সংস্কারের প্রক্রিয়ায় আমরা যারা বিভিন্নভাবে সরকারি কর্মচারী বা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল, তাদের সবার লক্ষ্য ছিল জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রতিবেদনের ওপর। এই প্রতিবেদনের অনেক সুপারিশ এতই হতাশ করেছে যে সরকারকেও দেখে মনে হচ্ছে, তারা জনপ্রশাসন সংস্কারের আশা ছেড়ে দিয়ে অন্যগুলো নিয়ে চিন্তা করছে।

হবেই–বা কী করে, যে প্রশাসনের প্রতি মানুষের এত ক্ষোভ, এই কমিশন তাদের দিয়েই গঠন করা। ফলাফল, তাদের লাভের দিক দেখা হবে, এটাই স্বাভাবিক। এদিকে জনপ্রশাসনের কর্মচারীরা আন্দোলনের হুমকি দিয়েও নিজেদের কাজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন।

কিছুদিন আগে দেশে বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল। সেখানে স্পষ্ট করে এই দেশের ব্যবসার প্রতিবন্ধকতার একটা ছিল আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এ ব্যাপারে আমাদের সরকারি লোকজনকে বললে কেউ বিশ্বাসই করবেন না। তাঁরা নিজেদের সংশোধনের চেষ্টাও করবেন না। তাঁদের সবার মিলিত চেষ্টার ফলই তো ছিল ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ র‍্যাঙ্কিংয়ে ১৬৮–তে থাকা। কিন্তু ২০০৬ সালে এই আমলাতন্ত্র দিয়েই কিন্তু আমাদের র‍্যাঙ্কিং ছিল ৬৫। তার মানে কিন্তু আমাদের দিয়ে সম্ভব ছিল।

আরও পড়ুনজনপ্রশাসন ঠিক হোক, তা ভেতরের লোকজনই চায় কি২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

এখন ফ্যাসিস্ট আমলের আমলাদের মানসিকতায় খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। তাঁরা রয়ে গেছেন তাঁদের জায়গাতেই। এর মধ্যে নতুন যুক্ত হয়েছে নতুন গ্রুপ ‘বঞ্চিত’ শ্রেণি। নজিরবিহীনভাবে অনেক আমলার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এত কিছু করেও কি গতি আসছে? জনপ্রশাসন সংস্কার প্রস্তাবনা সরকারি খাতে মানুষ কমিয়ে এফিসিয়েন্ট না করে বরং আরও নতুন নতুন সরকারি নিয়োগের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে বেতন ভাতা বাবদ ২০ শতাংশ খরচ কমানোর কথা বলা হয়েছিল, যা নিয়ে এখনো কোনো কথা হচ্ছে না।

ব্যবসায় একটা বিধিবিধানের কথা সবাই জানে—৮০: ২০ রুল। এর মানে, কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ২০ শতাংশ কাস্টমার থেকে ৮০ শতাংশ ব্যবসা আসে। আমরা মজা করে সরকারি খাতেও এই রুলের কথা বলি। এখানে ২০ শতাংশ পরিশ্রমী কর্মচারীর মাধ্যমেই ৮০ শতাংশ কাজ হয়। নিজেরাই খেয়াল করে দেখতে পারেন। বিশ্বাস না হলে করপোরেট অফিসের মতো ‘ডেইলি ওয়ার্ক রিপোর্ট’ চালু করলেই বোঝা যাবে কে কী কাজ করছেন। আর সরকারি চাকরিতে ঢুকলে কখনোই চাকরি যাবে না—যত দিন এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত থাকবে, তত দিন প্রশাসনকে কোনোভাবেই গতিশীল করা যাবে না।

প্রবাসী মেধাবী বাংলাদেশিদের অবশ্যই আমরা দেশে ফিরিয়ে আনব। আবার দেশে থাকা মেধাবী ও অভিজ্ঞ লোকদের কথাও আমরা ভুলব না। এই সরকারের অন্যতম সফল উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। আমার মতো নগণ্য মানুষকেও বারবার লিখতে হচ্ছিল কেন বেসরকারি খাত থেকে উপদেষ্টা পরিষদে একজনকে নেওয়া হচ্ছে না। অবশেষে আমাদের কথা সরকার শুনল এবং তার ম্যাজিক আমরা দেখতেই পাচ্ছি।

সেটা হবে দেশের নীতিনির্ধারণে একটা বড়সড় সংস্কার। দেশের জনগণের ভেতর থেকেই এ ব্যাপারে জনমত গড়ে ওঠা উচিত, যাতে ব্যাপারটা সরকার (সেটা যে সরকারই হোক) মেনে নিতে বাধ্য হয়। দলমতভেদে নানা রকম আদর্শ থাকতে পারে, কিন্তু দিন শেষে বাংলাদেশের সত্যিকারের ভালো চাইলে কিছু কিছু জায়গায় দলমত-নির্বিশেষে কিছু সিদ্ধান্তে সবারই উচিত একইভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করা।

এরপর আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের কথা। ফ্যাসিস্ট সরকারের ধসিয়ে দিয়ে যাওয়া আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংক খাতকে দাঁড় করাতে কী প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দারুণ কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তাঁরা সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন; কারণ, তাঁরা আমলাতন্ত্রকে কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, তা জানেন, যা দেশের বাইরে থেকে জানা বেশ কঠিন।

বিডা চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর যোগ্যতা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। তিনি নিজেও এই আমলাতন্ত্র নিয়ে কথা বলছেন। তাঁর সব চেষ্টা সত্ত্বেও গত ছয় মাসে দেশের বিনিয়োগ কমছে। বাস্তবতা হচ্ছে সরকারে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পর লুৎফে সিদ্দিকীর মতো আরেকজন ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও বড় কোনো সাফল্য আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কারণ, তাঁদের একার পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের প্রেজেন্টেশন দেশের আমলাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। বিনিয়োগ সম্মেলনে অন্য সরকারি কর্মচারীদের ইংরেজি শুনে অনেককেই উঠে যেতে দেখেছি। চিন্তা করেন তো, আশিক চৌধুরীর জায়গায় একজন সচিব যদি বসে থাকতেন, তাহলে কী হতো? তাঁদের ‘কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং’ তো আমরা গত ৫০ বছরেই দেখে আসছি।

বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই স্রেফ বয়স ও পদে সিনিয়র বিবেচনায় বিভিন্ন স্পেশালাইজড প্রতিষ্ঠানের পদে কাউকে নিয়ে বসানো হয়, তাতে ওই সেক্টরে কারও স্পেশালাইজড এক্সপার্টিস আছে কি না, এটা মোটেই বিবেচনার বিষয় নয়। কয়েক বছর আগে স্পারসোর সর্বোচ্চ পদে আসীন—এমন একজন সচিবকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হলো খুব, যখন দেখা গেল মানুষটা ছিল কৃষিতে স্নাতকোত্তর এবং পরবর্তী সময়েও তাঁর কাজের সঙ্গে সঙ্গে স্পারসোর দায়িত্ব নেওয়ার মতো কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

এভাবেই যেখানেই ওপরের পোস্ট হয়, অনভিজ্ঞ আমলা থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলাফল তো হাতের সামনেই। কিন্তু বিশেষায়িত খাত, যেমন বিনিয়োগ সেক্টর, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইসিটি, জনস্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থা, পর্যটন, পানি ব্যবস্থাপনা, সড়ক পরিকল্পনাসহ নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ খাতের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে থাকা তো উচিত নিজ নিজ খাতে অভিজ্ঞ মানুষদের। সেটা হতে পারে সরকারি খাত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ বা প্রবাসী অথবা দেশীয় বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞ।

আরও পড়ুনবেসরকারি খাতের সংস্কার কেন এখনই করতে হবে২৬ নভেম্বর ২০২৪

বহু তরুণ কিংবা অভিজ্ঞ মানুষ আছেন দেশ ও দেশের বাইরে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তাঁরা কখনোই ওই সব পদের বসার সুযোগই পান না, বিসিএস তাঁদের আরাধ্য নয়। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁদের উপযুক্ত জায়গায় ডাকলে দেশের জন্য অনেক কম সুবিধাতেই কাজ করবেন। কারণ, তাঁদের কাছে দেশ সবার আগে।

আমাদের তাই যিনি যোগ্য (বেসরকারি বা প্রবাসী), তাঁকেই পদ দেওয়ার দাবি করা উচিত। যদি সেটা সম্ভব হয়, তাহলে এই আমলাতন্ত্রের চিরায়ত সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। পরবর্তী সময়ে সরকার হিসেবে যারাই আসবে, তাদেরও এই কাজের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

সেটা হবে দেশের নীতিনির্ধারণে একটা বড়সড় সংস্কার। দেশের জনগণের ভেতর থেকেই এ ব্যাপারে জনমত গড়ে ওঠা উচিত, যাতে ব্যাপারটা সরকার (সেটা যে সরকারই হোক) মেনে নিতে বাধ্য হয়। দলমতভেদে নানা রকম আদর্শ থাকতে পারে, কিন্তু দিন শেষে বাংলাদেশের সত্যিকারের ভালো চাইলে কিছু কিছু জায়গায় দলমত-নির্বিশেষে কিছু সিদ্ধান্তে সবারই উচিত একইভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করা।

সুবাইল বিন আলম, টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।

ই–মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র ব সরক র আম দ র ক জ কর আমল ত ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা শুরু

সব জল্পনার অবসান হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সোমবার বিএনপি ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে দলের দুই শীর্ষ নেতার নির্বাচন করা এবং তাঁদের নির্বাচনী আসনগুলো নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচন করবেন।

তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, অনেক আগে থেকেই এমন আলোচনা আছে। তবে অসুস্থতার কারণে এবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। আবার তাঁর নিজেরও নির্বাচন করার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।

দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী শঙ্কা, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে রাজি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নেতা-কর্মীরা আনন্দিত।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নানা কারণে আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে নির্বাচনের গুরুত্বটা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে, সেটা মোকাবিলায়ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রভাব ফেলবে।

জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সোমবার ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাকি ৬৩টি আসনে প্রার্থিতা পরে ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থগিত রাখা কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।

ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যরা হলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), আবদুল মঈন খান (নরসিংদী-২), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), ইকবাল হাসান মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা-৩) এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন (দিনাজপুর-১)।

স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। প্রয়োজন বোধ করলে স্থায়ী কমিটি প্রার্থিতা পরিবর্তন করতে পারবে।

এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রার্থী ঘোষণার আগে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সভা হয়। সেখানে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকেরাও উপস্থিত ছিলেন।

এবারের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁকে ফেনী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।

আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে, সে আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব, সালাম জানাব।’

যে কারণে ঢাকার সাতটি আসন ফাঁকা

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনী সমঝোতার জন্য আসনগুলোতে প্রার্থিতা স্থগিত রাখা হয়েছে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাতটি আসনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের জন্য অন্তত তিনটি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নামও আছে।

তবে এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।

ঢাকা-৯ আসন স্থগিত রাখা হলেও সেটা কার জন্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খানকে (সোহেল) প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলে আলোচনা আছে।

ঢাকা-১৪: মায়ের ডাক-এর সানজিদা

ঢাকা-১৪ আসনে এবার প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এস এ খালেকের ছেলে এস এ সিদ্দিক (সাজু)। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ব্যক্তিদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামকে (তুলি) প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। এই আসনে ইতিমধ্যে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান)। তিনি আট বছর গুম ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।

সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে দলটি অভ্যন্তরীণ জরিপসহ সাংগঠনিক উপায়ে প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম প্রকাশ করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল বিএনপি।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিগত ১৫-২০ বছর ভোট দিতে পারেনি। এখন জাতি উৎসাহিত হচ্ছে ভোটের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি পূরণ করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করে একটা বড় পদক্ষেপ নিল। ইতিমধ্যে অনেকে মাঠে চলে গেছেন, এ ঘোষণার পর বাকিরাও মাঠে যাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে।

১০ নারী প্রার্থী

ঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন দশজন। এর মধ্যে অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকিরা হলেন সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর, ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, যশোর–২ আসনে সাবিরা সুলতানা, ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম ও নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন।

মনোনয়ন না পেয়ে দুই মহাসড়ক অবরোধ

মাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করে কামাল জামান মোল্লাকে। এর প্রতিবাদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা রাত আটটার দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর অনুসারীরা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ