মানবজীবনের মৌলিক শিক্ষা হলো– থামতে জানা। দৌড় প্রতিযোগিতার যেমন সুনির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে, তেমনি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ধাপে থামার, ভাবার এবং আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন আছে। কারও প্রেমে অন্ধ হয়ে, বঞ্চনাবোধ থেকে আত্মহত্যার পথ না বেছে কিংবা অন্যের চরিত্র হননের চেষ্টা না করে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই থামতে জানার প্রকৃত কৌশল। এমনকি শত্রু মোকাবিলায় ‘ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ প্রতিপক্ষকেও জানতে হয় কোথায় থামতে হবে। অন্যথায় সে নিজেই ষড়যন্ত্রের বুমেরাংয়ের শিকার হয়। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা যেমন নারীবিদ্বেষী বক্তব্যে কোথায় থামতে হবে– ভুলে যায়; তেমনি নারীবাদীরাও অনেক সময় ভুলে যায়– প্রাসঙ্গিকতা ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় কোথায় থামতে হবে। সীমাবদ্ধতা স্বীকারের শিক্ষা অর্থাৎ থামতে পারা এক ধরনের সৃষ্টিশীলতা।

সবদিক বিবেচনায়, রাজনীতিবিদদের থামতে না জানার পরিণামই সবচেয়ে বিস্তৃত ও ভয়াবহ, যার খেসারত আমরা দিয়ে যাচ্ছি। ক্ষমতার জন্য লালসা এবং বিশেষত নিজেদের মধ্যে যে কোনো জাতীয় অর্জনের ক্রেডিট ভাগাভাগির লড়াই আমাদের স্থায়ী জাতিগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা আমাদের অজান্তেই অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়াই রাজনৈতিক দায়, দরদ ও সুস্থতার প্রতীক। থামতে না জানার কারণে একের পর এক গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ ঘটে যাচ্ছে, যা জাতিকে নিয়ে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতার মূল আকাঙ্ক্ষা গণতান্ত্রিক ও অংশগ্রহণমূলক শাসন ব্যবস্থা পরিপন্থি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর সংযোজন আওয়ামী লীগ সরকারের থামতে না জানার প্রথম রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত স্থাপন। পরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের যে নতুন সূচনা হয়েছিল ১৯৯১ সালে, সেটিও ২০০১ সালের পর থামতে না জানার পথে গড়াতে থাকে। তৎকালীন বিএনপি সরকার বিচারপতিদের বয়সসীমা বৃদ্ধি, নির্বাচন কমিশনের ওপর হস্তক্ষেপ, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা দুর্বল করার চেষ্টা করেছিল। এগুলো আমাদের থামতে না জানার ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ আসে ‘ওয়ান ইলেভেন’-এর শাসন। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন ঘটলেও কাল হয় তাঁর থামতে না জানা। 

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বজনীন জনযুদ্ধ। যুদ্ধোত্তর প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ বিশেষত এই সময়ে নিজেকে একক কৃতিত্বের রাজনীতি করে। যার মেকানিক্যাল অ্যাপ্রোচ ছিল– মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির বাইনারি তৈরির মাধ্যমে বিভাজিত সমাজের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়। হয়েছিলও অনেকটা তাই। দেশবাসী দুটি কৃত্রিম জাতিতে বিভক্ত হয়ে হুতু-তুতসির মতো জাতিগত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তিনির্ভর স্বৈরতন্ত্র ও ‘অবিকল্প নেতৃত্ব’ ধারার উত্থান, যা মূলত শেখ হাসিনাকে থামতে না জানা শিখিয়েছিল। এই থামতে না জানা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় যখন ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনকে ‘রাজাকারের আন্দোলন’ বলে ট্যাগ দেওয়া হয়। ফলে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে তাঁর দেশত্যাগ থামতে না জানারই পরিণতি হিসেবে দেখা যায়। 

গণঅভ্যুত্থানের ফসল ঘিরে একক কৃতিত্ব দাবি করতে উদ্যত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেতরে ‘লুকিয়ে থাকা’ ইসলামী ছাত্রশিবির। বিপত্তির সূচনা তখনই ঘটে, যার চূড়ান্ত প্রকাশ শাহবাগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে উচ্চারিত এক স্লোগানে– ‘গোলাম আযমের বাংলায়, আওয়ামী লীগের স্থান নাই’। জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কোথায় থামতে হবে, সেই বোধের অভাব বর্তমান রাজনীতিকে অধিকতর জটিল করে তুলছে বলে মেটান্যারেটিভ হাজির হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠছে, থামতে না জানার ইতিহাসে কি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও যুক্ত হচ্ছে? ধীরে ধীরে এই প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয়। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ‘অস্পষ্ট’ সংস্কার নির্ভরশীলতা কিংবা ‘অজুহাত’ এবং নির্বাচনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপের অনুপস্থিতি খুব বেশি দৃশ্যমান না হওয়ায় এই প্রসঙ্গ ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। তাঁকেও কোথাও না কোথাও থামার বা স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। যদি থামতে না জানেন; রাজনৈতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী তিনিও ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, আবারও যার ভুক্তভোগী হবে দেশবাসী। 

বিএনপির ক্ষেত্রে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কিছু নেতাকর্মীর বেফাঁস বক্তব্য। বিএনপির উচিত হবে আরও সংযত ভাষা ও গণতান্ত্রিক কর্মকৌশল গ্রহণ এবং জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক চর্চা করা। বিএনপিকে আওয়ামী লীগের সমান্তরালে দেখানো, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ভেতর থেকেও যখন বিএনপিকে আওয়ামী লীগের মতোই ‘দল’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, তখন রাজনৈতিক বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পায়। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য পথ। অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে যদি ঐক্যহীনতা বা একে অপরকে দোষারোপের সংস্কৃতি জেঁকে বসে, তবে সেই ফাঁক দিয়ে বিদেশি শক্তি কিংবা সামরিক শক্তির উত্থান ঘটার আশঙ্কা থাকে।

সমাধান হিসেবে এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের রেফারির ভূমিকা অপরিহার্য। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য যত সময় প্রয়োজন, তা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে থামতে, পর্যালোচনা করতে, জনদুর্ভোগ বুঝতে এবং সহনশীল গণতন্ত্রে ফিরে আসার তাগিদ থাকতে হবে।

ড.

সাজ্জাদ সিদ্দিকী: বিভাগীয় প্রধান, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত র জন ত ক র থ মত আম দ র সরক র ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

এমন তো হবার কথা ছিল না: তারেক রহমান

জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে জনমনে সৃষ্ট সংশয়, সন্দেহ গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে সংকটপূর্ণ করে তুলতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

শেষ পর্যন্ত কোনো অগণতান্ত্রিক কিংবা অপশক্তির কাছে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের পথে হাটতে হয় কি-না, এমন শঙ্কাও জানিয়েছেন তারেক রহমান। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মাঠে থাকা সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে এমন বিপদের কথাও স্মরণ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

প্রবাসে বিএনপির সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচির অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তারেক রহমান। লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হন তিনি। আজ রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিএনপি।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মানুষের উদ্বেগের কথা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, ‘পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের শাসন আমলে জনগণের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনোই আগ্রহ ছিল না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় জনমনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসা বাড়ছে, যথাসময়ে কি নির্বাচন হবে?... এমন তো হবার কথা ছিল না।’

বিএনপির বিজয় ঠেকাতে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার ও অপকৌশল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে বলে উল্লেখ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘উদ্বেগ এবং আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশেও বর্তমানে বিএনপির বিজয় ঠেকাতে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার এবং অপকৌশল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।’

দেশে প্রতিনিয়ত একের পর এক নিত্য নতুন শর্ত জুড়ে দিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সংকটাপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তারেক রহমান। তবে তাঁর বিশ্বাস, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শক্তিতে বিশ্বাসী নাগরিকেরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রই বিএনপিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।

শুধু বিএনপির বিজয় ঠেকাতে গিয়ে পতিত পরাজত পলাতক স্বৈরাচার দেশে ‘ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, তবে বিএনপির প্রতি দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের আস্থা, ভালোবাসা থাকায় সে সংকট কাটিয়েছে তাঁর দল।

তারেক রহমান বলেন, ‘দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি শুরু থেকেই ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে একদিকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার পথ বেছে নিয়েছে। অপরদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও যতটুকু সম্ভব, যতটুকু যথাসাধ্য সম্ভব আমাদের অবস্থান থেকে আমরা সহযোগিতা করে আসছি।’

প্রবাসে বিএনপির সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচির অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজ রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি পৈতৃক সম্পত্তি
  • ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাই প্রায় চূড়ান্ত: তারেক রহমান
  • গণতন্ত্রের পথে সংকট দেখছেন তারেক
  • এমন তো হবার কথা ছিল না: তারেক রহমান
  • সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই এখন জাতির দাবি