এই গল্পটি যেমন শিক্ষণীয়, তেমনি উপভোগ্যও। রাসুল (সা.) তখন প্রায় ৫০ বছর বয়সী। দশ বছর ধরে তিনি ইসলাম প্রচার করেছেন। তাঁকে চরম বিরোধিতা, নির্যাতন ও নানা রকম কষ্টের মুখোমুখি হতে হচ্ছিল। তবু তিনি কখনো করুণা, ধৈর্য কিংবা সহনশীলতা হারাননি।

একদিন তিনি মক্কার বাইরে হাঁটছিলেন। হঠাৎ তাঁর সামনে পড়ল রুকানা নামে বিখ্যাত এক ব্যক্তি। রুকানা ছিল কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে বলশালী, সেরা কুস্তিগির। রুকানা মহানবীকে (সা.

) ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করত না; তবে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকে সে দ্বিধা ও সংশয়ে ছিল। সে বুঝতে পারত না নবীজি (সা.) আসলে কী প্রচার করছেন।

মহানবী (সা.) তাকে দেখে বললেন, ‘রুকানা, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।’

রুকানা বলল, ‘তা হলে চলো, আগে কুস্তি লড়ি, তারপর কথা হবে।’

আরও পড়ুনতিরন্দাজ এক সাহাবী১৩ নভেম্বর ২০২৩

নবীজি (সা.) হাসিমুখে বললেন, ‘ঠিক আছে, কুস্তি হোক।’

উভয়ে প্রস্তুত হলেন, কুস্তি শুরু হলো। রাসুল (সা.) রুকানাকে এক চাপে মাটিতে ফেলে দিলেন। রুকানা বিস্ময়ে হতবাক! সে জীবনে কখনো হারেনি। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আবার হোক।’

দ্বিতীয়বারও রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে মাটিতে ফেলে দিলেন। রুকানা এবার পুরোপুরি হতবাক। সে বলল, ‘আরও একবার!’

রাসুলুল্লাহ (সা.) তৃতীয়বারও তাকে মাটিতে আছড়ে ফেললেন। রুকানা এবার সত্যিই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বলল, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না, আমি জীবনে কখনো হারিনি। কেউ কখনো আমাকে মাটিতে ফেলতে পারেনি। এটা কীভাবে সম্ভব।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তবে শোনো, আমি তোমাকে আরও আশ্চর্য কিছু দেখাব।’

একটু দূরে একটি গাছ ছিল। রাসুল (সা.) সেই গাছকে ডাক দিলেন। গাছটি নিজে থেকেই স্থান পরিবর্তন করে তাঁর কাছে চলে এলো। তিনি গাছকে বললেন, ‘ফিরে যাও।’ গাছটি আবার ফিরে গেল তার আগের জায়গায়। রুকানা এই অলৌকিক ঘটনা দেখে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইবাদতযোগ্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুল।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে অভিনন্দন জানিয়ে আবার নিজের পথে রওনা দিলেন।

আরও পড়ুননারী সাহাবি হজরত শিফা (রা.)১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা

এই ঘটনাটি আমাদের শেখায়, রাসুল (সা.) কীভাবে মানুষের সঙ্গে আচরণ করতেন, কীভাবে ইসলাম প্রচার করতেন। তিনি ছিলেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে বরকতময় মানুষ। আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অমূল্য। তবু তিনি মানুষকে এতটাই ভালোবাসতেন, এতটাই বুঝতেন এবং গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি একজন মানুষের সঙ্গে সময় নিয়ে কুস্তিও করতেন, শুধু তাকে বোঝানোর জন্য।

তিনি চাইলে শুধু একটি বক্তৃতা দিয়েই বা হাতে একটি পুস্তিকা ধরিয়ে দিয়েই চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করতেন না। তিনি আগে মানুষকে বুঝতেন, তাদের মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব দিতেন। এ জন্যই মানুষ তাঁকে ভালোবাসত, তাঁর কথা শুনত, আর ইসলাম গ্রহণ করত। তাঁর এই মনোভাবই আমাদের জন্য আদর্শ হওয়া উচিত।

যখন আমাদের কারও সঙ্গে ইসলামের কথা বলার সুযোগ আসে, তখন আগে সেই মানুষটিকে বোঝার চেষ্টা করি, তার মতো করে কথা বলি। আর যদি তাতে একটু কুস্তিও লড়তে হয়—তাহলে তাই হোক!

 সূত্র: সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,০৭৮; মুসনাদ আহমাদ, হাদিস: ৮,৪৫০; সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১,৭৭৪)

আরও পড়ুনসাহসী সাহাবি হজরত যুবাইর (রা.)০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বলল ন করত ন ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।

অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আরো পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।

‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’

তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।

বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।

‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।

‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’

একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।

‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’

জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’

তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’

বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ