জনপরিসরের আলোচনায় ‘মধ্যমণি’ এখন বাংলাদেশ ও রাখাইনের মধ্যকার কথিত মানবিক করিডোর। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। এর প্রাথমিক কারণ যেমন দেশটির জান্তা সরকার, তেমনি তাদের কঠোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক নীতি-আদর্শ। রাখাইনের ৯০ শতাংশই এখন আরাকান আর্মির দখলে। বাকি ১০ শতাংশ জান্তার দখলে। রাখাইনের কেন্দ্রভূমি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সরকার সেখানে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ঢুকতে দিচ্ছে না। এদিকে আরাকান আর্মি যেহেতু দখলদার যোদ্ধা; বৈধ রাজ্য সরকারও নয়, তাই সেখানকার জনগণের প্রকৃত প্রয়োজনের বিষয়টি পূরণ করতে পারছে না। একই কারণে তারা আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে খাদ্যশস্যসহ মানবিক সাহায্যও চাইতে পারছে না। এমনকি রাখাইনের সীমান্ত-প্রতিবেশী বাংলাদেশের কাছেও তারা সে রকম সহায়তার প্রস্তাব করতে পারছে না। কিন্তু সম্প্রতি জাতিসংঘ তাদের হয়ে বাংলাদেশকে ‘মানবিক’ করিডোর দেওয়ার প্রস্তাব করে। জাতিসংঘ সেটা তার একটি সদস্য রাষ্ট্রকে করতেই পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জাতিসংঘ এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। কেন পারছে না, সেটা ইউএন জানে। আমরা কেবল সংকটের ভাসমান বরফখণ্ডের উপরিভাগ দেখছি। নিচে ডুবে থাকা জটিল ও নারকীয় রূপটি আমাদের অজানা।

আরাকান আর্মি যে রাজনৈতিকভাবে চরমপন্থি বুদ্ধিস্ট এবং মেইনল্যান্ডের বুদ্ধিস্টরাও এদের পছন্দ ও সহ্য করে না– সে খবর কি আমরা রাখি? এই আরাকান আর্মি রাখাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদেরও উৎখাতের পক্ষে। এখনও প্রায় প্রতিদিন নাফ নদ পার হয়ে রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে ঢুকছে। এই অব্যাহত মানব পরিযান আমরা বন্ধ করতে পারি, কিন্তু মানবিক কারণে তা করা হচ্ছে না। এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে জাতিসংঘের মানবিক করিডোর চাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। 

করিডোর প্রদানের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তাই প্রশ্ন উঠেছে, জাতিসংঘ কি স্ব-উদ্যোগেই এটা করছে, নাকি অন্য কোনো পক্ষের গোপন অভিলাষ পূরণে তারা এই করিডোর চেয়েছে বাংলাদেশের কাছে?
প্রজ্ঞাবানদের বক্তব্য, জাতিসংঘের এই হিউম্যান করিডোর চাওয়ার পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। বৈশ্বিক রাজনীতিতে মিয়ানমার চীনা শিবিরের দেশ। রাখাইনেই চীনের বিনিয়োগ অনেক। সেই বিনিয়োগ রক্ষার পাশাপাশি প্রতিবেশী মিয়ানমারকে রক্ষা ও দুর্বল করার দ্বিমুখী রাজনীতি চালু রেখেছে তারা। জান্তা সরকারকে সহযোগিতা করে চীন। উল্টোদিকে ওই দেশের বিদ্রোহী যোদ্ধাদেরও সাহায্য করে। আরাকান আর্মি সেই বিদ্রাহীদের একটি। বহুমুখী এক জটিল ভূরাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে নিপতিত মিয়ানমার এবং চীন, ভারত আর সুদূরের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সামরিক ভীতির মধ্যে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ। আমরাও সেই সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছি।

এই মানবিক করিডোর নিয়ে দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সরকারি উদ্যোগ-আয়োজন নেই। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রজ্ঞাবান অধ্যাপকদের সঙ্গেও এ নিয়ে আলোচনা নেই। বিষয়টি বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজকে হতবাক করেছে। তাদের মত হচ্ছে, ওই করিডোর দিয়ে যে কেবল মানবিক সামগ্রী যাবে– সেই নিশ্চয়তা কি জাতিসংঘ দিতে পারবে? আবার ওই করিডোর দিয়ে যে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী ও মাদক ও অস্ত্র, স্বর্ণ পাচারকারীরা আমাদের দেশে ঢুকবে না– তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। মনের মধ্যে এই প্রশ্নটি জাগছে, আমাদের বিজিবি সদস্যরা যেখানে সীমান্তে পাচার বন্ধ করতে পারছে না, সেখানে করিডোর খুলে দিলে তা যে অবারিত হবে– তাতে কোনো ভুল নেই। 

আমরা তো জানি, মিয়ানমার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাদক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ। মাদক হচ্ছে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী পণ্য, যার অভিঘাতে যে কোনো দেশের সমাজ কাঠামোকে ধসিয়ে দেওয়া যায়। আবার এ দেশের অবস্থান আমাদের মতোই ভূরাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত বঙ্গোপসাগরের তিনটি দেশই খুবই কৌশলগত অবস্থানে আছে। অগ্রসরমাণ চীনকে শায়েস্তা করতে হলে তার চারপাশের দেশগুলোকে ব্যবহার করার যে নকশা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, তারই সামান্য বাস্তবায়ন আমরা দেখতে যাচ্ছি মানবিক করিডোরের মধ্য দিয়ে।

এ করিডোর দিতে গিয়ে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী এবং প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে যে ক্ষত সৃষ্টি হবে, তা আমাদের জন্য শুভ হবে না। প্রতিবেশী ভারত তো আমাদের চেপে ধরতে মুখিয়ে আছে; দেশটির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সরকারি পদক্ষেপ আমাদের চাপে ফেলেছে। ভারত স্থলপথের যে কয়টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করত বাংলাদেশ থেকে, ১৭ মে তা বন্ধ করে দিয়েছে। আরও কিছু বৈরী পদক্ষেপ তো এর আগেই নিয়েছে। এর পেছনে আছে চীনের সঙ্গে আমাদের ভূরাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিক ও উন্নয়নবিষয়ক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগের আকাঙ্ক্ষা।

তবে সরকারপক্ষ ইদানীং বলছে, তাদের কাছে কোনো পক্ষই মানবিক করিডোর চায়নি। তাহলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কেন বলেছিলেন, সরকার ওই করিডোর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে?  
ডাল মে কুচ কালা হ্যায়– এই প্রবাদবাক্যের সূত্র ধরে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে কিছু স্পর্শকাতর বক্তব্য চাউর হয়েছে। সেসব গুজব যদি সত্য নাও হয়, তাহলে সেনাপ্রধান কেন তাঁর বাহিনীর সিনিয়র ও মধ্যম সারির সামরিক অফিসারদের কাছ থেকে করিডোর বিষয়ে মতামত নিলেন? কেন বারবারই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে– রাখাইনে কোনো রকম মানবিক করিডোর দেওয়া যাবে না?
বস্তুত বাংলাদেশের ‘মিয়ানমার নীতি’ কী– খোলাখুলি আলোচনা হওয়া দরকার। দীর্ঘদিন আমরা ‘লুক ইস্ট’ পররাষ্ট্রনীতির কথা বলেছি বটে, আমাদের দ্বিতীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের একেক সরকার এসে একেক রকম নীতি নিয়েছে বা নীতি ছাড়াই অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ চালিয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক, বাণিজ্যিক দিক থেকে মিয়ানমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। তিন দিকে ভারতবেষ্টিত বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারই হতে পারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে প্রবেশদ্বার।

সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে– জানি না। ভাসমান শৈলখণ্ডের নিচের অংশের কথা ভেবে জনগণ তাই খুবই আতঙ্কে আছে। ক্ষমতার স্বৈরাচারী অংশ না রাখারই সিদ্ধান্ত হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের মাধ্যমে। বর্তমান সরকার তো সেই ম্যান্ডেটেরই রাজনৈতিক অংশ। এই সরকার জনগণকে অন্ধকারে রেখে শুধু করিডোরের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নয়; মিয়ানমারের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর ব্যাপারে নয়; কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেবে না– এই আমাদের প্রত্যাশা।

ড.

মাহবুব হাসান: কবি ও সাংবাদিক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আর ক ন আর ম ভ র জন ত ক কর ড র দ র খ ইন র কর ড র চ আম দ র সরক র ব ষয়ট

এছাড়াও পড়ুন:

সারাদেশে যৌথবাহিনীর হাতে আটক ৩৯০ জন

সেনাবাহিনী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশকিছু যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়। চলতি মাসের ২২ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত অভিযানে ৩৯০ জনকে আটক করা হয়েছে। 

আজ শুক্রবার সকালে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। 

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আটক ৩৯০ জনের মধ্যে হত্যা মামলার আসামি, অবৈধ অস্ত্রধারী, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, চোরাকারবারী, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য, অপহরণকারী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদকাসক্ত রয়েছেন। এসব অপরাধীকে হাতেনাতে আটক করা হয়। 

আইএসপিআর জানিয়েছে, আটকৃতদের কাছ থেকে ২১টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, ৯৯টি বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ, ১৬টি ককটেল বোমা, বিভিন্ন মাদকদ্রব্য, সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকার দেশীয় অস্ত্র, মোটরসাইকেল, চোরাই মোবাইলফোন, ওয়াকি-টকি, পাসপোর্ট, জালনোট ও নগদ অর্থ উদ্ধার করা হয়। আটককৃতদের প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ এবং আইনি কার্যক্রম সম্পন্নের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, দেশব্যাপী জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত টহল ও নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শিল্পাঞ্চলসমূহে সম্ভাব্য অস্থিরতারোধে মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় ও সমঝোতার মাধ্যমে বেতন-বোনাস পরিশোধ নিশ্চিতে সেনা টহলদল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। 

এছাড়াও আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বসা অস্থায়ী পশুরহাটে সার্বক্ষণিক নজরদারী, নিরাপত্তা ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করছে। পাশাপাশি ঈদযাত্রাকে সহজ করতে নির্বিঘ্নে সড়কে যান চলাচল নিশ্চিতকরণ ও টিকিট কালোবাজারি রোধকল্পে সেনাবাহিনী বিশেষ টহল কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

আইএসপিআর আরও জানিয়েছে, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক এ ধরনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সাধারণ জনগণকে যেকোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপের বিষয়ে নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে তথ্য প্রদান করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ