দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করলেও কোটি কোটি শ্রমিক প্রতিদিন শোষণ, নিরাপত্তাহীন কর্মপরিবেশ এবং মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। অর্থনৈতিক শোষণের বাইরে, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তায়ও উদ্বেগ আছে। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধস, যাতে এক হাজারের বেশি শ্রমিক প্রাণ হারান, ছিল একটি চরম সতর্কবার্তা। কিছু অগ্রগতি হলেও এখনও অনেক কারখানার অবস্থা নাজুক। 


আন্তর্জাতিক শ্রম মান অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন গঠন একটি মৌলিক অধিকার হলেও বাংলাদেশে অনেক জায়গায়ই তা কার্যত নিষিদ্ধ। সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেই শ্রমিকদের হয়রানি, বরখাস্ত বা হামলার মুখে পড়তে হয়। মালিকরা প্রভাবশালী ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর ছত্রছায়ায় থেকে ইউনিয়ন নেতাদের কালো তালিকাভুক্ত করেন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস না পায়। সরকারও শ্রমিকের পক্ষে না দাঁড়িয়ে বরং মালিকদের পক্ষ নেয়, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ব্যবহার করে। ফলে শ্রমিকরা কার্যত নিঃস্ব ও অসহায় থেকে যান, ন্যায্য মজুরি বা নিরাপদ পরিবেশের জন্য দর-কষাকষির ক্ষমতা থাকে না।


এই শোষণের মানবিক খরচ অপরিসীম। একঘেয়ে শ্রমের কারণে শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন শ্রমিকরা। মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আরও ভয়াবহ—চাকরি হারানোর আশঙ্কা, নিয়মিত মানসিক নির্যাতন ও দুর্ঘটনার ট্রমা থেকে অনেকে বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও পিটিএসডিতে ভোগেন। নারীরা আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন—যৌন হয়রানি, বৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতা তাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা। অথচ অভিযোগ জানানোর কোনো নিরাপদ ও কার্যকর উপায় নেই, বরং অভিযোগ করলে তারা হয়রানির শিকার হন।


বাংলাদেশের শ্রম আইনগুলো কাগজে-কলমে প্রগতিশীল হলেও বাস্তবে কার্যকর নয়। শ্রম মন্ত্রণালয় ও পরিদর্শন বিভাগ দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ায় আইন প্রয়োগ হয় না। সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শিল্পের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়ায় মানুষের চেয়ে মুনাফার দিকেই বেশি নজর দেয়। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোও দায় এড়াতে পারে না—তাদের সস্তা উৎপাদনের চাহিদা শ্রমিক শোষণকে ত্বরান্বিত করে। কিছু কর্পোরেশন নিরাপত্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও, তা যথেষ্ট নয় যতক্ষণ না তারা বাধ্যতামূলকভাবে ন্যায্য মজুরি ও শ্রমিক ক্ষমতায়নের অঙ্গীকার করে। ব্র্যান্ডগুলোর উচিত লোক দেখানো অডিটের বাইরে গিয়ে মানবাধিকার সম্মত সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দেশের ভেতরে সরকারকে অবশ্যই শ্রমিকদের ‘ভোগ্যপণ্য’ হিসেবে না দেখে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শ্রম পরিদর্শন জোরদার, প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অনুমতি ও মজুরি চুরির বিচার জরুরি পদক্ষেপ।


যদিও শ্রম সংস্কারের প্রধান দায়িত্ব সরকারের ও কারখানা মালিকদের, তবুও বৈশ্বিক ভোক্তারাও এ থেকে মুক্ত নয়। পাশ্চাত্যের ফ্যাশনের চাহিদাই বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে শ্রমিক নিপীড়নের মূল চালিকা শক্তি। অধিকাংশ ভোক্তা জানেন না, যে সস্তা জামাকাপড় তারা কেনেন, তার পেছনে কতটা মানুষের কান্না লুকিয়ে আছে। ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে এমন ব্র্যান্ড বেছে নেওয়া—এই ধরনের ‘নৈতিক ভোক্তা আচরণ’—কর্পোরেশনগুলোকে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তবে শুধু ব্যক্তিগত পছন্দ নয়, কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন কঠোর নিয়মনীতির, সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতির।


বহুজাতিক ব্র্যান্ডগুলোর ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’ বা সিএসআর প্রকৃত মানে হবে বাধ্যতামূলক চুক্তির মাধ্যমে জীবিকা-নির্ভরযোগ্য মজুরি, নিরাপত্তা উন্নয়নে তহবিল এবং সংগঠিত শ্রমিকদের সমর্থন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের শ্রম আইন যতই থাকুক, কার্যকর হওয়ার অভাবেই এগুলো দাঁতহীন। দুর্নীতিগ্রস্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলো নির্বিঘ্নে চলে। শিল্প পরিদর্শন অধিদপ্তরকে আরও সম্পদ, স্বাধীন নজরদারি ও কঠোর শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দিতে হবে। শ্রম আদালতগুলোকে করতে হবে আরও সহজপ্রাপ্য ও দ্রুত কার্যকর। আইনি সংস্কারে থাকা উচিত ছাঁটাইয়ের ক্ষতিপূরণ, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও বেআইনি বরখাস্তের বিরুদ্ধে সুরক্ষার মতো মৌলিক অধিকার।


বাংলাদেশি শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্যসংকট নিয়ে খুব কম কথাই হয়। চাকরি হারানোর আতঙ্ক, তিরস্কারের অপমান, দুর্ঘটনার ট্রমা—সব মিলে অনেকেই হতাশা, উদ্বেগ ও মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন। অথচ কারখানা অঞ্চলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অনুপস্থিত। কারখানাগুলোকে বাধ্য করতে হবে কাউন্সেলিং পরিষেবা চালু করতে, এবং মানসিক স্বাস্থ্যকেও পেশাগত নিরাপত্তার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। একটি সুস্থ শ্রমশক্তি শুধু নৈতিক কর্তব্য নয়—টেকসই উৎপাদনের জন্যও অপরিহার্য।


বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের এই লড়াই কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি বৈশ্বিক লোভ ও সরকার-কর্পোরেশন যোগসাজশের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রাম। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন ও সচেতন ভোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া পরিবর্তন সম্ভব নয়। শুধু বয়কট নয়—কারণ তা শ্রমিকদের আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে—বরং চাই ধারাবাহিক প্রচারাভিযান, শেয়ারহোল্ডারদের চাপ এবং আইন প্রণয়নের জন্য রাজনৈতিক চাপ।


মে দিবস বিদায় নিয়েছে, কিন্তু শ্রমিক অধিকারের লড়াই এখনও শেষ হয়নি। তাদের জন্য ন্যায়বিচার বিলম্ব করা চলবে না। স্থানীয় ও বৈশ্বিক ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির মাধ্যমেই কেবল আমরা নিশ্চিত করতে পারি মর্যাদা, ন্যায্যতা ও নিরাপত্তা।


পারভেজ আলম: গবেষক 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর ক র যকর কর প র র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ছোট্ট মেয়েকে কেন নিয়মিত ই মেইল পাঠাচ্ছেন আলিয়া

 

মেয়ে রাহা আসার পর বদলে গেছেন মা অভিনেত্রী আলিয়া ভাট। জন্মের পর থেকেই প্রতি মাসে রাহাকে একটি করে ই-মেইল লিখে পাঠিয়ে আসছেন আলিয়া। তাতে লেখা থাকে–আজ রাহা প্রথম হেঁটেছে এক পা, আজ সে দাদির কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আজ সে বাবার গালে এক ছোট্ট চুমু খেয়েছে। সেই ই-মেইলের সঙ্গে থাকে অসংখ্য ছবি–কখনও বাবার সঙ্গে খেলায় মত্ত, কখনও মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুম। ই-মেইল অ্যাটাচমেন্টে সাজিয়ে রাখা থাকে ছোট ছোট মুহূর্তের জীবন্ত স্মৃতি। আলিয়া বলেন, আমি চাই, রাহা যখন বড় হবে। ওর যখন ১৫ বছর বয়স হবে, তখন আমি তাকে মেইল বক্সটি দিয়ে বলব, ‘এই দেখো, এগুলো তোমার ছোটবেলার গল্প। এইভাবে আমরা তোমায় ভালোবেসে বড় করেছি।’ রাহা আসার পর অনেক কিছুই বদলেছে আলিয়ার জীবনে। আগের তুলনায় অনেক বেশি ধৈর্য ধরতে পারেন তিনি, অনেক কিছু বুঝে নিতে পারেন সময় নিয়ে। এক সাক্ষাৎকারে আলিয়া বলেন, ‘আমি নিজেকে নতুন করে চিনতে শিখেছি।’ তবে এই মাতৃত্বের যাত্রা একেবারে খোলামেলা ছিল না শুরু থেকেই। প্রথমদিকে মেয়েকে আড়ালে রাখতে চেয়েছিলেন রণবীর ও আলিয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরুতে রাহার একটিও ছবি প্রকাশ করেননি। কারণ ক্যামেরা আর ফ্ল্যাশ থেকে রাহাকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন তারা। সময়ের সঙ্গে বদলে যায় অনেক কিছু। একদিন আলিয়া নিজেই নিয়ে এলেন ছোট্ট রাহাকে পাপারাৎসির সামনে। সেদিন সবাই অবাক হয়েছিলেন। কারণ, ক্যামেরা দেখে ভয় পায়নি একরত্তি রাহা। সাবলীলভাবে তাকিয়ে পোজও দিয়েছিল। যেন একেবারে তৈরি সে, এই দুনিয়ার আলো আর ক্যামেরার ঝলক সামলাতে। এরপর চলতি বছরে বলিউড অভিনেতা সাইফ আলি খানের ওপর হামলার পর থেকে আরও বেশি সতর্ক হয়ে উঠেছেন রণবীর ও আলিয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে রাহার সব ছবি সরিয়ে ফেলেছেন। পাপারাৎসিকে অনুরোধ করেছেন, যেন রাহার ছবি না তোলা হয়। রণবীর তো এমনিতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুপস্থিত। আলিয়াও এখন মেয়েকে নিয়ে খুবই রক্ষণশীল। তিনি চান, রাহা নিজের ইচ্ছায় বড় হোক, নিজের শর্তে পরিচিত হোক দুনিয়ার সঙ্গে। 
ক্যামেরার সামনে আলিয়া নানান চরিত্রে অভিনয় করেন। বাস্তব জীবনে তাঁর সেরা চরিত্র ‘মা’ এবং সেই চরিত্রে তিনি নিজের জন্য নয়, রাহার জন্য প্রতিটি দিন লিখে রেখে যাচ্ছেন একেকটি দৃশ্য। একেকটি লাইভ মেমোরি। যেন একদিন সেই ছোট্ট মেয়েটি যখন জানবে তার জীবনের গল্প; সে যেন দেখে, ভালোবাসা কেমন করে জমা হয় প্রতিদিনের ছোট্ট ছোট্ট মুহূর্তে। সূত্র: আনন্দবাজার। 


 

সম্পর্কিত নিবন্ধ