মানুষ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার ভালো সমাধান
Published: 28th, April 2025 GMT
বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং উদাহরণ সৃষ্টিকারী নির্বাচন উপহার দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের আগে সংস্কারের তালিকা ছোট হলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন এবং তালিকা বড় হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনপ্রত্যাশা এখনও তুঙ্গে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার এখনও তাদের জন্য ভালো সমাধান।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ‘মুহাম্মদ ইউনূস: রিয়েল রিফর্ম অর জাস্ট আ নিউ রুলিং ক্লাস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে সাক্ষাৎকারটি গতকাল রোববার আলজাজিরার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে জুলাই বিপ্লব, সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়া, সাবেক সরকারের দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি।
আলজাজিরার উপস্থাপক ড.
জবাবে ড. ইউনূস বলেন, মধুচন্দ্রিমা শেষ হোক বা না হোক, বাংলাদেশের মানুষ মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার এখনও তাদের জন্য ভালো সমাধান। তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে সরাসরি চলে যেতে এখনও বলছে না। বরং একটা ভালো নির্বাচন উপহার দিতে সরকারই নির্বাচন আয়োজনের দিকে যাচ্ছে। জনগণ তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা এখনও বলছে না।
লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সমাধান কি বাংলাদেশ একা করতে পারবে? জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কাজ করছি। তারা যাতে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কিছু বোঝাপড়া যাতে তৈরি হয়।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হবে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এ প্রশ্নের জবাবের একটি অংশ আওয়ামী লীগকেই নির্ধারণ করতে হবে। দলটি আগে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে– তারা নির্বাচনে যোগ দেবে কিনা। তারা এখনও কিছু ঘোষণা করেনি। তা ছাড়া নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন কী প্রতিক্রিয়া দেয়, সেটাসহ নানা বিষয় সামনে আসতে পারে।
তাহলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি তা নয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দল আছে, যারা বলতে পারে যে, এই আইনের অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।
সাক্ষাৎকারে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ড. ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের প্রসঙ্গ ওঠে। ড. ইউনূস জানান, তিনি বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে মোদির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে বলেছিলেন তিনি। জবাবে মোদি বলেছিলেন, এটা তাঁর জন্য সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে কিছু বললে, সেটি তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না।
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ড. ইউনূস বলেন, একসঙ্গে কাজ করার নীতি নিয়ে আগাতে চাই। আমরা একসঙ্গেই পারস্পরিক সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নিতে চাই।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ড ইউন স আওয় ম সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রতিনিধিত্ব করার ‘প্রতীকহীন’ সুযোগ
দশ বছর ধরে চালু থাকা দলীয় প্রতীক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ফিরছে নির্দলীয়তা। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন—স্থানীয় নির্বাচনে এবার থেকে ভোটাররাই প্রার্থী বেছে নেবেন দল নয়, প্রার্থীর যোগ্যতা, পরিচিতি ও কাজ দেখে। দলীয় প্রতীকহীন প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থায় ফেরায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দল স্বস্তি প্রকাশ করেছে।
গত ২৪ জুলাই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও প্রতীক ব্যবহার করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের নিয়ম বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
ওই দিন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “স্থানীয় সরকার নির্বাচনে থাকছে না দলীয় প্রতীক। ২৪ জুলাই উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে উত্থাপিত সংশোধনী সর্বসম্মতভাবে অনুমোদিত হয়।”
সংশোধিত চারটি আইন ও সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো হলো—
সিটি করপোরেশন আইন ২০১৫: ৩২ (ক) ধারা, পৌরসভা আইন ২০১৫: ৩০ (ক) ধারা, উপজেলা পরিষদ আইন ২০১৫: ১৬ (ক) ধারা, ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০১৫: ১৯ (ক) ধারা।
২০১৫ সালের এই ধারাগুলোর ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাধ্যতামূলক ছিল। সেই বাধ্যবাধকতাই এবার তুলে দিচ্ছে সরকার।
উপদেষ্টা বলেন, “দলীয় প্রতীক পাওয়া না পাওয়াকে কেন্দ্র করে বিগত সময়ে হানাহানি, সহিংসতা, মনোনয়ন বাণিজ্য—সবই আমরা দেখেছি। এখন থেকে প্রার্থীরা নিজের প্রতীক নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন, আর যোগ্যতাই হবে নির্বাচনের মাপকাঠি।”
২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক চালু করে। যুক্তি ছিল রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও দলীয় জবাবদিহি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়
প্রার্থী নির্বাচনে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ। স্থানীয় রাজনীতিতে পেশিশক্তির আধিপত্য। দেখা দেয় মনোনয়ন বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বহুদিন ধরেই স্থানীয় সরকারে নির্দলীয় নির্বাচনের পক্ষে ছিল।
সুজন সভাপতি ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “দলীয় প্রতীক চালুর পর জনগণের ভোটাধিকার সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। জনগণের প্রতিনিধি নয়, দলের প্রতিনিধি জয়ী হতেন। সেই কাঠামো ভাঙার এই উদ্যোগ সাহসী ও সময়োপযোগী।”
তিনি আরো বলেন, “এখন যোগ্যতা, পরিচিতি, জনগণের সঙ্গে সম্পর্কই হবে প্রার্থীর সাফল্যের ভিত্তি।”
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, “দলীয় পরিচয়কে অনেকে ব্যবহার করেছেন স্রেফ জেতার মাধ্যম হিসেবে। এতে যোগ্য প্রার্থীরা মনোনয়ন না পেয়ে বাদ পড়েছেন, আবার অযোগ্যরাও জিতেছেন। এই সংস্কার মূলত রাজনীতিকে সেবা কেন্দ্রিক করতে সহায়ক হবে।”
তিনি আরো বলেন, “এটি কোনো চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের যৌথ সুপারিশে, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দিতে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। বিএনপির ৩১ দফা রোডম্যাপেও এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দলীয় প্রতীকের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো রাজনৈতিক সহিংসতায় রূপ নেয়, স্থানীয় নেতৃত্বের জায়গায় জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন ঘটে। দলীয় প্রতীক বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপির দাবির প্রতিফলন।”
ঢাকার দোহার উপজেলার মুদি দোকানি আমির হোসেন বলেন, “আগে এলাকার ভালো প্রার্থী থাকলেও দল না থাকলে ভোট দেওয়া যেত না। এখন নিজের বিবেক দিয়ে ভোট দিতে পারব এটাই সবচেয়ে বড় স্বস্তি।”
চট্টগ্রামে পটিয়ার সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী মনিরুল ইসলাম বলেন, “গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে দাঁড়াতে পারিনি। এবার নিজের প্রতীক নিয়ে দাঁড়াতে পারব। এটা আমার মতো মানুষের জন্য বিশাল সুযোগ।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী বলেন, “এই সিদ্ধান্ত স্থানীয় সরকারের প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করবে। আগে জনপ্রতিনিধিরা দলীয় নেতার কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন, এখন জনগণের কাছে থাকবেন। নেতৃত্বে সত্যিকারের প্রতিযোগিতা ফেরানোর উদ্যোগ হবে।”
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আনিচুর রহমান বলেন,“দলীয় প্রতীকের পরিবর্তে নির্দলীয় প্রতীকে নির্বাচন মানে, মানুষের ভোটাধিকার ও বিশ্বাস ফেরানোর সুযোগ। আগে মানুষ ভাবতো ভোট আগেই ঠিক হয়ে গেছে, এখন ভাববে আমি ঠিক করব কে জয়ী হবে।”
ঢাকা/এএএম/ইভা