ওষুধ উদ্ভাবনে জাতীয় স্বার্থেই বিনিয়োগ জরুরি
Published: 10th, May 2025 GMT
বাংলাদেশের ওষুধশিল্প সফল ও সম্ভাবনাময় খাতগুলোর একটি। এটি সাশ্রয়ী জেনেরিক ওষুধ তৈরি করে। এগুলো দেশে ও উন্নয়নশীল বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে সেবা দেয়। দেশের ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশই মেটায় এই ওষুধশিল্প খাত। ১৫০টিরও বেশি দেশে সাশ্রয়ী জেনেরিক ওষুধ রপ্তানি করে। জেনেরিক উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল উদ্ভাবক দেশে পরিণত হওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসছে: বাংলাদেশ কি আসলেই বিশ্ব ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণায় প্রকৃত উদ্ভাবক হতে পারবে?
নতুন ওষুধ তৈরি একটি জটিল প্রক্রিয়া। প্রথমেই প্রি-ক্লিনিক্যাল গবেষণা শুরু হয়। এই গবেষণা ল্যাবরেটরি ও প্রাণীদের ওপর করা হয়। এটি মানুষের ওপর পরীক্ষা করার আগে ওষুধের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা জানা জরুরি। প্রি-ক্লিনিক্যাল ফল ভালো হলে ওষুধ ক্লিনিক্যাল গবেষণায় যায়। এর অনেক ধাপ আছে। প্রথম ধাপের পরীক্ষায় অল্পসংখ্যক সুস্থ মানুষ অংশ নেয়। এখানে মূলত ওষুধের নিরাপত্তা ও সঠিক ডোজ দেখা হয়। এই ধাপ সফল হলে দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় আরও বেশি রোগী অংশ নেয়। এখানে ওষুধের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা আরও ভালোভাবে দেখা হয়। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় অনেক রোগী অংশ নেয়। এখানে ওষুধের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়। পাশাপাশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা হয় এবং অন্য ওষুধের সঙ্গে তুলনা করা হয়। সব ধাপ সফল হলে ওষুধ প্রস্তুতকারক নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। বাংলাদেশে এই সংস্থা হলো ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
বর্তমানে জেনেরিক ওষুধের ওপর জোর দেওয়ায় মানুষ কম দামে ওষুধ পাচ্ছে। তবে নতুন ওষুধ আবিষ্কারের দিকে মনোযোগ দিলে স্থানীয় স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান হবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আরও বেশি জায়গা করে নেওয়া যাবে। অর্থনীতিতে উন্নতি হবে। বিজ্ঞানী, গবেষক ও টেকনিশিয়ানদের জন্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে। নতুন ওষুধ তৈরি হলে পেটেন্ট করে দেশ ও বিদেশে বিক্রি করে অনেক আয় করা যাবে। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে বহুমাত্রিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ও মহামারির আশঙ্কা। এ ছাড়া বাড়ছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, যক্ষ্মা, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের মতো রোগের মাত্রা। স্থানীয়ভাবে ওষুধ আবিষ্কার করলে এসব রোগের জন্য বিশেষভাবে ওষুধ তৈরি করা যাবে। এতে মানুষের স্বাস্থ্য ভালো হবে এবং অন্য দেশের ওষুধের ওপর নির্ভরতা কমবে। ওষুধ উদ্ভাবনে বিনিয়োগ শুধু অর্থনৈতিক সুযোগ নয়, নৈতিক দায়িত্বও। কারণ দেশে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বোঝা ও ঝুঁকি অনেক বেশি। এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও বিশ্বনেতা বানাতে পারে। এর জন্য অনেক টাকা ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দরকার। উন্নত গবেষণাগার ও ডেটা ব্যবস্থাপনার জন্য ভালো অবকাঠামো তৈরি করতেও অনেক খরচ হবে। ওষুধ আবিষ্কারের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ বিজ্ঞানীর অভাবও একটি বড় সমস্যা। তা ছাড়া জেনেরিক ওষুধের চেয়ে নতুন ওষুধের অনুমোদন প্রক্রিয়া অনেক জটিল।
এত সমস্যা থাকার পরেও বাংলাদেশের কিছু বিশেষ সুযোগ আছে। এ দেশের মানুষের জিনগত বৈচিত্র্য অনেক। এর ফলে রোগের কারণ ও ওষুধের প্রতিক্রিয়ার জিনগত দিক খুঁজে বের করা সহজ হতে পারে– যা ওষুধ তৈরিতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী ওষুধের জ্ঞান অনেক পুরোনো। এখানে অনেক ঔষধি গাছ আছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ওষুধ কোম্পানি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতা নিতে পারে। এতে অর্থ, প্রযুক্তি ও জ্ঞান পাওয়া যাবে।
ওষুধ উদ্ভাবনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রথমেই দরকার সরকারের শক্তিশালী নীতি ও উদ্যোগ। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নতুন ওষুধ পরীক্ষা ও অনুমোদনের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ওষুধ গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি তহবিল ও অনুদান দিতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগকারীদের কর ছাড় দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার উন্নত করতে এবং বিশেষায়িত গবেষণা ইনস্টিটিউট তৈরি করতে হবে। ওষুধ আবিষ্কারের বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ কর্মী তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে। শিল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। উদ্ভাবনকে উৎসাহিত এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে মেধাস্বত্ব সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ডেটা ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হবে।
বেসরকারি খাতকে জেনেরিক ওষুধ তৈরির বাইরে নতুন ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণায় আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতকরণের সুযোগের জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের চেষ্টা করতে হবে। ওষুধ আবিষ্কারের জন্য দক্ষ কর্মী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিশেষে বলতে হয়, উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ শুধু তাদের স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই অর্জন করবে না, বরং নতুন ওষুধ তৈরির বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তহবিল ও অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা থাকলেও দেশের বিশেষ সুযোগ এবং নীতিনির্ধারক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে ওষুধ উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়ে যেতে পারে।
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র পর ক ষ র জন য সরক র র ওপর সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগের তদন্ত হোক
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি নাগরিকদের জঙ্গিবাদী তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার অভিযোগটি গুরুতর বলেই অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন মালয়েশিয়ায় উগ্রবাদী মতাদর্শ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। এরপর আইন ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল শুক্রবার রাতে জানিয়েছেন, তিনজন ইতিমধ্যে দেশে ফিরেছেন এবং তঁাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর ঘটনাকে বিব্রতকর বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
শুক্রবার কুয়ালালামপুরে সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার পুলিশপ্রধান খালিদ ইসমাইল জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৩৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করার কথা জানান। তাঁর বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে শ্রমিকদের মধ্যে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিগোষ্ঠীর মতাদর্শ প্রচার এবং তহবিল সংগ্রহ করে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের এমন একটি চক্র ভেঙে দিয়েছে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ। চক্রটি অন্যান্য বাংলাদেশি শ্রমিককে নিশানা করে সদস্য সংগ্রহ করত এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে উগ্র ও চরমপন্থী মতাদর্শ ছড়িয়ে দিত বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন।
মালয়েশীয় পুলিশপ্রধানের বক্তব্য সন্দেহমুক্ত নয়। সেখানে অবস্থিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের কেউ কেউ তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত থাকতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে আইএসের সাংগঠনিক ভিত্তি থাকার দাবি সঠিক নয়। তারপরও বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার অভিযোগকে উড়িয়ে না দিয়ে দেশে ফেরত আসা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নিয়েছে। এর সঙ্গে দেশের ভেতরে কেউ থাকলে সেটাও বেরিয়ে আসবে। এর সঙ্গে কেবল বাংলাদেশের ভাবমূর্তির বিষয় জড়িত নয়, লাখ লাখ শ্রমিকের জীবিকার প্রশ্নও আছে। গেল শতকের শেষ দশক ও চলতি শতকের প্রথম দশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও।
জঙ্গিবাদ বিশ্বব্যাপী প্রবণতা। এ থেকে খুব কম দেশই মুক্ত থাকতে পেরেছে। এখানে দুই ধরনের অতিশয়োক্তি আছে। এক পক্ষ মনে করে বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রায় জঙ্গিবাদী তৎপরতা ছিল। আরেক পক্ষের দাবি, জঙ্গিবাদ বলে বাংলাদেশে কিছু নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সহজ পথ ছিল যেকোনো তৎপরতা ও ব্যক্তিকে ‘জঙ্গি’ তকমা লাগিয়ে দেওয়া। জঙ্গি ইস্যু কাজে লাগিয়ে তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন–পীড়ন চালিয়েছে। আবার অন্যদিকে ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গি বলে কিছু নেই, ছিনতাইকারী আছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ে সংঘটিত হোলি আর্টিজানে হামলা প্রসঙ্গে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে তিনি এই উত্তর দেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেদিন সেই রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে হত্যার যে ঘটনা ঘটেছে, তা কি ছিনতাইকারীরা ঘটিয়েছিল?
মালয়েশিয়ায় ৩৬ বাংলাদেশির বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার যে অভিযোগ উঠেছে, তাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। মালয়েশিয়ার অভিযোগ কতটা সত্য, তা যথাযথ তদন্ত করে বের করতে হবে। দেশের কোনো পক্ষ এর সঙ্গে যুক্ত আছে কি না, তা খুঁজে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার। সেখানে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে এই ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে বাংলাদেশকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও উদ্যোগ নিতে হবে। আবার নিরীহ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়েও সরকারকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে হবে।
দুই উপদেষ্টার সঙ্গে আমরাও আশাবাদী হতে চাই যে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, দেশটির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তার নিরসন হবে।