ঢাকা শহরে উট আগে কখনও দেখা যায়নি, অধিকৃত পাকিস্তান আমলেও নয়। উট ছিল, তবে থাকত তারা ছবি ও কবিতায়। তারা যখন দৃশ্যমান হয়ে উঠল আমাদের এই রাজধানীতে, তখনই উট দেখে নয়, উটের ভক্তদের দেখে খুবই পীড়িত হয়েছে সংবেদনশীল মানুষ। শামসুর রাহমানও হয়েছিলেন, যে জন্য তিনি কবিতা লিখে দুঃখ ও পীড়ার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু কেন ও কেমন করে ঘটল এই অদ্ভুত উটভক্তি? ঘটেছে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে। সেটাই প্রথম সত্য।
সামরিক শাসক এরশাদ মোটেই ধার্মিক, ধর্মভীরু ইত্যাদি ছিলেন না। তাঁর বেহায়াপনার মতো ব্যভিচারও বিশ্ববিখ্যাত ছিল। কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার তিনি যতদূর সম্ভব করেছেন; ক্ষান্ত হননি। সামরিক শাসন পাকিস্তান আমলেও এসেছে। আইয়ুব খানও একটানা ১০ বছর সামরিক বাহিনীর সাহায্যে দেশ শাসন করেছেন। কিন্তু তিনি ধর্ম নিয়ে মোটেই বাড়াবাড়ি করেননি। মোল্লারা তাঁর ওপর খুশি ছিল না। জামায়াতে ইসলামী তো রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। আইয়ুব মোল্লাদের ছাড় দেননি। এরশাদ দিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছেন; পীরের আস্তানায় নিয়মিত যাতায়াত করেছেন। তাঁর এক পীরের উরস উপলক্ষেই তো উটের আগমন ঘটেছিল ঢাকা তথা বাংলাদেশে।
আইয়ুব খানের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাসও ছিল। যে জন্য তিনি অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু ধর্মের ভাষাতে কথা বলেননি। এরশাদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস একেবারেই ছিল না। তিনি জানতেন, লোকে তাঁকে পছন্দ করে না। তাই তিনি ধর্মের কথা বলে নিজে যে খুবই ধর্মভক্ত– এ রকম প্রমাণ করতে চাইতেন।
আত্মবিশ্বাস মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরও ছিল। যে জন্য ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সত্ত্বেও তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন– পাকিস্তান হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। জিন্নাহর পর যেসব রাজনীতিক এসেছেন, তারা সংবিধান তৈরিতে সময় নিয়েছিলেন ৯ বছর এবং রাষ্ট্রকে ঘোষণা করেছিলেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে। লক্ষণীয়, আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়ে যে সংবিধান জারি করেন, তাতে রাষ্ট্রকে তিনি ইসলামী বলেননি, সাদামাটা প্রজাতন্ত্র বলেই শান্ত হয়েছেন।
এরশাদ অবশ্য তাঁর পূর্বসূরি জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের আত্মবিশ্বাসের অভাবের ঐতিহ্যের মধ্যেই ছিলেন। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, কিন্তু ক্ষমতা লাভের পর ফরমান জারি করে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসিতও করেছেন। শুধু তা-ই নয়; ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে তিনি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন। তাতে সুবিধা হয়েছে জামায়াতওয়ালাদের। তারা তথাকথিত জাতীয়তাবাদীদের (বিএনপি এবং আওয়ামী উভয় ঘরানার) পিছু পিছু চলেছে; জাতীয়তাবাদীদের সহায়তা দিয়ে এবং তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে এক সময় রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয়ে পড়েছিল। এমনকি পাকিস্তানের ২৩ বছরেও যা ছিল তাদের জন্য অকল্পনীয়। উটেরা আসবে না কেন; তারা তো আসবেই।
এরশাদকে টেনে নামানোর পর যে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় এসেছে, তারাও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করার ব্যাপারে আগ্রহের কোনো অভাব দেখায়নি। বরং উভয় দলই প্রায় প্রতিযোগিতামূলকভাবে লোকের ধর্মবোধ উস্কে দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকার চেষ্টা করেছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনার আবশ্যকতা বিএনপির তো অনুভব করার কথাই নয়। তারা তো ক্রমে নব্য মুসলিম লীগেই পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বলে যারা নিজেদের মনে করে, সেই আওয়ামী লীগও চুপচাপ থাকেনি; এরশাদ প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিও দিয়েছিল। ওদিকে সমাজে যে ইহজাগতিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা বেড়েছে, তা মোটেই নয়। বরং ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে, বুর্জোয়া শাসনাধীনে।
রাষ্ট্রক্ষমতা ওই চর্চাকে সরাসরি নিরুৎসাহিত করেছে। আর সমাজ তো রয়ে গেছে আগের মতোই। আমাদের দেশে নির্বাচনে, গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে বটে, কিন্তু সমাজে কোনো বিপ্লব ঘটেনি। উল্টো সমাজ বরং পিছিয়ে গেছে। রাষ্ট্র এখন ট্রেনে না উঠে সওয়ার হতে চাচ্ছে উটের পিঠে। আমরা পীড়িত হয়েছি, শাসকশ্রেণি হয়তোবা উপভোগ করেছে।
ওদিকে বেড়েছে বৈষম্য; দারিদ্র্য কমেনি। এ এক দুঃসহ পরিস্থিতি। এমন অবস্থায় মানুষ স্বভাবতই নেশাগ্রস্ত হয়; হয় আশ্রয়হীন। আশ্রয়হীন মানুষ কোথাও কোনো আশা দেখে না; ন্যায়বিচারের আলো পায় না। বিচ্ছিন্নতার বোধে তার পীড়া বাড়ে; সে তখন আশ্রয় খোঁজে ধর্মের কাছে। মৌলবাদ বিকাশের পেছনে এই আর্থসামাজিক বাস্তবতাকে যদি না দেখি তাহলে রোগটাকে বুঝতে পারব না। তার চিকিৎসার যে সুরাহা করব, তাও সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসের সঙ্গে বেকারত্ব প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। বেকার যুবকরাই সন্ত্রাসী হয়। কেননা, তাদের কাছে জীবনের কোনো মূল্য থাকে না। তারা অতি অল্প দামে বিক্রি হয়। খুব সহজে প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
সমাজের পশ্চাৎপদতা আজকের নয়; বহুকালের পুরোনো। কিন্তু কথা ছিল– আমরা সামনে এগোব। পারলাম না। তার কারণ, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা এলো তারা সেটা চাইল না। চাওয়ার কথাও নয়। তাদের আকাঙ্ক্ষা রাষ্ট্র ও দেশকে রাখবে নিজেদের কবজায়। লুণ্ঠন করবে বিনা বাধায়। লুণ্ঠনের লিপ্সাই তাদের পরস্পরবিরোধী শিবিরে ভাগ করে দিয়েছে; নইলে তারা একই– ওই লুণ্ঠনকারী। যেন ডাকাতদের লড়াই, ভাগবাটোয়ারা নিয়ে। তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে ক্ষমতাকে অবলম্বন হিসেবে। এই কাজটা সহজ। ধর্মের বাণী সরল, তার প্রতিশ্রুতিও সরল। ধর্মের ভাষা সহজ এবং হৃদয়স্পর্শী। কেননা, তা সমষ্টিগত নয়। ব্যক্তিগত লাভের কথা বলে; ভোগের উপায় জানিয়ে দেয়; প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে পরকালে সিদ্ধিপ্রাপ্তির। মানুষ এতে আকৃষ্ট হয়।
বাংলাদেশে এখন যত মাদ্রাসা আছে, পাকিস্তান আমলেও তা ছিল অকল্পনীয়। মাদ্রাসাশিক্ষিত তরুণরা উৎপাদনে অংশ নিতে পারে না। ওই শিক্ষা তাদের ব্যবহারিক দক্ষতা দেয়। মাদ্রাসা শিক্ষা কোনোভাবেই সাধারণ শিক্ষার সমমানের নয়। অথচ দুই শিক্ষাকে একই মানে চালানো হচ্ছে। এর ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা জনপ্রিয় হবে। কেননা, মাদ্রাসায় পাস করা তো বটেই, উচ্চ নম্বর পাওয়া সহজ এবং মাদ্রাসায় পাড়াশোনা করতে খরচও পড়ে কম। নিচু মানের এবং অল্প খরচায় ‘শিক্ষা’প্রাপ্তরা নম্বরের জোরে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদেরও জব্দ করবে– এমন আশঙ্কা মোটেই অযৌক্তিক নয়। অচিরেই আমরা মাদ্রাসা শিক্ষার প্লাবন দেখতে পাব।
তার ফলে এমনিতেই দুর্বল সাধারণ শিক্ষার দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পাবে। বলা বাহুল্য, এই প্লাবন যে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাকে স্পর্শ করতে পারবে, তা নয়। কেননা ওই শিক্ষার দালানকোঠা একাধারে উঁচু ও শক্ত। সাধারণ শিক্ষা যত নামবে ইংরেজি শিক্ষার আকর্ষণ ও দাপট ততই চড়া হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। লোকে বাড়িঘর বিক্রি করে হলেও ছেলেমেয়েদের ইংরেজি বিদ্যালয়ে পাঠাতে চেষ্টা করবে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবহ র কর ছ ন ত হয় ছ আইয় ব এরশ দ ক ষমত ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
হামলার জবাবে হামলা চলছে, ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে
ইরান ও ইসরায়েল সংঘাতের তৃতীয় দিনে ব্যাপক হামলা-পাল্টা হামলা হয়েছে। এক ঝাঁক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে ১৩ জন নিহত ও ৩৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৪৯ জন। গত শনিবার রাত ও গতকাল রোববার চালানো হামলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ইরানেরও। দেশটির পারমাণবিক স্থাপনায় নতুন করে হামলা হয়েছে। এ ছাড়া তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইরানও গতকাল পাল্টা হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র দৃষ্টিগোচর হলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) তা রুখে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। সতর্কতা হিসেবে সাইরেন বেজে ওঠে।
আগের হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসরায়েলের বাত ইয়াম এলাকা। সেখানে আবাসিক ভবন ধসে ছয়জন নিহত এবং অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন। ইসরায়েলের উদ্ধার দল জানায়, তারা ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে লোকজনকে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা চালানোর বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন, এ সংঘাত সহজেই শেষ করা সম্ভব। তিনি একটি চুক্তির বিষয়ে আশাবাদী।
ইরানের হামলায় ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও প্রাণহানি হয়েছে কম। লোকজন সাইরেনের শব্দ শুনেই ভূগর্ভস্থ বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান। ইরান থেকে সবচেয়ে দ্রুতগামী ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে পৌঁছতে কমপক্ষে ১০ মিনিট সময় লাগে। মাঝে সিরিয়া, জর্ডান পাড়ি দিতে হয়। ইসরায়েলের বাসিন্দারা সতর্ক বার্তা পেয়েই নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান। ইরানে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। হামলার হুমকির মুখে অনেক বাসিন্দা তেহরানের বাইরে চলে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলে ইরানের সর্বশেষ আঘাতের ঢেউ শুরু হয় স্থানীয় সময় শনিবার রাত ১১টার পর। জেরুজালেম ও বন্দরনগরী হাইফাতে সাইরেন বেজে ওঠে। প্রায় ১০ লাখ মানুষ ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যান। রাত আড়াইটার দিকে আরেক ঝাঁক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েল অভিমুখে ছুটে আসতে থাকে। আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে আবারও নির্দেশনা দেয় আইডিএফ। এ সময় শূন্যে ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের চেষ্টা চালানো হয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে। এদিকে ইয়েমেন থেকে জাফফা ও তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে হুতিরা।
ইসরায়েলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়েছে তেহরান। ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় শহর রেহোভতে গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় উইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট জানায়, এতে কেউ হতাহত হননি। ইরানের চালানো আগের রাতের হামলার প্রসঙ্গ টেনে গতকাল রোববার ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারগোজ বলেন, এটি বেদনাদায়ক ও কঠিন এক সকাল।
ইরানের হামলায় ইসরায়েলে শিশুসহ প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বিশেষ করে উত্তর ও মধ্য ইসরায়েলে আঘাত হানে। তামরা শহরে চার নারী নিহত হয়েছেন। মধ্যাঞ্চলের বাত ইয়ামে বহুতল ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। বেঁচে যাওয়া স্যামুয়েল বার ডেভিড নামে ওই ভবনের এক বাসিন্দা জানান, তিনি সেখানে ৩৫ বছর ধরে থাকছেন। হামলায় অলৌকিকভাবে তাঁর পরিবার বেঁচে গেছে।
হতাহত ও নিখোঁজের খবর নিশ্চিত করে দ্য টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, বাথ ইয়ামে আবাসিক ভবনে ইরানের একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। উদ্ধার অভিযান চলছে, যা শেষ করতে এক দিন লাগবে। ওই এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাংবাদিকদের ঢুকতে দিচ্ছে না ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ।
সিএনএন জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে ইসরায়েলের হামলায় ইরানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১২৮। আহত ৯০০ জন। এর মধ্যে গত শুক্রবার রাতে তেহরানে একটি ১৪ তলা আবাসিক ভবন বিধ্বস্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ৬০ জন নিহত হন। ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ-রেজা জাফরগান্দ বলেন, ইসরায়েলের বিমান হামলায় যারা নিহত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এদিকে তেহরানে সামরিক স্থাপনার আশপাশ থেকে লোকজনকে সরে যেতে বলেছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি পরিষেবা জানিয়েছে, রোববার ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর উত্তর ইসরায়েলের হাইফায় কমপক্ষে চারজন আহত হয়েছেন। হাইফায় বিস্ফোরণের খবরও মিলেছে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সত্ত্বেও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতের সংখ্যা দেখে ইসরায়েলিরা হতবাক হচ্ছে।
ইরানে বৃহত্তর মার্কিন সামরিক সম্পৃক্ততা খুঁজছে ইসরায়েল। ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করেছি। ইস্পাহানের একটি পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা করেছি।’ ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা পশ্চিম ইরানে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরাকে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস মার্কিন স্থাপনাগুলোতে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছে। ইরান জানিয়েছে, তারা ৪৪টি ইসরায়েলি ড্রোন এবং কোয়াডকপ্টার ভূপাতিত করেছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শান্ত হবে বলে আশাবাদ দিয়েছেন। রোববার গ্রিনল্যান্ড সফরের তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, ইরান থেকে রোববার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর তারা তা প্রতিরোধ করেছে।
ইরান-কাতার গ্যাসক্ষেত্রে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। তিনি বলেন, যুদ্ধকে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রসারিত করার প্রচেষ্টা হবে ভয়ংকর।
ইসরায়েল-ইরান দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে একমত হতে চায় জি৭ দেশগুলো। জার্মান চ্যান্সেলর মের্জ বলেছেন, আসন্ন জি৭ বৈঠকে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে দ্বন্দ্ব সমাধানে ঐকমত্য আসতে পারে।
এদিকে ইসরায়েলি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ আকাশসীমা ও বিমানবন্দর সম্পূর্ণ বন্ধ ঘোষণা করেছে। যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে আশাবাদ দিয়েছে রাশিয়া।
ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েল রোববার ২৫০টি স্থানে আঘাত করেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ইরাককে ইসরায়েলি আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি বলেছেন, ইসরায়েলের হামলা ইরাক ও এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। জার্মানির চ্যান্সেলর বলেছেন, তেহরানের উচিত অবিলম্বে ইসরায়েলে বোমা হামলা বন্ধ করা।
খামেনিকে হত্যার ইসরায়েলি পরিকল্পনায় ট্রাম্পের ভেটো
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার ইসরায়েলি পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনজন মার্কিন কর্মকর্তা সিবিএস নিউজকে এ তথ্য জানিয়েছেন। এক কর্মকর্তা বলেন, ইসরায়েলিদের খামেনিকে হত্যা করার সুযোগ ছিল। বিষয়টি জানার পর ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে জানিয়েছিলেন– এটি ভালো হবে না।
তেহরানে রাতভর ৮০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তেহরানে অন্তত ৮০টি লক্ষ্যবস্তুতে রাতভর হামলা চালানো হয়েছে। হামলায় ইসরায়েলের ডজনখানেক যুদ্ধবিমান অংশ নেয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে টানা তৃতীয় দিন হামলা চালানো হলো। বিবিসি জানায়, ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে ছিল ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদরদপ্তর, সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন শাখা। দুটি ‘দ্বৈত-ব্যবহারের’ জ্বালানি কেন্দ্রেও হামলা হয়। ওই জ্বালানি কেন্দ্র সামরিক ও পারমাণবিক কাজে ব্যবহার করা হতো।
আইডিএফ আরও জানিয়েছে, ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এর অংশ হিসেবে তিন দিনের কম সময়ে তারা ইরানের ১৭০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। ইরানের ৭২০টির মতো সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করেছে।
সহজেই একটি চুক্তি করতে পারব, বললেন ট্রাম্প
এ অবস্থায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার যে অভিযোগ ইরান তুলেছে, তা তিনি অস্বীকার করেছেন। ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা যদি কোনোভাবে ইরানের হামলার শিকার হই, তাহলেই কেবল যুক্তরাষ্ট্র তার পূর্ণ শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শন করবে। সশস্ত্র বাহিনী এমনভাবে নেমে আসবে, যা তারা (ইরান) কখনও দেখেইনি।’ নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি বলেন, যা হোক, আমরা সহজেই ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পন্ন করতে পারব, যার মাধ্যমে এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে।’
তেহরানে তেল শোধনাগারে হামলা
অপরদিকে তেহরানের শাহরান তেলক্ষেত্রে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। তবে সেখানে এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। ইরানের আধা সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম জানায়, গতকাল রোববার তেহরানের পাশে একটি তেল শোধনাগারে ইসরায়েল হামলা চালালে আগুন ধরে যায়। ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এতে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ অবস্থায় ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্য সন্দেহে ইরানের দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ইসরায়েল হামলা বন্ধ করলে আমরাও করব, বলছে ইরান
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তেহরানে গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইসরায়েল তার দেশের ওপর হামলা বন্ধ করলে তেহরানও পাল্টা প্রতিক্রিয়া বন্ধ করে দেবে। আলজাজিরা জানায়, গত শুক্রবার ইসরায়েলের হামলার জেরে সংঘাত শুরু হওয়ার পর এই প্রথম প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বললেন আরাগচি। এর আগে তেহরান বারবার বলেছে, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা যে কোনো ক্ষেত্রে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে।
ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানালেন নেতানিয়াহু
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্মদিনে গত শনিবার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। রয়টার্স জানায়, তিনি ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রেরও শত্রু বলে বর্ণনা করেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে– এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। তবে ইরানে ব্যাপক হামলা চালিয়ে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যার পর ইসরায়েলের প্রশংসায় ট্রাম্প ‘চমৎকার’ ও ‘অত্যন্ত সফল’ বলেছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্যে আরও যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে যুক্তরাজ্য
ইরান ও ইসরায়েলের হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাজ্য আরও যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। গতকাল শনিবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এ কথা জানান। তিনি বলেন, ওই অঞ্চলে জরুরি সহায়তা দেওয়ার জন্যই যুদ্ধবিমান পাঠানো হবে। স্টারমার কানাডায় ধনী দেশগুলোর জোট জি৭ সম্মেলনে অংশ নিতে যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরও আরএএফ জেট পাঠানো হচ্ছে। এ ছাড়া ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে স্টারমার গত শনিবার সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে কথা বলেন।
ইরানে ইন্টারনেট বন্ধ, স্টারলিংক চালু করলেন ইলন মাস্ক
মার্কিন ধনকুবের ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক জানিয়েছেন, ইরান সরকারের পক্ষ থেকে স্থলভিত্তিক ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পর তিনি উপগ্রহনির্ভর ইন্টারনেট পরিষেবা স্টারলিংক সেখানে চালু করেছেন। গত শনিবার সকালে এক্স পোস্টে মাস্ক লিখেন, ‘সংযোগ চালু হয়েছে।’ টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, ইরান সরকার শুক্রবার সকালে দেশের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়। দেশটির যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়াতে চায় ইসরায়েল
দুই ইসরায়েলি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল অ্যাক্সিওস জানিয়েছে, ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসরায়েল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসনকে যোগ দিতে বলেছে। এখন পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের হামলা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে। তারা বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ঘাঁটিগুলোতে যেন হামলা না হয়। একটি পর্বতের নিচে তৈরি ইরানের ফরদউ পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ সাইট ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রকে তারা এ আহ্বান জানাচ্ছে।
ইরানে বাংলাদেশি দূতাবাসের জরুরি হটলাইন চালু
চলমান সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে ইরানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সাহায্য ও সহায়তা দিতে জরুরি হটলাইন নম্বর চালু করেছে তেহরানে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে অথবা দেশে ফিরতে সহায়তা পেতে ওই হটলাইনে কল করার পরামর্শ দিয়েছে দূতাবাস।
হটলাইন নম্বরগুলো হলো +৯৮৯৯০৮৫৭৭৩৬৮, +৯৮৯১২২০৬৫৭৪৫। এই নম্বরগুলোতে হোয়াটসঅ্যাপে কল করা যাবে।