আমেরিকা যে কারণে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে
Published: 30th, May 2025 GMT
চলতি বছরের ২ এপ্রিল থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নতুন বিশ্ব বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন। এখন সেটি এক নতুন পর্যায়ে ঢুকেছে। বাণিজ্যযুদ্ধ এখন ‘চুক্তি’র রাজনীতিতে রূপ নিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্প্রতি একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাতে কিছু ‘প্রাথমিক প্রস্তাব’ দেওয়া আছে। এগুলো ভবিষ্যতে হয়তো একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে রূপ নিতে পারে। হোয়াইট হাউস একটি অনলাইন পোস্টে এই পদক্ষেপকে ‘আর্ট অব দ্য ডিল’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা দাবি করেছে, চীনের ওপর আমেরিকার একতরফাভাবে আরোপিত শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে এবং চীনও তার পাল্টা ব্যবস্থা বন্ধ করেছে।
আরও বলা হচ্ছে এখন ‘ডজনখানেক’ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই ‘চুক্তি’র মানে দাঁড়ায়, আমেরিকা এখনো আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের বেঁধে রাখার মতো বিশ্বাসযোগ্য ক্ষমতা রাখে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলে কি যুক্তরাষ্ট্র আর নিজের কথা রাখতে পারে?
একটি গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসনভিত্তিক রাষ্ট্র সাধারণত দুভাবে আন্তর্জাতিক সমঝোতায় আবদ্ধ হয়। একটি হলো আইন প্রণয়নের মাধ্যমে, অপরটি হলো দুই দেশ সম্মত হয়ে সই করা চুক্তির (ট্রিটির) মাধ্যমে। কিন্তু যদি কোনো দেশ খেয়ালখুশিমতো পূর্বঘোষণা ছাড়াই চুক্তি থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে সেই দেশের ওপর কেউ আর আস্থা রাখতে পারে না। ট্রাম্প ইতিমধ্যে এই কাজ করেছেন এবং তাঁর প্রশাসনের আচরণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তিনি নিজে আইন বা আন্তর্জাতিক চুক্তির বাধ্যবাধকতা মানেন না। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যকর ক্ষমতাও এখন মার্কিন আইনি কাঠামোর হাতে নেই।
মার্কিন কংগ্রেস অষ্টাদশ শতক থেকেই বাণিজ্যসংক্রান্ত কিছু ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রেসিডেন্টদের হাতে তুলে দিয়েছে। জর্জ ওয়াশিংটন, জন অ্যাডামস, টমাস জেফারসনের সময়ও এই ক্ষমতা খুব নির্দিষ্টভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এতে পরিষ্কার সীমাবদ্ধতা দেওয়া থাকত, যাতে বিদেশি অংশীদারেরাও বুঝতে পারে, হোয়াইট হাউস কী করতে পারে আর কী করতে পারে না।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এসব আইনি সীমা পাশ কাটিয়ে কার্যত নিজ ইচ্ছায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। সাধারণত ১৯৬২ সালের ট্রেড এক্সপানশন অ্যাক্টের মতো আইন অনুসরণ করে শুল্ক আরোপ করা হয়। এতে দীর্ঘ তদন্ত, বিশ্লেষণ ও রিপোর্ট দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকে। কিন্তু ট্রাম্প এসব উপেক্ষা করে ১৯৭৭ সালের ‘ইন্টারন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ইকোনমিক পাওয়ার অ্যাক্ট’ ব্যবহার করে হঠাৎ করেই ‘পারস্পরিক’ শুল্ক বসিয়ে দিয়েছেন।
আমি ও অন্য অনেক আইনি বিশ্লেষক আগেই দেখিয়েছি, এই আইন ট্রাম্প যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা সম্পূর্ণ বেআইনি। সেই বিবেচনায় শুরু থেকেই যুক্তরাজ্য ও চীনের ওপর শুল্ক আরোপ আইনবহির্ভূত। এখন কীভাবে হোয়াইট হাউস দাবি করবে যে তারা ভবিষ্যতে আইনের প্রতি বাধ্য থাকবে?
আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ‘ট্রিটি’, অর্থাৎ দুই বা তার অধিক দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত আনুষ্ঠানিক চুক্তি। কিন্তু ট্রাম্প সেসবকেও অগ্রাহ্য করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৮ সালে তিনি নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (নাফটা) আবার আলোচনার দাবি তোলেন। পরে ২০২০ সালে কংগ্রেস ‘ইউএস-মেক্সিকো-কানাডা অ্যাগ্রিমেন্ট’ অনুমোদন করে।
কিন্তু ২০২৫ সালে ট্রাম্প নিজেই আবার এই চুক্তির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিন দেশেই ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক বসিয়ে দেন। এমনকি তিনি বলেছেন, ১৯০৮ সালের কানাডা-আমেরিকা সীমান্তচুক্তির লাইনটা ‘অবাস্তব’ ও ‘অর্থহীন’। এর মানে মার্কিন আইনি কাঠামো বা আন্তর্জাতিক চুক্তি—এখনকার মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে দুটোরই কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।
মার্কিন সংবিধানবিষয়ক ব্যাখ্যা অনুসারে, কোনো পূর্বঘোষণা বা কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তাই করেছিলেন। তিনি একতরফাভাবে তাইওয়ানের সঙ্গে ১৯৫৪ সালের প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করে দেন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সিনেটর ব্যারি গোল্ডওয়াটার মামলা করেছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলা আমলেই নেননি।
এই দুর্বলতা আরও বড় হতো যদি কোনো অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পকে সময়মতো আটকাতে পারত। কিন্তু কংগ্রেস কার্যত স্তব্ধ। রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারাও এই ভয়ে মুখ খুলছেন না যে কেউ প্রাইমারিতে তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করে বসতে পারেন। তাঁরা ট্রাম্পের নিযুক্ত অযোগ্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও কোনো প্রতিবাদ করেননি।
অনেকে আশা করেন, আদালত ট্রাম্পকে বাধা দিতে পারেন। সম্প্রতি নিউইয়র্কের ‘ইউএস কোর্ট অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড’-এ ট্রাম্পের শুল্ক সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রথম মামলা হয়েছে। কিন্তু আমি খুব আশাবাদী নই। কারণ, মামলার রায় আসতে অনেক দেরি হয়। তত দিনে ট্রাম্প যা করার তা করে ফেলেন। তাঁর প্রশাসন আগেও আদালতের রায় অগ্রাহ্য করেছে। পররাষ্ট্রনীতি–সংক্রান্ত ইস্যু হলে তো তা আরও সহজ হয়।
আজকের দিনে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কোনো দেশ যদি কোনো ‘চুক্তি’ করে, তাহলে সেটিকে কেবল সাময়িক সুবিধা হিসেবেই দেখা উচিত। এটিকে স্থায়ী কোনো সমঝোতা বলে ভাবলে ভুল হবে। কারণ, ট্রাম্প একবার চুক্তি করলেও পরে নিজের মতো করে সেটি বদলে ফেলেন, এমনকি কখনো কখনো তা পুরোপুরি বাতিলও করে দেন। বড় বড় আইনপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার পরও ট্রাম্প কথা রাখেননি। তিনি নিয়ম বদলেছেন, শর্ত পাল্টেছেন আর কখনো হঠাৎ করেই পিছিয়ে গেছেন।
এমন অবস্থায় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের মতো নেতারা যদি রাজনৈতিক চাপে পড়ে তাড়াহুড়া করে ট্রাম্পের সঙ্গে চুক্তি করেন, তাহলে পরে হতাশ হতে হবে। কারণ, তাঁরা যেটি ভাবছেন, বাস্তবে সেটি মিলবে না। ট্রাম্প যেসব কৌশল দিয়ে তাঁর বাণিজ্যযুদ্ধ চালাচ্ছেন, সেগুলোই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হওয়ার পথ আটকে দিচ্ছে।
আজিজ হক শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এবং দ্য কলাপস অব কনস্টিটিউশনাল রেমিডিস বইয়ের লেখক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর ছ ন য ক তর আম র ক আইন র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
৩৫ দিনে হিলি বন্দরে ১ লাখ মেট্রিকটন চাল আমদানি
গত ৩৫ দিনে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে দুই হাজার ২৪টি ভারতীয় ট্রাকে করে এক লাখ চার হাজার ৮৫৯ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের চালের বাজারে। খুচরা বাজারে কেজি প্রতি চালের দাম কমেছে প্রকার ভেদে ৪ থেকে ৬ টাকা।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় হিলি বন্দর ঘুরে জানা যায়, দেশের অস্থির চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১২ আগস্ট থেকে চাল আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত ২ শতাংশ শুল্কে ভারত থেকে চাল আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রতি টন চাল ৫২০ থেকে ৫৩০ ডলার, কিছু ক্ষেত্রে ৫৪০ ডলার মূল্যে আমদানি হচ্ছে। এসময় সবচেয়ে বেশি আসছে শম্পা কাটারি জাতের চাল।
হিলির খুচরা ব্যবসায়ী স্বপন পাল বলেন, “ভারত থেকে চাল আসায় বাজারের অস্থিরতা কমছে। প্রতিটি জাতের চাল কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা করে কমেছে। ৫৫ টাকা কেজি দরের মোটা চাল বিক্রি করছি ৫১ থেকে ৫২ টাকা, আবার ৭৪ টাকার শম্পা কাটারি চাল খুচরা বিক্রি করছি ৬৮ কেজি হিসেবে। আশা করছি আগামীতে আরো কমবে।”
আমদানিকারক নুর ইসলাম বলেন, “২ শতাংশ শুল্কে আমরা চাল আনছি। ৫২০-৫৪০ ডলার দরে আমদানি হচ্ছে। এতে বাজারে দামের প্রভাব স্পষ্টভাবে পড়ছে।”
হিলি কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন জানান, গত ১২ আগস্ট থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ৩৫ দিনে ভারত থেকে ২৪২১টি ট্রাকে এক লাখ চার হাজার ৮৫৯ মেট্রিকটন চাল এসেছে। দেশের বাজারে চালের চাহিদা থাকায় দ্রুত খালাস প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হচ্ছে।
ঢাকা/মোসলেম/এস