তেলে নয়, সুদে পোয়াবারো পদ্মা, মেঘনা, যমুনার
Published: 3rd, May 2025 GMT
ব্যাংক আমানতের সুদ বৃদ্ধিতে পোয়াবারো অবস্থা জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানির। কোম্পানি তিনটির সুদ আয় বেড়ে যাওয়ায় মুনাফায়ও বড় উল্লম্ফন হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, কোম্পানি তিনটির মূল ব্যবসার চেয়ে এখন আমানতের সুদ আয় কয়েক গুণ বেশি। কোম্পানি তিনটি হলো পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল।
গ্রাহক পর্যায়ে জ্বালানি তেল বিক্রেতা এই তিন সরকারি কোম্পানিই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। সম্প্রতি কোম্পানিগুলো তাদের তৃতীয় ত্রৈমাসিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের (জুলাই-মে) আয়-ব্যয়ের তথ্য তুলে ধরা হয়। কোম্পানি তিনটির আর্থিক প্রতিবেদনগুলো আলাদাভাবে পর্যালোচনা করে তাদের মূল ব্যবসার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি সুদ আয়ের তথ্য পাওয়া গেছে।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি খাতের সরকারি এই তিন কোম্পানি মিলে গত ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সম্মিলিতভাবে ব্যাংকে আমানত রেখে সুদ আয় করেছে ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানি তিনটির সম্মিলিত পরিচালন মুনাফা ছিল ২৩৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে কোম্পানিগুলোর মূল্য ব্যবসা থেকে যে মুনাফা হয়েছে, তার চেয়ে সোয়া ছয় গুণ বেশি ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ আয় করেছে। আর এই সুদ আয় কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়িয়ে দিয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।
জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানির মধ্যে উল্লেখিত ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে যমুনা অয়েল। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে মার্চ—এই ৯ মাসে কোম্পানিটি ৪৬৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। অথচ এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মূল ব্যবসার আয়-ব্যয় সমন্বয়ের পর পরিচালন মুনাফা ছিল প্রায় ৩৪ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ৫৫৪ কোটি টাকার সুদ আয় যুক্ত হয়। পরে সেখান থেকে কর, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও সহযোগীদের মধ্যে লাভের অর্থ বণ্টনের পর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়ায় ৪৬৫ কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-মার্চ সময়কালে যমুনা অয়েল মূল ব্যবসা থেকে আয় করে ১১১ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংক থেকে সুদ বাবদ আয় ছিল ৫৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে কোম্পানিটি মূল ব্যবসার চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি আয় করে সুদ বাবদ। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির সুদ আয় বেড়েছে ১৪৭ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মূলত ব্যাংক আমানতের সুদহার বৃদ্ধির কারণেই প্রতিষ্ঠানটির মুনাফায় বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যাংকে আমানত রেখে যে সুদ আয় হয়, তার বিপরীতে খুব বেশি খরচ নেই। এ কারণে সুদ আয় সরাসরি কোম্পানির মুনাফায় যোগ হয়। তাই সুদ আয় বাড়লে কোম্পানির মুনাফাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ে, যদি অন্যান্য খাতে খরচ খুব বেশি না বাড়ে। সূত্রটি জানায়, তেল বিক্রি করে প্রতিদিন কোম্পানিটির কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে জমা হয়। আবার বড় অঙ্কের অর্থ ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রয়েছে।
যেহেতু জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানির হাতে প্রচুর নগদ অর্থ আছে, তাই ব্যাংকের বেশি সুদের সুফল পাচ্ছে তারা। যত দিন আমানতের সুদ বেশি থাকবে, তারা এই সুফল পাবে। তবে কখনো সুদ অনেক কমে গেলে তখন কোম্পানিগুলোর মুনাফাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমবে। তখন শেয়ারের দামে তার প্রভাব পড়বে। মোহাম্মদ মুসা, অধ্যাপক, বাণিজ্য অনুষদ, ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটিব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত বছরের জুন থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করা হয়। তার ফলে ঋণের সুদ বাড়তে শুরু করে। পাশাপাশি আমানতের সুদহারও বেড়ে যায়। এর আগে ব্যাংকের সুদহার একক অঙ্কের সীমায় আটকে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের জুন থেকে সেখান থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ধাপে ধাপে সুদ বাড়তে থাকে। বর্তমানে ব্যাংকভেদে আমানতের সুদহার উঠেছে দুই অঙ্কের ঘরে। আর ঋণের সুদহার উঠেছে ১৪-১৫ শতাংশে। সুদ বেড়ে যাওয়ায় তার বড় সুফল পেয়েছে জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানি।
যমুনা অয়েলের পর চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে মেঘনা পেট্রোলিয়াম। গত জুলাই থেকে মার্চ—এই সময়কালে কোম্পানিটি ৪১২ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। যার বড় অংশই এসেছে ব্যাংকের সুদ আয় থেকে। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, উল্লেখিত সময়ে মেঘনা পেট্রোলিয়াম মূল ব্যবসা থেকে আয় করেছে ২০৪ কোটি টাকা। এই সময়ে কোম্পানিটির সুদ বাবদ আয় ছিল ৪৬৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মূল ব্যবসার তুলনায় কোম্পানিটির সুদ খাত থেকে আয় ছিল প্রায় সোয়া দুই গুণ। এক বছরের ব্যবধানে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের সুদ আয় বেড়েছে ১১৪ কোটি টাকা। সেখানে একই সময়ের ব্যবধানে মূল ব্যবসার আয় বেড়েছে ৪২ কোটি টাকা। ১০০ কোটি টাকার বেশি সুদ আয় বৃদ্ধির ফলে কোম্পানিটির মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১৭ কোটি টাকা বেড়েছে।
একই চিত্র জ্বালানি খাতের সরকারি অপর কোম্পানি পদ্মা অয়েলেরও। কোম্পানিটি গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত মূল ব্যবসা থেকে আয় করেছে ২৫৫ কোটি টাকা। তার বিপরীতে একই সময়ে সুদ বাবদ আয় করেছে ৪২৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে কোম্পানিটির মূল ব্যবসার চেয়ে সুদ আয় ছিল প্রায় দ্বিগুণ। এতে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে ১৫১ কোটি টাকা বা ৬২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে পদ্মা অয়েলের মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯৫ কোটি টাকায়। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২৪৪ কোটি টাকা। এই সময়ের ব্যবধানে কোম্পানিটির সুদ বাবদ আয় বেড়েছে ১৫৫ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যমুনা অয়েলের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানির হাতে প্রতিদিনই নগদ অনেক অর্থ থাকে। তেল বিক্রি করে প্রতিদিন যে অর্থ পাওয়া যায়, দিন শেষে তা ব্যাংকে জমা রাখা হয়। প্রতিদিন কোম্পানিগুলোর হাজার হাজার কোটি টাকা এভাবে ব্যাংকে জমা হচ্ছে। তাই ব্যাংকের আমানতের সুদ যত বাড়তি থাকবে, তেল কোম্পানিগুলোর আয়ও তত বাড়বে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, শেয়ারবাজারে উৎপাদনশীল খাতের বেশির ভাগ কোম্পানির মুনাফায় টান পড়ছে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের কারণে। এ সময় যেসব কোম্পানির হাতে যত বেশি নগদ অর্থ রয়েছে এবং ঋণ যাদের কম, তারা বাড়তি সুদের বড় সুফল পাচ্ছে। জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানি তার বড় উদাহরণ। কোম্পানিগুলোর হাতে বিপুল নগদ অর্থ রয়েছে। ফলে তারা সেই অর্থের বিনিময়ে বেশি সুদ পাচ্ছে। সুদের বিদ্যমান হার বহাল থাকলে বছর শেষে এই খাত থেকে কোম্পানিগুলোর আয় আরও বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও বেসরকারি ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য অনুষদের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত কোম্পানির পরিচালন আয়কেই মূল আয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর বাইরে সুদসহ অন্যান্য খাতের আয় সব সময় এক থাকে না। এ কারণে মূল ব্যবসায়ের আয় বাড়লে সেটি কোম্পানির জন্য টেকসই হয়। যেহেতু জ্বালানি খাতের সরকারি তিন কোম্পানির হাতে প্রচুর নগদ অর্থ আছে, তাই ব্যাংকের বেশি সুদের সুফল পাচ্ছে তারা। যত দিন আমানতের সুদ বেশি থাকবে, তারা এই সুফল পাবে। তবে কখনো সুদ অনেক কমে গেলে তখন কোম্পানিগুলোর মুনাফা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাবে। তখন শেয়ারের দামেও তার প্রভাব পড়বে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ম ল ব যবস র খ ত র সরক র স দ আয় ব ড় র ব যবধ ন একই সময় গত জ ল ই র স দ আয় আয় ব ড় ছ স দ আয় ক এই সময় উল ল খ ত নট র স ফল প আয় ছ ল বছর র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি বাস্তবায়নে কমিটি
সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি (গভর্নেন্স পারফরমেন্স মনিটরিং সিস্টেম- জিপিএমএস)’ বাস্তবায়নে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করে তিন সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন করেছে সরকার।
সম্প্রতি এই কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
কমিটিতে বাকি দুই সদস্য হলেন, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সরকারি কাজের জবাবদিহিতা, দক্ষতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিতে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের মূল্যায়নের নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) পরিবর্তে নতুন সরকারি কর্মসম্পাদন পরিবীক্ষণ পদ্ধতি (জিপিএমএস) চালু করা হয়েছে। এই জিপিএমএস বাস্তবায়নে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব বা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, অর্থ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার), বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব কমিটিকে সহায়তা করবেন। তাছাড়া, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে।
এ কমিটি জিপিএমএস বাস্তবায়নের বিষয়ে সার্বিক দিক-নির্দেশনা দেবে। মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএসে সেকশন ১-এর আওতায় প্রস্তুত করা পরিকল্পনা অনুমোদন দেবে এবং অর্থবছর শুরুর আগে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চূড়ান্ত করবে এ কমিটি।
এছাড়া, প্রতি অর্থবছর শেষে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের জিপিএমএসের সার্বিক মূল্যায়ন পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেবে। জিপিএমএস বিষয়ে সরকারের দেওয়া অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করবে বলে প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা