বড় প্লাস্টিক চোখে দেখা যায়। এ কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত বিপদ কেমন হতে পারে– সে ধারণা কম-বেশি সবারই জানা। তবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা প্রাণ-প্রকৃতিতে নীরবে বিষ ঢাললেও এর ভয়াবহতা থেকে যাচ্ছে আড়ালেই। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে– লবণ, আটা, চিনি, মাছ, মাটি, বাতাস, নদী, সমুদ্র এমনকি খাবার পানিতেও রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব। 

গবেষকরা বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার ৫ মিলিমিটারের চেয়ে ছোট হয়। দিনের পর দিন শরীরে এই বিষ মিশতে থাকলে দেহে মরণব্যাধি বাসা বাঁধতে পারে। বিপজ্জনক মাইক্রোপ্লাস্টিক ঠেকানোর উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বের প্রথম দেশ বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল। উপকূলীয় অঞ্চলে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকেও লাগাম টানা হয়েছে। পলিথিন আর প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে চলছে অভিযান। তবু থামছে না এর ব্যবহার। সরকার এ ব্যাপারে নানামুখী উদ্যোগ নিলেও মানুষকে এখনও সচেতন করা যায়নি।  

ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য অনুসারে, প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতিবছর ১ লাখ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে। ২০৫০ সালে সাগরে যত মাছ থাকবে, তার চেয়ে বেশি থাকবে প্লাস্টিক। প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। পরিমাণের দিক থেকে এটি বিশ্বে পঞ্চম।

সরকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিথিন ও মাইক্রোপ্লাস্টিক যে কতটা ক্ষতিকর, তা জনগণকে অনুধাবন করতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে মানুষের মনোজগতে। সবাই মিলে কাজ করলে প্লাস্টিকের সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

এ পটভূমিতে আজ মঙ্গলবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ধরিত্রী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য– ‘আমাদের শক্তি, আমাদের পৃথিবী’। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে। 

কোথায় নেই মাইক্রোপ্লাস্টিক
ময়মনসিংহের পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের পানি, মাটি এবং মাছের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পেয়েছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় এক গবেষক দল। গত ১৯ এপ্রিল প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই নদের প্রতি বর্গকিলোমিটার পানিতে ২৫ লক্ষাধিক ভাসমান কণা এবং তলদেশে প্রতি কেজি মাটিতে সাড়ে ৪০০ কণা মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলেছে। মাছের পেটেও পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক।

গত ২৫ মার্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্থায়নে হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম পরিচালিত গবেষণায় সেখানকার সুতাং নদের পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এমনকি হাওরের ধানেও মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকার কথা বলছেন গবেষকরা। 
গত বছরের এপ্রিলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বিভাগীয় শহরে প্রতি গ্রাম ধুলায় ৫২টি, ঢাকায় প্রতি গ্রাম ধুলায় ১০৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক উড়ছে। 
২০২৩ সালের আগস্টে নেদারল্যান্ডসের সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের পানি, পলি এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আশঙ্কাজনক উপস্থিতি দেখা গেছে। গঙ্গা অববাহিকার নদীর প্রতি ২০ লিটার পানিতে অন্তত একটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা পাওয়া গেছে। প্রতি কিলোগ্রাম পলিতে মিলেছে ৫৭টি কণা। আর বাতাসে প্রতি বর্গমিটারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণার সংখ্যা ছিল ৪১। গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে, গঙ্গা নদী এবং এর উপনদীগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন ১০০ থেকে ৩০০ কোটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা বঙ্গোপসাগরে যাচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে রেয়ন। 

২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে উৎপাদিত সামুদ্রিক লবণে ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ বেড়েছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) গবেষকরা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ১২টি লবণ উৎপাদনকারী স্থান থেকে সংগ্রহ করা কাঁচা লবণের প্রতি কেজিতে ৫৬০ থেকে ১ হাজার ২৫৩টি প্লাস্টিক কণা শনাক্ত করেছেন। 
লবণের ওপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পরিবেশ বিজ্ঞানী ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে আরেকটি গবেষণা করেছেন। সেখানে বলা হয়, বাজারের সুপরিচিত ১০টি ব্র্যান্ড ও খোলাবাজার থেকে সংগৃহীত নমুনায় দেখা গেছে প্রতি কেজি লবণে রয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি প্লাস্টিকের কণা। এই হিসাবে দেশের একজন মানুষ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৩ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক খাচ্ছে।
শুধু লবণ নয়, চিনি এমনকি টি-ব্যাগেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলেছে। ২০২২ সালের মে মাসে ‘ইজ দেয়ার টি কমপ্লিমেন্টেড উইথ দি অ্যাপেইলিং ফ্লেভার অব মাইক্রোপ্লাস্টিক? এ পায়োনিয়ারিং স্টাডি অন প্লাস্টিক পলিউশন ইন কমার্শিয়ালি এভেইলেবল টি-ব্যাগস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্টে’ প্রকাশিত হয়। চিনি ও টি-ব্যাগ নিয়ে দুটি গবেষণাতেই অংশ নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষক। রাজধানীর বিভিন্ন সুপারমার্কেট থেকে সংগ্রহ করা পাঁচটি ব্র্যান্ড ও দুটি নন ব্র্যান্ডের চিনির প্রতি কেজিতে গড়ে ৩৪৩.

৭টি প্লাস্টিক কণা পেয়েছেন গবেষকরা। নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত পাঁচটি ব্র্যান্ডের টি-ব্যাগেও প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে। 

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। বাজারে পাওয়া যায় এমন দেশি মাছের ওপর গবেষণা করে জানা যায়, ১৫ প্রজাতির মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে।

সমুদ্রের গভীরতা থেকে আর্কটিক বরফ পর্যন্ত সর্বত্র প্লাস্টিকের ঝুঁকি রয়েছে। ফলে সুন্দরবন এর ব্যতিক্রম হবে– এমনটা আশা করা যায় না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রাজিলের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় সুন্দরবনের মাছ নিয়ে যৌথভাবে গবেষণা করে। পশুর, রূপসা ও মোংলা নদী থেকে ২০ প্রজাতির ১৪১টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের তিনটি প্রধান নদী থেকে অন্তত ১৭ প্রজাতির মাছ ও ৩ প্রজাতির সেলফিশ মাইক্রোপ্লাস্টিকে সংক্রমিত। 
ঢাকার ১৩টি এলাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বাতাসে জরিপ করে অতি ক্ষুদ্র বিষাক্ত প্লাস্টিক কণা পাওয়ার তথ্য উঠে আসে ২০২৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক গবেষণায়। 
২০২৩ সালে ঢাকা শহরের তিনটি লেকের পানি, মাটি ও মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণ নির্ণয়ের জন্য আরেকটি গবেষণা করা হয়। এসব লেকে দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি যে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ লোড সূচক অনুযায়ী এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ স্তরে রয়েছে। 

২০২৩ সালের এক গবেষণায় বেঙ্গল ডেল্টার বিভিন্ন আবাসস্থল থেকে ৯টি প্রজাতির  ২৭টি ব্যাঙ সংগ্রহ করে তাদের পাচনতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা গেছে, ব্যাংগুলোর ৯০ শতাংশের পাচনতন্ত্রে মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। ২০২৪ সালের আরেকটি গবেষণায় ভূগর্ভস্থ পানিতেও ব্যাপকভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব শনাক্ত করা হয়, যা প্রতিনিয়ত সেসব এলাকার মানুষ পান করছে।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় পশুর ও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি, মাটি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর হুমকির ইঙ্গিত দেয়। এ ছাড়া এ বছর গবেষকরা বাণিজ্যিক খাদ্য আটার মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্বের প্রমাণ পান, যা মানুষের খাদ্যচক্রে এ ক্ষতিকর উপাদান প্রবেশের একটি উদাহরণ। 
এ ছাড়া কর্ণফুলী নদীর পানি, মাটি ও মাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এতে বলা হয়, একজন ব্যক্তি প্রতিবছর এ নদীর মাছ থেকে প্রায় ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার ৬৬০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গ্রহণ করতে পারে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।

কারা কী বলছেন
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আমরা দৈনন্দিন যে প্লাস্টিক ব্যবহার করি, তা ব্যবস্থাপনার আওতায় নেই। ব্যবহার্য প্লাস্টিক ফেলে দেওয়ার পর কোনো না কোনো উপায়ে শেষ পর্যন্ত নদীতে গিয়ে পড়ে। একজন মা যখন সন্তানকে বুকের দুধ পান করান, নদীর মাছ খাওয়ান, তখন এসবের সঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিকও খাওয়াচ্ছেন। প্লাস্টিক দূষণ রোধে কোম্পানিগুলোরও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বই নয়, তা যেন একটা মূল্যবোধের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।

এদিকে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ডিম্বাণু-শুক্রাণুতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে প্লাস্টিক কম দামি মনে হলেও পরিবেশ আর স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় মোটেও সাশ্রয়ী নয়। সরকার চেষ্টা করছে, একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার থেকে মানুষকে সরিয়ে আনতে। পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত সুপারশপে সফল হলেও অন্য জায়গায় আরও কাজ করতে হবে। কারণ পলিথিনের নেতিবাচক দিকগুলো মানুষ জানে না। সেক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পলিথিন ব্যাগসহ একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বন্ধ করার চেষ্টা করব। 

 


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ২০২৩ স ল র র ব যবহ র নদ র প ন পর ব শ পল থ ন বলছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা শুরু

সব জল্পনার অবসান হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সোমবার বিএনপি ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে দলের দুই শীর্ষ নেতার নির্বাচন করা এবং তাঁদের নির্বাচনী আসনগুলো নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচন করবেন।

তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, অনেক আগে থেকেই এমন আলোচনা আছে। তবে অসুস্থতার কারণে এবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। আবার তাঁর নিজেরও নির্বাচন করার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।

দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী শঙ্কা, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে রাজি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নেতা-কর্মীরা আনন্দিত।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নানা কারণে আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে নির্বাচনের গুরুত্বটা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে, সেটা মোকাবিলায়ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রভাব ফেলবে।

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সোমবার ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাকি ৬৩টি আসনে প্রার্থিতা পরে ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থগিত রাখা কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।

ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যরা হলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), আবদুল মঈন খান (নরসিংদী-২), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), ইকবাল হাসান মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা-৩) এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন (দিনাজপুর-১)।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। প্রয়োজন বোধ করলে স্থায়ী কমিটি প্রার্থিতা পরিবর্তন করতে পারবে।

এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রার্থী ঘোষণার আগে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সভা হয়। সেখানে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকেরাও উপস্থিত ছিলেন।

এবারের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁকে ফেনী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে, সে আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব, সালাম জানাব।’

যে কারণে ঢাকার সাতটি আসন ফাঁকা

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনী সমঝোতার জন্য আসনগুলোতে প্রার্থিতা স্থগিত রাখা হয়েছে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাতটি আসনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের জন্য অন্তত তিনটি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নামও আছে।

তবে এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

ঢাকা-৯ আসন স্থগিত রাখা হলেও সেটা কার জন্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খানকে (সোহেল) প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলে আলোচনা আছে।

ঢাকা-১৪: মায়ের ডাক-এর সানজিদা

ঢাকা-১৪ আসনে এবার প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এস এ খালেকের ছেলে এস এ সিদ্দিক (সাজু)। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ব্যক্তিদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামকে (তুলি) প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। এই আসনে ইতিমধ্যে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান)। তিনি আট বছর গুম ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে দলটি অভ্যন্তরীণ জরিপসহ সাংগঠনিক উপায়ে প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম প্রকাশ করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল বিএনপি।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিগত ১৫-২০ বছর ভোট দিতে পারেনি। এখন জাতি উৎসাহিত হচ্ছে ভোটের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি পূরণ করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করে একটা বড় পদক্ষেপ নিল। ইতিমধ্যে অনেকে মাঠে চলে গেছেন, এ ঘোষণার পর বাকিরাও মাঠে যাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে।

১০ নারী প্রার্থী

ঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন দশজন। এর মধ্যে অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকিরা হলেন সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর, ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, যশোর–২ আসনে সাবিরা সুলতানা, ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম ও নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন।

মনোনয়ন না পেয়ে দুই মহাসড়ক অবরোধ

মাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করে কামাল জামান মোল্লাকে। এর প্রতিবাদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা রাত আটটার দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর অনুসারীরা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ