সুন্দর ভবনে পরিত্যক্ত কক্ষ, কমেছে শিক্ষার্থী, ঢিমেতালে চলে কার্যক্রম
Published: 29th, April 2025 GMT
দিনাজপুরে ঐতিহাসিক গোর-এ-শহীদ মাঠের পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ভবন। রাস্তার পাশে প্রাচীর ঘেরা তিনতলা প্রশাসনিক ভবনের সঙ্গে লাগোয়া পাঁচতলা একটি প্রশিক্ষণ ভবন সবার চোখে পড়বে। প্রাচীরের ভেতরে ছোট একটি মাঠ। মাঠের একদিকে শিশুদের জন্য দোলনা, টংঘরের আদলে দুটি স্লিপার ও দুটি ঢেঁকি। সব মিলিয়ে কোলাহলমুক্ত শান্ত পরিবেশ। তবে বাইরে থেকে যতটুকু চকচকে দেখায়, ভেতরের চিত্র ঠিক তার উল্টো।
একদিকে জনবল–সংকট, ভবনের ভেতরে পরিত্যক্ত কক্ষ, শিশুশিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় উপকরণসামগ্রী না থাকা এবং শিক্ষার্থীসংখ্যা কমে যাওয়ায় ঢিমেতালে চলছে শিশু একাডেমির কার্যক্রম। বিভিন্ন দিবস ঘিরে স্বল্প বাজেটে শিশুশিক্ষার্থীদের কবিতা আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য আর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে শিশুরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিশুরা বহুমাত্রিক আনন্দের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। তাদের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান শিশু একাডেমি। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও শিশুদের উপযোগী করে শিশু একাডেমিকে গড়ে তোলা যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার ভেতরে ঢুকে প্রশিক্ষণ ভবনের নিচতলার করিডরে ১২-১৪ জন অভিভাবককে দেখা গেল। নিচতলার একটি কক্ষে শিশু বিকাশ শ্রেণির ১১টি শিশুকে ছড়া শোনাচ্ছেন শিক্ষক আলিফা আক্তার। পাশের কক্ষে প্রাক্-প্রাথমিকের শিশুদের গোলাকারভাবে বসিয়ে গল্প বলছেন শিক্ষক রোমানা আক্তার।
রোমানা আক্তার বলেন, ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি কর্তৃক শিশুদের গল্প বলা, ছড়া, কবিতা, সংখ্যা গণনা, ছবি দেখে শেখা ও বলা বিষয়ে নির্ধারিত সিলেবাস আছে। এক বছর ধরে শিশুদের এসবই শেখানো হয়। এ ছাড়া কিছু খেলাধুলার উপকরণ আছে। পড়ানো শেষে খেলনার উপকরণ দেওয়া হয়। সপ্তাহের ৫ দিন সকাল ১০টা থেকে ক্লাস শুরু হয়। চলে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত। পরে আধা ঘণ্টা বাইরের মাঠে স্লিপার, দোলনা, ঢেঁকি এগুলোতে খেলাধুলা করে শিশুরা। দুপুর ১২টায় ছুটি হয়।
সাড়ে তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের শিশু একাডেমিতে শিশু বিকাশ ও প্রাক্-প্রাথমিক শাখায় ভর্তি করান অনেক অভিভাবক। সুইটি আক্তার নামের একজন অভিভাবক বলেন, ‘বাচ্চার বয়স চার বছর। এখানে ভর্তি করাইছি চার মাস হলো। আগে বাচ্চাটা কারও সঙ্গে কথা বলত না, মিশতে চাইত না। এখানে ভর্তি করানোর পর ক্লাসে তার পাশে বসে থাকতে হতো। এখন একা একা ক্লাসে বসে। ছড়া বলতে পারে।’
পরে আরও কয়েকজন অভিভাবক বলেন, অবকাঠামোগত কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু কেন জানি দিন দিন শিশু একাডেমিতে শিক্ষার্থীসংখ্যা কমছে। তাঁদের মতে, শিশুর মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে নতুন কিছু নেই। এ কারণে শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকদেরও আগ্রহ কমছে। এ ছাড়া বাড়িতে মুঠোফোনে ভিডিও দেখার নেশা বাড়ছে শিশুদের।
সিসিমপুর প্রকল্প শেষ। দিনাজপুর শিশু একাডেমির প্রশিক্ষণ ভবনের নিচ তলায় সেই প্রকল্পের পরিত্যক্ত ভ্যানগাড়ি.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘লিচুর বাগানে’ যে কারণে ‘পিরিতের বেড়া’ দিতে হয়
‘তাণ্ডব’ সিনেমার গান ‘লিচুর বাগানে’ প্রকাশের পর রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। কফি শফ থেকে বাস, মেট্রোরেল আশপাশে কান পাতলে গানটা শোনা যাচ্ছে। কেউ না কেউ শুনছেন। সামাজিক মাধ্যমের স্টোরি ও রিলসেও গানটি ভেসে বেড়াচ্ছে। চরকি ও এসভিএফের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত গানটির আজ পর্যন্ত (১২ এপ্রিল ২০২৫) ভিউ হয়েছে যথাক্রমে ১২ মিলিয়ন ও ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন।
উচ্ছ্বসিত অনেক দর্শক গানটি নিয়ে মন্তব্যও করেছেন। তাহসিন নামের এক শ্রোতা লিখেছেন, ‘গানটির প্রতিটি সুর, দৃশ্য ও পরিবেশনায় বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অপূর্ব রূপ ফুটে উঠেছে। যাত্রাপালার ফিল্মের আবহে তৈরি এই গানটি যেন গ্রামীণ বাংলার প্রাণস্পন্দন তুলে ধরেছে। লোকেশন থেকে শুরু করে কস্টিউম, প্রতিটি ডিটেইলে আছে নিখুঁত যত্ন।’
গানটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বন্ধুদের মধ্যে খুনসুটিও চলছে। বন্ধুকে মেনশন দিয়ে কেউ যেমন প্রশ্ন করছেন, ‘কী রে, বেড়া ডিঙাতে পারলি?’ আবার কেউ জিজ্ঞেস করছেন বল তো, ‘“লিচুর বাগানে” কেন “পিরিতের বেড়া” দিতে হয়?’
প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক। শুরুতেই ‘লিচুর বাগানে’ গানটি দিয়ে আলোচিত, ‘কে এই ছত্তার পাগলা’ শীর্ষক প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। গবেষক সরোজ মোস্তফার মতে ‘কে দিল পিরিতের বেড়া লিচুরও বাগানে’ পঙ্ক্তির রচয়িতা ও সুরকার ছত্তার পাগলা। তবে সংগীতগবেষক গৌতম কে শুভর মত ভিন্ন। তাঁর মতে, ‘এটি মূলত প্রচলিত ঘেটু গান। “কে দিল পিরিতির বেড়া লিচুর বাগানে?” অংশটি মূল গানের অংশ। ছত্তার পাগলা নিজের মতো করে এর সঙ্গে কথা সংযোজন করেছেন। নেত্রকোনায় ছত্তার পাগলার লেখা রূপটিই বিখ্যাত হয়েছে।’ ২০১৪ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন ছত্তার পাগলা। জীবদ্দশায় রচনা ও সুরারোপ করেছেন কয়েক শ গান। মৃত্যুর বছর তিনেক আগে তাঁর কাছ থেকে গানটি শুনে হাতে লিখে রেখেছিলেন আল মামুন চৌধুরী।
আল মামুন চৌধুরীর লেখা অনুযায়ী গানটির কথা:
কে দিল পিরিতের বেড়া, লিচুরও বাগানে
লিচুরও বাগানে গো সই…লিচুরও বাগানে …(ঐ)
পাখি খাইছ না লিচু, বন্দে খাইবো
বন্দে লিচু খাইয়া, খুশি হইবো
আমার কাছে আইসা কইবো
কত শান্তি দিবো আমার মনেপ্রাণে (ঐ)
ছোট ছোট লিচুগুলি, বন্দে তুলে আম্বো তুলি
বন্দে দেয় গো আমার মুখে,
আমি দিতে চাই বন্ধুর মুখের পানে…(ঐ)
মিষ্টি লিচু খাইয়া বন্দে, বাঁশি বাজায় মন আনন্দে
আমার মনে লাগে সন্দে বন্ধু সম্ভব জাদু জানে (ঐ)
বাঁশি হাতে পলায় মালা, তারে চায় ছত্তার পাগলা,
করব লইয়া উলামেলা, (২) প্রাণবন্ধুর সনে…(ঐ)
সরল অর্থে ‘বেড়া’ হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা তথা বাধা তৈরির উপকরণ। আর ‘পিরিতের বেড়া’ মানে ভালোবাসায় বাধা। কিন্তু ভালোবাসার এই বাধা তথা প্রতিবন্ধকতা ‘লিচুর বাগানে’ কেন? কবিতা তথা গানে অর্থের তারতম্য অর্থের অনুগত না হয়ে বোধ কিংবা ভাবনার পরবশে প্রস্ফুটিত হয়। ব্যক্তিবিশেষে তা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ লাভ করে, ভিন্ন ভিন্ন মূল্য পায়।
আরও পড়ুন‘লিচুর বাগানে’ গানটি দিয়ে আলোচিত, কে এই ছত্তার পাগলা ০৬ জুন ২০২৫‘কে দিল পিরিতের বেড়া, লিচুরও বাগানে’ একটি ‘ঘাটু গান’ বা ‘ঘেটু গান’। এই গান প্রসঙ্গে জানা যায়, এই গানের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল নৃত্য। অল্প বয়সী একটি ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে তার নৃত্যের মধ্য দিয়ে ঘেটু গান পরিবেশিত হতো। সঙ্গে থাকত ঢোল, হারমোনিয়াম, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। কয়েকটি ‘ঘেটু গানে’র দৃষ্টান্ত দেখা যাক।
(১)
‘তুই আমারে চিনলে নারে
আমি তো রসের কমলা।
বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি
মধ্যে নলের বেড়া।’
(২)
ঘুমাইলা ঘুমাইলারে বন্ধু
পান খাইলায়না
এক বালিশে দুইটি মাথা
সুন্দর কইরা কওরে কথা।
গানগুলো থেকে উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না যে ‘ঘেটু গানে’ যেমন ভাষার সারল্য আছে, তেমনিভাবে রূপকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যাপিত জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা নানা উপকরণ। আর এ ক্ষেত্রে গান রচনার সময় রচয়িতা তাঁর আশপাশ থেকেই গান নির্মাণের উপকরণগুলো যে নিয়ে থাকবেন, সেই ধারণাও পাওয়া যায়। ‘লিচুর বাগানে’ গানের ক্ষেত্রেও বোধ করি এটা ঘটেছে। তাই এই গানে যেমন ‘লিচু বাগানে’র কথা আছে, একইভাবে আছে ‘পাখি’, ‘বাঁশি’ ও ‘লিচু’র কথাও। পাখিকে লিচু না খাওয়ার অনুরোধ করলেও পাখি যেন খেতে না পারে সে কারণেই যে বেড়া দেওয়া হয়েছে; সেই ব্যথাও গানটিতে ফুটে উঠেছে। সব মিলিয়ে ‘লিচুর বাগান’ শেষ পর্যন্ত ‘লিচুর বাগানে’ সীমাবদ্ধ থাকেনি। হয়ে উঠেছে ভালোবাসার প্রতীক।
কথায় আছে, ভালোবাসা জয় করে নিতে হয়। জিতে নেওয়ার মধ্যেই আছে অপার আনন্দ। ভালোবাসায় প্রতিবন্ধকতা থাকাটা মোটেও দোষের নয়। বরং বাধা না থাকাটাই যেন আশ্চর্যের। একইভাবে ভালোবাসা জিতে নেওয়ার পরও পেয়ে গেছি বলে হাল ছেড়ে দিলে চলে না। ‘লিচুর বাগান’কে এ ক্ষেত্রে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করলে, ‘লিচুর বাগানে’ ‘পিরিতের বেড়া’ তথা ভালোবাসার বেষ্টনী দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কেননা ‘ভালোবাসা’কে ভালোবাসা দিয়েই আগলে রাখতে হয়। প্রবল যত্নে আঁকড়ে রাখতে হয়। যেন কোনো কৌতূহলেই তা দুলে না ওঠে, হারিয়ে না যায়।
আরও পড়ুনসাবিলা তো ‘লিচুর বাগানে’ দিয়ে কী যে আগুন লাগিয়ে দিল...০৫ জুন ২০২৫