সিন্ধু চুক্তির পরিণতি থেকে গঙ্গাপাড়ের জন্য সতর্কতা
Published: 26th, April 2025 GMT
ঢাকা, দিল্লি ও ইসলামবাদের সংবাদমাধ্যমগুলো যদিও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সিন্ধু চুক্তি ‘স্থগিত’ বা ‘সাসপেন্ড’ হওয়ার কথা বলেছে, বাস্তবে ঠিক সেটি ঘটেনি। কারণ, ১২ দফার এই বিস্তৃত চুক্তির কোথাও কোনো পক্ষের বেরিয়ে আসার বা একপাক্ষিকভাবে স্থগিত করার সুযোগই নেই। যে কারণে ভারতীয় পক্ষ এ ব্যাপারে পাকিস্তানকে যে আনুষ্ঠানিক পত্র দিয়েছে, সেখানে লিখেছে– ‘দ্য গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া হেয়ারবাই ডিসাইডেড দ্যাট দ্য ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি ১৯৬০ উইল বি হেল্ড ইন অ্যাবিয়েন্স উইথ ইমিডিয়েট এফেক্ট’। লক্ষণীয়- ‘সাসপেন্সন’ নয়, বরং ‘ইন অ্যাবিয়েন্স’। এর অর্থ সাময়িক অকার্যকারিতা, স্থগিত নয়। যেহেতু সিন্ধু চুক্তির আওতায় স্থগিত করার সুযোগ নেই, সেহেতু ভারত কৌশলী উপায়ে ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন দ্য ল অব ট্রিটিজ’ থেকে শব্দটি নিয়েছে। যেহেতু দুই দেশই ভিয়েনা কনভেনশনটি স্বাক্ষর করেছে, সেটির আওতায় পেহেলগাম পরিস্থিতিতে অন্য চুক্তি থেকে কোনো এক পক্ষ বেরিয়ে আসতে পারে।
বস্তুত কাশ্মীরের পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেসব ‘ব্যবস্থা’ নিয়েছিল, সে তালিকায় সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ছিল সিন্ধুর পানিবণ্টন চুক্তি। পরস্পরের নাগরিকদের দেশত্যাগের নির্দেশ, ভিসা বন্ধ, কূটনৈতিক সম্পর্ক সীমিত করা প্রভৃতি ব্যবস্থা উভয় দেশই অতীতে অনেকবার নিয়েছে; কিন্তু চুক্তিটির কার্যকারিতা অব্যাহত থেকেছে। এমনকি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ভারত-পাকিস্তান পশ্চিম সীমান্তের যুদ্ধ, আশির দশকের শিয়াচেন যুদ্ধ এবং ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধেও চুক্তিটি অক্ষত ছিল।
যদিও ২০১৬ সালের উরি হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সিন্ধু চুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়ে বলেছিলেন ‘পানি ও রক্ত একসঙ্গে বইতে পারে না’। সবকিছু সত্ত্বেও চুক্তিটি যে শেষ পর্যন্ত স্থগিত হতে পারে, ২৩ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত কেউ ধারণা করতে পারেনি।
এর একটি কারণ, ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত সিন্ধুর পানিবণ্টন চুক্তিকে আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে এশিয়ার সেরা দুই চুক্তির অন্যতম বিবেচনা করা হয়। অপর সেরা চুক্তিটি হচ্ছে ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চার দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত মেকং চুক্তি। ঢাকায় কিংবা কাঠমান্ডুতে বসেও আমরা যখন বাংলাদেশ-ভারত বা ভারত-নেপালে মধ্যে স্বাক্ষরিত বা স্বাক্ষরযোগ্য চুক্তিগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি, তখন ঘুরেফিরে সিন্ধু ও মেকং চুক্তির কথা আসে।
ভারত ও পাকিস্তানের মতো দুই ‘জন্মশত্রু’ রাষ্ট্রের মধ্যে সিন্ধু চুক্তি যে এত বছর টিকে থেকেছে, এর কারণ কিছু অদ্বিতীয় ও অন্তর্গত শক্তিশালী দিক। যেমন, এর নাম ‘সিন্ধু চুক্তি’ হলেও বাস্তবে আরও পাঁচটি উপনদীসহ মোট ছয়টি নদী এর আওতাভুক্ত। এর মধ্যে তিন ‘পশ্চিমা নদী’ সিন্ধু, বিতস্তা ও চন্দ্রভাগা নদীর সম্পূর্ণ অধিকার পাকিস্তানের এবং তিন ‘পূবালী নদী’ শতদ্রু, বিপাশা ও ইরাবতী নদীর সম্পূর্ণ অধিকার ভারতের। দুই দেশ তাদের ভাগের নদী নিজেদের মতো ব্যবহার করবে, কোনো পানি ভাগাভাগি, মাপামাপির ব্যাপার নেই।
দ্বিতীয়ত, সিন্ধু চুক্তিতে কোনো মেয়াদ নেই। যেমন বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ ৩০ বছর। যেমন, তিস্তা নিয়ে ২০১১ সালে স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত অন্তর্বর্তী চুক্তিটির মেয়াদ ছিল ১৫ বছর। সিন্ধুর পানিবণ্টন চুক্তি ছিল স্থায়ী।
আবার, দুই পক্ষের মতবিরোধ হলে সিন্ধু চুক্তিতে সালিশির ব্যবস্থা রয়েছে; যেটি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বা নেপালের চুক্তিগুলোতে নেই। এগুলোতে বলা হয়েছে, মতবিরোধ দেখা দিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা হবে। সিন্ধু চুক্তি অনুযায়ী মতবিরোধ দেখা দিলে বিশ্বব্যাংকে মধ্যস্থতা ও সালিশ করবে।
যে কারণে, আমরা বিভিন্ন সময়ে বলে এসেছি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আসলে তিনটি চুক্তি হওয়া উচিত– গঙ্গা অববাহিকা চুক্তি, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা চুক্তি, মেঘনা অববাহিকা চুক্তি। তাহলে এগুলোর শতাধিক উপনদীও স্বয়ংক্রিয়ভাবে চুক্তির আওতায় আসবে। এছাড়া নদীবিষয়ক চুক্তি হতে হবে স্থায়ী, মেয়াদি নয়। দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের সালিশি ব্যবস্থাও থাকতে হবে। বলা বাহুল্য, আমাদের এসব প্রত্যাশার অনুপ্রেরণা আসলে সিন্ধু চুক্তি। এখন খোদ সিন্ধু চুক্তির যখন এমন পরিণতি, তখন আমরা কী করব?
সিন্ধু চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পাকিস্তানের ভাগের তিনটি নদীর–সিন্ধু, বিতস্তা ও চন্দ্রভাগা–উজানে ভারত কোনো স্থাপনা নির্মাণ বা পানি আটকাতে পারবে না। ভারত বলছে, এখন তারা এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করে পানি আটকাবে। আর ছয়টি নদীর বন্যা ও বৃষ্টিপাতসংক্রান্ত যেসব তথ্য পাকিস্তানকে দেওয়ার কথা, সেটিও দেবে না। কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ভারতের ভাগের তিনটি নদীর–শতদ্রু, বিপাশা ও ইরাবতী–ড্যামগুলো বরং আকস্মিকভাবে ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানে ‘বন্যা অস্ত্র’ ছুড়ে দিতে পারে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সিন্ধু চুক্তির এই পরিণতি থেকে বাংলাদেশ কী কী সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেবে? ভারত ও পাকিস্তানের মতো মাত্র ৬টি নয়; রিভারাইন পিপলের গবেষণায় আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অন্তত ১২৩টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র তিনটি নিয়ে চুক্তি ও সমঝোতা রয়েছে: গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি এবং ফেনী ও কুশিয়ারা নিয়ে সমঝোতা। এছাড়া, ১৯৭২ সালের সমঝোতা ও পরবর্তী সংশোধন অনুযায়ী এখন আমরা ছয়টি বন্যাপ্রবণ নদীর–ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, তিস্তা, মেঘনা, ধরলা, দুধকুমার–১৪টি পয়েন্ট থেকে বন্যার আগাম তথ্য পেয়ে থাকি।
খোদা না খাস্তা, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক যে তলানিতে পৌঁছেছে, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে ভারত যদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন না করে বা ঝুলিয়ে দেয়? যদি বন্যার আগাম তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকে? সময় থাকতে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ ভেবে রাখা দরকার।
প্রথমত, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যাতে করে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন এবং তিস্তাসহ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা এবং মেঘনা অববাহিকাভিত্তিক চুক্তি করা যায়। দ্বিতীয়ত, ভারতের বন্যা পূর্বাভাসের ওপর ভরসা না করে স্যাটেলাইটসহ অন্যান্য প্রযুক্তির সহায়তায় নিজস্ব পূর্বাভাস ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। তৃতীয়ত, নদীবিষয়ক আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচগুলো যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর সম্পন্ন করতে হবে।
আমরা নিশ্চয় প্রত্যাশা করি না যে, ভারত-পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশ-ভারতেও দেখা দেবে। সময় থাকতে সাবধান হতে দোষ কী?
শেখ রোকন: লেখক ও নদী গবেষক
skrokon@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস থ অবব হ ক র আওত
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা
রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।
এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”
আরো পড়ুন:
ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত
ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত
উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”
সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”
এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে।
ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।
ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।
ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
ঢাকা/ফিরোজ