়ক অবরোধ

মাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করে কামাল জামান মোল্লাকে। এর প্রতিবাদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা রাত আটটার দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর অনুসারীরা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ