ভারতে অনলাইনে ছড়ানো হচ্ছে মুসলিমবিদ্বেষী গান, কনটেন্ট
Published: 29th, April 2025 GMT
কাশ্মীরে গত মঙ্গলবার বন্দুকধারীদের হামলার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ভারতে ইউটিউবে নতুন একটি গান প্রকাশ পেয়েছে। ওই গানে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ উগরে দেওয়া হয়েছে।
ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে ওই হামলায় ২৫ পর্যটক ও একজন স্থানীয় কাশ্মীরি ঘোড়াচালক নিহত হয়েছেন। গত দুই দশকের বেশি সময়ে কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর এটাই সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা।
ইউটিউবে নতুন যে গান প্রকাশ পেয়েছে সেটির শিরোনাম, ‘পেহলে ধরম পুছা’ (তারা প্রথমে তাঁদের ধর্ম জানতে চেয়েছিল)। ওই গানের কথায় মুসলিমরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
ইউটিউবে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশিবার ওই গান দেখা হয়েছে। এটিই মুসলিমবিদ্বেষী একমাত্র গান নয়। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল–জাজিরা এমন আরও অন্তত ২০টি গান খুঁজে পেয়েছে। গানগুলোতে ইসলাম নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো ও বিদ্বেষমূলক কথা বলা হয়েছে। এগুলোই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ছড়ানো হচ্ছে বিদ্বেষ ও আতঙ্ক।
গানগুলোতে ধারাবাহিকভাবে ভয়ংকর সব বর্ণনা রয়েছে। পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার পর অনেকে দাবি করেছেন, বন্দুকধারীরা হিন্দু পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিলেন। ওই সব গানে এ বিষয়টির উল্লেখ করে বলা হয়, ‘ভারতীয় মুসলিমদের আর বিশ্বাস করা যায় না।’ অথচ বন্দুকধারীদের থামাতে গিয়ে একজন মুসলিম ঘোড়াচালক সেদিন প্রাণ হারিয়েছেন। আবার আহত পর্যটকদের উদ্ধারে স্থানীয় মুসলিমরা এগিয়ে এসেছেন।
মানুষ ইউটিউবে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশিবার গানটি দেখেছেন। মুসলিমবিদ্বেষী এটিই একমাত্র গান নয়। আল–জাজিরা এমন আরও অন্তত ২০টি গান খুঁজে পেয়েছে।গত সপ্তাহে উগ্র জাতীয়তাবাদী কিছু গানে পাকিস্তানকে পারমাণবিক হামলার মাধ্যমে ধ্বংস করার ডাক দেওয়া হয়েছে। কিছু গানে ভারত সরকারের প্রতি পাকিস্তানকে ‘মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে’ বলা হয়েছে। আবার ‘পাকিস্তানিদের রক্তের বিনিময়ে পেহেলগামে নিহতদের প্রতিশোধ’ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে কিছু গানে।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন গ্রুপ থেকে গানগুলো অনলাইনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা গানগুলো বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপে ছড়িয়ে ভারতীয়দের ভেতর ভয়, ঘৃণা এবং বিভাজন সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
এমন প্রচারণায় ভারতের একাধিক রাজ্যে বাস্তবেও মুসলিমদের বাড়িঘরে হামলাসহ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও উত্তরাখন্ডে মুসলিমদের ওপর হামলা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কাশ্মীরি মুসলিমদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, রাস্তায় হকারদের মারধর করা হচ্ছে। প্রতিশোধমূলক আরও নানা কর্মকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন তাঁরা।
কিছু চিকিৎসাকেন্দ্রে মুসলিম রোগীদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন হিন্দু চিকিৎসকেরা।
এরই মধ্যে গত শুক্রবার উত্তর প্রদেশের আগ্রায় একজন মুসলিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একজন উগ্র হিন্দুত্ববাদী এ হত্যার দায় স্বীকার করে বলেছেন, পেহেলগামে হামলার প্রতিশোধ নিতে এটা করেছেন তিনি।
এ ছাড়া এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) দিয়ে নানা ভিডিও তৈরি করা হচ্ছে এবং হামলার সময়ের গিবলি ইমেজ তৈরি করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পেহেলগামে হামলার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে হামলা–সংক্রান্ত নানা কনটেন্টের বন্যা বইছে।
অধিকাংশ কনটেন্টের সুর প্রায় একই রকম, যেমন সেগুলোতে পেহেলগামে হামলার বিষয় এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, যেন এটা হিন্দুত্ববাদ ও সনাতন ধর্মের ওপর হামলা ছিল। কোথাও কোথাও মুসলমানদের হুমকি বলে উল্লেখ করে হিন্দুদের একজোট হতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
আল–জাজিরা মুসলিমবিদ্বেষী যেসব গান পরীক্ষা করে দেখেছে, সেসবের একটির শিরোনাম, ‘জাগো হিন্দু জাগো’। এ গানে ‘দেশের ভেতরে বিশ্বাসঘাতকদের’ চিহ্নিত করতে বলা হয়। এখানে মূলত মুসলিমদের ইঙ্গিত করা হয়েছে। গানের ভিডিওটি ইউটিউবে এ পর্যন্ত দেখা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজারের বেশি। এতে পেহেলগামে হামলা নিয়ে এআই দিয়ে তৈরি কনটেন্টও ব্যবহার করা হয়েছে।
এআই দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নানা ভিডিও। হামলার সময়ের গিবলি ইমেজ তৈরি করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পেহেলগামে হামলার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে হামলা–সংক্রান্ত নানা কনটেন্টের বন্যা বইছে।‘মোদি জি আব মহা যুধ হো জানে দো’ (মোদি, সেই মহান যুদ্ধ শুরু করুন) শিরোনামের আরেকটি গানে ভারতে বসবাসকারী মুসলিমদের ‘সাপের’ সঙ্গে তুলনা করা হয়। অন্য একটি গানে পেহেলগামের হামলাকে ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ভারতের হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয় অপর একটি গানে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো কোনো পোস্টে পেহেলগামে হামলাকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং ভারত সরকারকে ইসরায়েলের দেখানো পথে প্রতিশোধ নিতে উসকানি দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুনপেহেলগাম হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার টিআরএফের, আগের দাবির জন্য দায়ী করল ভারতীয় গোয়েন্দাদের২৬ এপ্রিল ২০২৫হামাসের ওই হামলার পর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় প্রতিশোধমূলক হামলার নামে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের হামলায় এ পর্যন্ত ৫২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এ উপত্যকার অধিকাংশ স্থাপনা। তা থেকে বাদ যায়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, শরণার্থীশিবির, এমনকি কোনো হাসপাতালও।
পেহেলগামে হামলার পর থেকে ভারতের বিভিন্ন সড়কে কাশ্মীরি ও মুসলিমদের লক্ষ্য করে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। দ্য অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর)–এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২২ এপ্রিলের হামলার পর ভারতজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা, ভীতি প্রদর্শন ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দেওয়ার ২১টি ঘটনা ঘটেছে। কাশ্মীরি নারী ও শিক্ষার্থীরাও নৃশংসতা এবং ঘৃণার শিকার হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব অর্গানাইজড হেইট (সিএসওএইচ)’–এর নির্বাহী পরিচালক রাকিব হামিদ নায়েক বলেন, কাশ্মীরে হামলার পর ভারতে সামাজিক মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে দেখেছে তাঁদের এই সেন্টার।
হামিদ নায়েক বলেন, ‘মিম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ছবি, ভিডিও এবং মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে মুসলিমদের প্রায়ই অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এগুলো পরিকল্পিতভাবে মানুষের আবেগ উসকে দেওয়া ও মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্যকে ন্যায়সংগত করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হচ্ছে।’
আরও পড়ুনপাকিস্তান যেকোনো কিছুর জন্য তৈরি, ভারত চেষ্টা করে দেখতে পারে: খাজা আসিফ৭ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কারাগারে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার
কেরাণীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সুজনের (৪৫) ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার হয়েছে।
রবিবার (১৫ জুন ) দুপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার বলেন, “কারাগারের একটি কক্ষে তিনজন বন্দি থাকতেন। তাদের মধ্যে একজন আদালতে হাজিরা দিতে যান। অন্য একজন ঘুমিয়ে ছিলেন। সেই সুযোগে সাইদুর রহমান সুজন নিজে গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।”
আরো পড়ুন:
মহাসড়কের পাশ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার
হবিগঞ্জে বৃদ্ধের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
তিনি আরো বলেন, “বিষয়টি জানতে পেরে প্রথমে তাকে কারা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”
কারাগার সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ঘটনায় আলোচিত ছিলেন সাইদুর রহমান সুজন। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইন ও আইসিটিসহ অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সাইদুর রহমান সুজন আত্মগোপনে ছিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে উত্তরার একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারের পর থেকে তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন।
ঢাকা/শিপন/মাসুদ