যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্থানীয় সময় বুধবার হোয়াইট হাউসে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে বৈঠক করেন। হাসিমুখে শুরু হলেও অল্প সময়ের মধ্যে বৈঠকটি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। বৈঠকে ট্রাম্প দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও তাঁদের জমি দখলের মিথ্যা অভিযোগ করেন।

এটা গত ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ওপর ট্রাম্পের ‘আচমকা’ শব্দবাণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে জেলেনস্কির মতো বিতণ্ডায় না জড়িয়ে ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্যে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করেছেন রামাফোসা।

বিশ্বের যে সব দেশে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের একটি। কিন্তু হত্যাকাণ্ডে নিহত বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ।

গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি দেশটির জন্য জরুরি মার্কিন সহায়তা বাতিল করেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু আফ্রিকানারদের যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, দেশটির রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছেন এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে করা গণহত্যার মামলার সমালোচনা করেছেন।

ট্রাম্প আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন, এমন প্রস্তুতি নিয়েই হোয়াইট হাউসে আসেন রামাফোসা। সফরসঙ্গী হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত শ্বেতাঙ্গ গলফ খেলোয়াড়দের সঙ্গে এনেছেন। নিজেদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। দেশটির ওপর ট্রাম্প নতুন করে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।

কিন্তু ট্রাম্প যে একটি আক্রমণাত্মক নাটক সাজিয়ে রেখেছিলেন, তা আন্দাজ করতে পারেননি রামাফোসা। ওভাল অফিসে বৈঠক শুরু হওয়ার অল্প সময় পর ট্রাম্প দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গের বিরুদ্ধে নিপীড়নের খতিয়ান মেলে ধরেন। একপর্যায়ে একটি ভিডিও চালিয়ে দেন এবং ছাপানো খবরের কিছু কাটিং উল্টে-পাল্টে দেখাতে থাকেন। এসব নিজের অভিযোগের পক্ষের প্রমাণ বলে দাবি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

ভিডিওটি চালানোর আগে ট্রাম্পের অনুরোধ আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। এরপর একটি টেলিভিশনে ভিডিওটি চালানো। ওভাল অফিসের এই জায়গায় সাধারণত কোনো টেলিভিশন থাকে না। ভিডিওতে সাদা ‘রঙের ক্রস চিহ্ন’ দেখানো হয়। ট্রাম্পের দাবি, এসব শ্বেতাঙ্গ মানুষের সমাধি। ভিডিওতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরোধী দলীয় নেতাদের উত্তেজনাকর ভাষণের বক্তব্য শোনানো হয়।  ট্রাম্পের দাবি, ওই নেতাদের একজন জুলিয়াস মালেমা। তাঁকে গ্রেপ্তার করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প যে ভিডিওটি প্রদর্শন করেছেন, তা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ধারণ করা। এটি ধারণ করার এক সপ্তাহ আগে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি খামারে দু’জন নিহত হয়েছিল। এর প্রতিবাদে সেখানে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। ভিডিওটিতে সাদা রঙের যে ক্রস চিহ্নগুলো দেখানো হয়েছিল, তা প্রকৃত সমাধির ছিল না, সেগুলো ছিল প্রতীকী। কৃষকদের প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে এসব সাদা ক্রসগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল। বিক্ষোভের একজন সংগঠক দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমকে সে সময় জানিয়েছিলেন, আগের কয়েক বছরে নিহত কৃষকদের স্মরণে প্রতীকী ক্রসগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। 

ট্রাম্প বলেন, ‘[দক্ষিণ আফ্রিকায়] অনেক মানুষ মনে করছেন, তাঁদের ওপর নিপীড়ন চলছে। তাই তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চাইছেন। যখন আমরা দেখি বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষ নিপীড়ন বা গণহত্যার শিকার হচ্ছেন, তখন আমরা তাঁদের আশ্রয় দিই।’ এখানে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের প্রসঙ্গ টেনেছেন।

রামাফোসার কাছে অভিযোগ করে ট্রাম্প বলেন, ‘মানুষ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের জমি দখল করে নেওয়া হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের হত্যা করা হচ্ছে।’

দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের হত্যা করা হচ্ছে এবং তাঁদের জমি দখল করা হচ্ছে—   এই প্রচারণাটি নতুন নয়। বিশ্বজুড়ে অন্তত এক দশক ধরে চরম ডানপন্থী অনলাইন ফোরামগুলোতে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি চলছে। ট্রাম্পের একান্ত মিত্র ও দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণকারী ইলন মাস্ক এই তত্ত্বটি সমর্থন করেন। বুধবারের ট্রাম্প-রামাফোসার বৈঠকের সময় ইলন মাস্কও উপস্থিত ছিলেন।

দক্ষিণ আফ্রিকায় কয়েক শতাব্দীজুড়ে ঔপনিবেশিক শাসন ও বর্ণবাদ চালিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ শাসকেরা। এই সময় দেশটির কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের সঙ্গে চরম বৈষম্য করা হয়। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে ১৯৯৪ সালে দেশটিতে বর্ণবাদের অবসান হয় এবং  একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা হয়।

দক্ষিণ আফ্রিকায় সম্প্রতি একটি ভূমি সংস্কার আইন পাস হয়েছে। এতে বর্ণবাদ যুগের অন্যায় সংশোধন করা, জনস্বার্থে প্রয়োজনে বিনা ক্ষতিপূরণে সরকারের জমি বা সম্পত্তি অধিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, কোনো জমি যদি অনাবাদি পড়ে থাকে জনস্বার্থে সরকার তা অধিগ্রহণ করতে পারবে।  তবে এই আইনের অধীনে এখনো পর্যন্ত কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হলে আদালতে তা চ্যালেঞ্জ করার করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশটিতে ২৬ হাজার ২৩২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪৪টি কৃষি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসব ঘটনায় নিহতদের মধ্যে মাত্র আটজন ছিলেন কৃষক।

ওভাল অফিসে বৈঠকের সময় ট্রাম্পের একের পর এক অভিযোগ উত্থাপনের সময় পাশের চেয়ারে রামাফোসা শান্ত ও স্থিরভাবে বসে সংযতভাবে প্রতিবাদ জানান।

রামাফোসা বলেন, ‘যদি সত্যিই আফ্রিকানার কৃষকদের ওপর গণহত্যা চলত, তাহলে আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এই তিনজন ভদ্রলোক এখানে উপস্থিত হতেন না।’ তিনি কক্ষে উপস্থিত দক্ষিণ আফ্রিকার গলফ খেলোয়াড় আর্নি এলস, রেটিফ গুসেন এবং বিলিয়নিয়ার জোহান রুপার্টের দিকে ইঙ্গিত করে এই কথা বলেন।

কিন্তু রামাফোসা জবাবে ট্রাম্প সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

ট্রাম্প বলেন, ‘এই বিষয়ে আমাদের হাজার হাজার প্রতিবেদন আছে, প্রামাণ্যচিত্র আছে, খবরের প্রতিবেদন আছে। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতেই হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ষকদ র গণহত য হয় ছ ল দ শট র কর ছ ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

নুসরাতকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করছে: এনসিপি

অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোর ঘটনা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করছে বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলেছে এনসিপি। দলের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তিটি পাঠিয়েছেন এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আমরা দেখেছি, জুলাই অভ্যুত্থানে হামলা ও গুলি করার ঘটনায় অভিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ চলতি মাসেই কোনো রকম বাধাবিপত্তি ছাড়াই দেশত্যাগ করেছেন। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রিত ৬২৬ জন ব্যক্তির পরিচয় এখনও প্রকাশিত হয়নি। উপরন্তু, জুলাই গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত পতিত ফ্যাসিবাদি ও এর সমর্থকরা এখনও জনপরিসরে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এদেশের নাগরিকবিরোধী অপতৎপরতা জারি রেখেছে।

জুলাই গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াকে লঘু করে দেখানোর প্রবণতা সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে বলা হয়, জুলাই গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় না এনে এ ধরনের লোকদেখানো ও ঢালাওভাবে আসামি করা মামলায় গ্রেপ্তার ও জামিন না দিয়ে কারাগারে প্রেরণের ঘটনা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াকে লঘু করে দেখানোর প্রবণতা সৃষ্টি করছে।

এতে বলা হয়, আমরা মনে করি, বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রশাসনের মধ্যে থাকা একটি পক্ষ এই ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ‘জুলাই গণহত্যা’ এবং এর বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। অথচ এখন পর্যন্ত এই গণহত্যার বিচারে আমরা দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি না। 

বিচার কার্যক্রমকে গতিশীল করতে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল– ২ গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেও এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়নকল্পে আমরা কোনো প্রজ্ঞাপন দেখতে পাইনি বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। 

এতে বলা হয়, আগামী জুলাই মাসের মধ্যেই জুলাই গণহত্যার বিচারপ্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি – এনসিপি। সেই লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আশু ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানাই আমরা। এছাড়াও, হরেদরে মামলা এবং মামলা বাণিজ্যের বিষয়টিকে আমলে নিয়ে মামলা গ্রহণের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আহ্বান জানায় এনসিপি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ ট্রাম্পের, পরিস্থিতি সামলে নিলেন রামাফোসা
  • ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে স্পেনের পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস
  • গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৩০ মিনিটের মধ্যে ৩৮ জন নিহত
  • গাজায় ইসরায়েলি হামলা: মধ্যরাত থেকে নিহত আরও ৩৮ ফিলিস্তিনি
  • অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন, ক্ষোভ
  • নুসরাতকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করছে: এনসিপি
  • নুসরাতকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানো বিচার প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করছে: এনসিপি
  • নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানো বিচার প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করছে: এনসিপি