‘সন্তানদের চোখের সামনে খুন হতে দেখেছি, বিচার চাওয়া কি অন্যায়’
Published: 22nd, April 2025 GMT
‘স্বামী নাই, সন্তানরা নাই। সব শ্যাষ হয়ে গেছে। দুই সন্তানকে হত্যা করেও খুনিগো খ্যান্ত হয় নাই। মামলা তুলে নিতে খুনিরা এখন আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। সন্তানদের চোখের সামনে খুন হতে দেখেছি। খুনিদের বিচার চাওয়া কি অন্যায়? আমি কি হত্যাকারীদের বিচার দেখে মরতে পারব না?’ ক্ষোভ নিয়ে এসব কথা বলছিলেন সুফিয়া বেগম (৬০)।
মাদারীপুরে মসজিদের মধ্যে ঢুকে চারজনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলার বাদী সুফিয়া বেগম। আজ মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে সুফিয়া বেগম দুই সন্তানসহ চার হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন। ঘণ্টাব্যাপী কর্মসূচিতে ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে নিয়ে অংশ নেন নিহত চারজনের স্বজন ও এলাকাবাসী। মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন আক্তারের কাছে ন্যায়বিচার দাবি করে স্মারকলিপি দেন তাঁরা।
পূর্ববিরোধ ও বালু ব্যবসার জের ধরে গত ৮ মার্চ তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন দুই ভাই আতাউর রহমান সরদার ওরফে আতাবুর (৩৫), সাইফুল ইসলাম ওরফে হিটার সাইফুল (৩০), তাঁদের চাচাতো ভাই পলাশ সরদার (১৭)। আতাউর ও সাইফুল সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের সরদার বাড়ি এলাকার আজিবর সরদারের ছেলে ও পলাশ একই এলাকার মুজাম সরদারের ছেলে। নিহত সাইফুল খোয়াজপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত অলিল সরদার (৪০) ও তাজেল হাওলাদার (২০)। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তাজেল। আতাউর ও সাইফুলের প্রতিবেশী ছিলেন তাজেল। এ ঘটনায় গুরুতর আহত অলিল সরদার এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
আরও পড়ুনমাদারীপুরে বালুর ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বে তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যা০৮ মার্চ ২০২৫মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, মসজিদের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে অস্ত্রধারী নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। চারজনকে কুপিয়ে হত্যা করা দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এই ঘটনার পরে আসামিরা আরও প্রভাব বিস্তার করছে। মামলা তুলে নিতে আসামিপক্ষের লোকজন বাদী ও নিহত ব্যক্তির স্বজনদের প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি পুলিশকে জানানো হলেও গুরুত্ব দিচ্ছে না। আসামিদের ধরার ব্যাপারেও পুলিশ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে না। পুলিশের ভূমিকা আসামিপক্ষে রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন বক্তারা। এ সময় হত্যার ঘটনায় জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার ও দ্রুত বিচার দাবি জানান তাঁরা।
মামলার বাদী সুফিয়া বেগমের তিন ছেলের ওপর হামলা হয়েছিল। ঘটনাস্থলে তাঁর দুই ছেলে নিহত হন। বেঁচে যান বড় ছেলে অলিল সরদার। তিনি বলেন, ‘আমি যে এখনো বেঁচে আছি, কখনো কখনো সেটা বিশ্বাস হয় না। ওরা আমাকে যেভাবে কুপিয়েছে, আমার শরীরে মাথায় যে পরিমাণ কোপের আঘাত রয়েছে, তাতে আমার বাঁচার কথা না। আল্লায় শুধু বাঁচাইছে। আমার আপন দুই ভাই ও চাচাতো দুই ভাইকে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছি। হত্যাকারীদের দেখেছি। তাই ওরা আমাকেও খুন করতে হুমকি দিচ্ছে। আমার মাকে মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছে।’
আরও পড়ুনছোট ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হন অন্য দুই ভাই০৯ মার্চ ২০২৫এ সম্পর্কে মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হোসেন সরদার, শাহজাহান খানসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যারা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। বাদীকে হুমকির ব্যাপারে কেউ লিখিত অভিযোগ দায়ের করেননি। তাঁরা অভিযোগ জানালে বাদীকে সব ধরনের আইনি সহযোগিতা দেওয়া হবে।’
মামলার এজাহার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, খোয়াজপুরে কীর্তিনাশা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছিলেন ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল সরদার। এ নিয়ে প্রতিবেশী জেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেলা যুব দলের সাবেক দপ্তর সম্পাদক শাহজাহান খান ও বালু ব্যবসায়ী হোসেন সরদারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এর জের ধরে গত ৮ মার্চ শাহজাহান খান ও হোসেন সরদারের নেতৃত্বে তাঁর লোকজন সাইফুল ও তাঁর ভাইদের কুপিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনার এক দিন পরেই সাইফুল ও আতাউর সরদারের মা সুফিয়া বেগম বাদী হয়ে সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরদ র র ন সরদ র ল সরদ র র স মন ঘটন য়
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থানে শহীদ রিজভীর ভাইকে কুপিয়ে জখম, গ্রেপ্তার ৩
নোয়াখালী জেলায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ মাহমুদুল হাসান রিজভীর ছোট ভাই স্কুলছাত্র শাহরিয়ার হাসান রিমনকে (১৬) এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে আহতের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। রবিবার (২৮ এপ্রিল) রাতে সুধারাম মডেল থানায় রিমনের মা বাদী হয়ে দায়ের করেন। পুলিশ এ ঘটনায় তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম ও ছবি প্রকাশ করেনি।
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে রিমনের স্কুলের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছে।
আহত শাহরিয়ার হাসান রিমন জেলা শহরের বসুন্ধরা কলোনি বাসিন্দা মো. জামাল উদ্দিন ও ফরিদা ইয়াছমিন দম্পত্তির ছেলে। সে স্থানীয় হরিনারায়ণপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
আরো পড়ুন:
কুমিল্লায় বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু
ধর্ষণের অভিযোগে গণপিটুনি, কারাগারে ইমামের মৃত্যু
বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে রোববার (২৮ এপ্রিল) বিকেলে কিশোর গ্যাং সদস্যরা শাহরিয়ার হাসান রিমনকে ধারালো ছুরি এলোপাতাড়ি আঘাত করে। এতে সে গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয়রা তাকে নোয়াখালী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। তবে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
এ ঘটনায় রাতে আহত রিমনের মা ফরিদা ইয়াছমিন ২১ জনকে এজহারভুক্ত ও ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ রাতেই অভিযান পরিচালনা করে তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করে।
রিমনের মা ফরিদা ইয়াছমিন জানান, রিমনের পিঠে, মাথায়সহ মোট ছয়টি ছুরির আঘাত করা হয়। তার অপারেশন ঢাকা মেডিকেল কলেজে করানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসা চলছে। তার পিঠের আঘাতগুলো ফুসফুস পর্যন্ত চলে গেছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।
তিনি আরো জানান, হামলাকারীরা ভেবেছিল রিমন মারা গেছে। যখন জানতে পারে সে বেঁচে আছে, তখন তারা ফের হামলা করতে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। রিমনের অপরাধ দুই দল কিশোরের মাঝে চলমান দ্বন্দ্ব মিমাংসা করে দেওয়া। একপক্ষ মানলেও অপরপক্ষ মিমাংসার বিষয়টি মন থেকে মানতে পারেনি। তারাই আমার ছেলের উপর হামলা করেছে।
রিমনের বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, রিমনকে ধারালো ছুরি দিয়ে মোট ছয়টি আঘাত করা হয়েছে। নোয়াখালী জেনারেল হাসপতালে নেওয়া হলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তিনি রিমনের সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছেন।
ঢাকায় রিমনের সঙ্গে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা নাহিদা সুলতানা ইতু জানান, রাতেই রিমনের সিটিস্ক্যান করা হয়েছে। এরপর তার অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, রিমনের পিঠের আঘাতগুলো গুরুতর। ছুরির আঘাত প্রায় ফুসফুস পর্যন্ত চলে এসেছে। তার সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে।
রবিবার (২৮ এপ্রিল) বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে জেলা শহরের বার্লিংটন মোড়ে একদল কিশোর রিমনকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে।
স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নোয়াখালী পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বার্লিংটন এলাকাটি কিশোর গ্যাংয়ের আখড়া। এই এলাকা দিয়ে প্রতিদিন সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, হরিনারায়ণপুর স্কুল, সরকারি মহিলা কলেজসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা যাতায়াত করে। প্রতিদিন তাদের উত্ত্যক্ত করা হয়। কিন্তু ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। প্রশাসনেরও নজরদারি নেই।
এদিকে, রিমনকে ছুরিকাঘাত করে আহত করার প্রতিবাদে তার স্কুলের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে স্কুলের সামনে প্রধান সড়কে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে রিমনের স্কুলের শিক্ষার্থী ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী, স্কুলের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বক্তারা অবিলম্বে রিমনের উপর যারা হামলা করেছেন, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন জানান, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর সিসিটিভি ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এজহারভুক্ত একজনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনায় আমাদের আরো অনুসন্ধান চলছে। সিসি ক্যামেরা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অপরাধীদের খুব দ্রুতই আইনের আওতায় আনতে পারবেন বলে আশা করেন তিনি।
ঢাকা/সুজন/বকুল