বাবর আলী। ৭ এপ্রিল নেপালের স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ১০টায় ৮ হাজার ৯১ মিটার উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১ পর্বতের চূড়ায় প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে উড়ান লাল-সবুজের পতাকা। প্রতি মুহূর্তে তুষারধস আর ওপর থেকে পাথর পড়ার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে অভিযানে পা বাড়ানো এই অভিযাত্রী পথেই দু’জন শেরপার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছেন। তবু ছুটে চলেছেন স্বপ্নের পথে। ছুয়েছেন অন্নপূর্ণা ১-এর চূড়া। গাইড ফুর্বা অংগেল শেরপাকে নিয়ে স্বপ্ন জয় করা এবং অনিশ্চয়তায় ভরা এই অভিযাত্রার কথা লিখেছেন সারোয়ার সুমন
বাবর আলীর বয়স ৩৪। পেশায় চিকিৎসক হলেও নেশায় পর্বতপ্রেমী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন এমবিবিএস। চিকিৎসায় পেশা শুরু করলেও মন বসেনি সেখানে। তাই চাকরি ছেড়ে আজন্ম লালিত স্বপ্নজয়ের পথ বেছে নেন। একে একে ছুটে চলছেন স্বপ্নজয়ের চূড়ায়। সেই ধারাবাহিকতায় এভারেস্টের পর ৭ এপ্রিল ৮ হাজার ৯১ মিটার উচ্চতার অন্নপূর্ণা-১ শৃঙ্গ জয় করে সাফল্যের মুকুটে যুক্ত করেছেন গৌরবের নতুন পালক। ভয়ংকর বিপজ্জনক এ পর্বতের চূড়ায় ওঠা প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই কীর্তি গড়েছেন বাবর। মাত্র এক বছর আগে ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে বাবর আলী জয় করেছিলেন এভারেস্ট। একই অভিযানে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জয় করেছিলেন আরেক পর্বত লোৎসেও।
মিশন অন্নপূর্ণা-১
অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান বলেন, ‘উচ্চতার দিক থেকে অন্নপূর্ণা-১ বিশ্বের দশম পর্বত। মৃত্যুর হার বিবেচনায় এটি বিশ্বের অন্যতম ‘বিপজ্জনক পর্বত’ হিসেবে পরিচিত। এই দুর্গম অন্নপূর্ণা-১ পর্বতকে জয় করতে গত ২৪ মার্চ বাংলাদেশ থেকে নেপালের পথে পা বাড়ান বাবর আলী। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে কাঠমান্ডু থেকে পোখারা হয়ে ২৮ মার্চ পৌঁছান অন্নপূর্ণা বেইজ ক্যাম্পে। সেখানে একদিন বিশ্রাম নেন। এরপর উচ্চতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে ক্যাম্প-১ এ (৫২০০ মিটার) দুই রাত এবং ক্যাম্প ২-এ (৫৭০০ মিটার) এক রাত কাটিয়ে আবার ২ এপ্রিল নেমে আসেন বেইজ ক্যাম্পে। গত ৭ এপ্রিল সকালে তিনি পর্বতশৃঙ্গে পৌঁছান। ৮ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টায় নিরাপদে ফেরেন বেইজ ক্যাম্পে। সেখানে বাবরের সঙ্গে ছিলেন গাইড ফুর্বা অংগেল শেরপা।’
লাল-সবুজের পতাকা হাতে
হলুদ রঙের জ্যাকেটে মোড়া বাবর আলীর পেছনে ধবধবে সাদা বরফ। সামনে কালো রঙের একটি ব্যাগ। তার পাশে লাল-সবুজের পতাকা হাতে বসে আছেন তিনি। চোখে রোদচশমা। মুখে লেগে আছে চির চেনা সেই হাসি। ৮ হাজার ৯১ মিটার উচ্চতার পর্বত অন্নপূর্ণা-১ এর চূড়ায় ওঠা বাবর আলীর এমন একটি ছবি অনলাইনে প্রকাশ করে ভার্টিকাল ড্রিমারস। বাবরের স্বপ্নের সারথি এই প্রতিষ্ঠান। বিপজ্জনক অন্নপূর্ণা-১ এর চূড়া বাবর জয় করেছেন সোমবারে। মঙ্গলবার নিরাপদে ফিরেছেন তিনি বেইজ ক্যাম্পেও। সেই তথ্য তুলে ধরে ভার্টিকাল ড্রিমারস লিখেছে– ‘সেই মাহেন্দ্রক্ষণের ছবি, সেই গর্বের লাল-সবুজ হাতের ছবি; যার জন্য এত অপেক্ষা।’
শীর্ষে পৌঁছাতে ১৭ ঘণ্টা
বেইজ ক্যাম্পে তোলা ছবি দিয়ে ১০ এপ্রিল নিজের ফেসবুক ওয়ালে বাবর আলী লিখেন–‘অবাক করার এক অভিযান শেষে, পোখারায় পৌঁছেছি। গত ১৭ দিন ধরে, আমি একটা বিভ্রমের মধ্যে ছিলাম! অন্নপূর্ণা-১ আমার শক্তির প্রতিটি অংশ পরীক্ষা করেছে। আমি জানতাম এটি কঠিন হবে। কখনও ভাবিনি অন্নপূর্ণা-১ আমাকে এবং এর ঢাল হিসেবে সবাইকে এভাবে পরীক্ষা করবে! ক্যাম্প ২ এবং ৩ এর মধ্যে মহান কোলোয়ার সবার শ্বাস কেড়ে নিয়েছে। ক্যাম্প ৩-এর ওপরে খাড়া ঢালগুলো একের পর এক দুঃস্বপ্ন ছিল। একবারে প্রায় ১৭০০ মিটার আরোহণ করা কোনো রসিকতার বিষয় ছিল না। শীর্ষে পৌঁছতে ১৭ ঘণ্টা লেগেছে। মোট সামিটের বিড ছিল ২৬ ঘণ্টা! আমার জীবনের দীর্ঘতম সময়। ফেরার পথে পায়ে পাথরের আঘাত পেলাম। সহকর্মী পর্বতারোহী আমার চোখের সামনে তুষারপাত দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। এটি তার আত্মবিশ্বাসকে নাড়িয়ে দিয়েছে। যাই হোক, ধন্যবাদ সবাইকে আমাকে আপনাদের প্রার্থনায় রাখার জন্য।
উচ্ছ্বসিত পরিবার
বাবর আলীর অন্নপূর্ণা-১ জয়ের খবরে উচ্ছ্বসিত তাঁর বাবা লিয়াকত আলী ও মা লুৎফুন্নাহার বেগম। লিয়াকত আলী সাহসকে বলেন, ‘পর্বত জয় করতে ভালোবাসে আমার ছেলে। এভারেস্ট ও লোৎসে জয়ের পর এবার অন্নপূর্ণা-১ নামে আরেকটি পর্বত জয় করেছে সে। তার আগে নাকি এই পর্বতে যেতে পারেনি অন্য কোনো বাংলাদেশি। তাই আমরা আনন্দিত।’ বাবরের মা লুৎফুন্নাহার বলেন, ‘বাবর খুবই মেধাবী ছাত্র। চিকিৎসক হিসেবে পেশা শুরু করলেও তার নেশা ছিল ভ্রমণ। তাই পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় সে। গত কয়েকদিন অনেক চিন্তা আর উৎকণ্ঠায় ছিলাম। এখন সেই চিন্তা কিছুটা কমেছে। তারপরও আমরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। কারণ, বাবর এখনও ফিরে আসেনি আমার বুকে।’
ইতিহাসের খোঁজে
বাবরের আগে ২০১১ ও ২০১২ সালে দু’বার এভারেস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ মে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। একই মাসের ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন জয় করেন এভারেস্ট। ২০১৩ সালের ২০ মে এভারেস্ট জয় করে নামার পথে মারা যান সজল খালেদ, যিনি পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে পর্বতজয় করেছিলেন। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর পর গত ১১ বছরে আর কোনো বাংলাদেশি এভারেস্টের পথ মাড়াননি। ১১ বছর পর ২০২৪ সালে বাবরের হাত ধরে ফের লাল-সবুজের পতাকা উড়েছে এভারেস্টের বুকে। তবে অন্নপূর্ণা-১ জয় করে এবারে প্রথম বাংলাদেশি হওয়ার গৌরবটা নিজের করে নিয়েছেন বাবর আলী। একই অভিযানে মাউন্ট এভারেস্ট ও চতুর্থ উচ্চতম পর্বত মাউন্ট লোৎসের চূড়ায় উঠতে পারেননি কোনো বাংলাদেশি। এভারেস্টের সঙ্গে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ পর্বতশৃঙ্গ ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট উচ্চতার লোৎসেও শেষ পর্যন্ত স্পর্শ করেন বাবর আলী। যেখানে এখনও পর্যন্ত পদচিহ্ন পড়েনি কোনো বাংলাদেশির।
জীবনের পাঠ
বাবর আলী বলেন, ‘অন্নপূর্ণা ১-এর ক্যাম্প ২ ও ৩-এর পথ অনিশ্চয়তায় ভরা। সেখানে প্রতি মুহূর্তে তুষারধস আর ওপর থেকে পাথর পড়ার ঝুঁকি থাকে। আমার অভিযানের সময় দুইজন শেরপার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি। ঝুঁকি বিবেচনায় অন্নপূর্ণা-১-কে আমি ১০-এ ১০ দেব; যেখানে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টকে দেব ১০-এ দুই, আর লোৎসের ক্ষেত্রে ১০-এ চার। আসলে এটি সত্যিই “মাউন্টেনিয়ারস মাউন্টেইন”, যা সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ করে।’ বাবর আলী আরও বলেন, ‘মানুষ ইতোমধ্যে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছে যে, এরপর পা বাড়াবেন কোন পথে? আমি বলতে চাই, এখানেই শেষ নয়; প্রত্যেক নারী এবং পুরুষের জীবনে অন্য অন্নপূর্ণাও রয়েছে!’
বাবর আলীর দেখানো পথ ধরে আমরা জীবনের অন্নপূর্ণ জয় করার পথে হাঁটি; চলুন!
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ইজ ক য ম প প রথম ব ব বর র
এছাড়াও পড়ুন:
রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে
রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন।
পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।
এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়।
এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে।
মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়।
জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।
এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়।
এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।
যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে।
ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই।
অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়।
এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।
এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।
এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে।
এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়।
এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে।
● বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়