আট বছর বয়সের শিশু জিসানকে জুতা কিনে দেওয়ার কথা বলে সন্ধ্যায় মাদ্রাসা থেকে বাজারে নিয়ে যান কথিত মামা সোহেল রানা (২৮)। নতুন জুতা কিনে দেওয়ার পর রেস্তোরাঁয় নিয়ে খাওয়ান। রাত বেড়ে গেলে শিশুটি মাদ্রাসার যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। এরপরে বাজার থেকে রাত ১১টার দিকে শিশুটিকে নিয়ে মাদ্রাসার পথে রওনা দেন তিনি। পথে একটি পাটখেতে নিয়ে মুখে ঘাস ও মাটিচাপা দিয়ে শিশুটিকে হত্যা করেন কথিত এই মামা।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার একটি মাদ্রাসা থেকে শিশু জিসান নিখোঁজ হয়। এ ঘটনায় কথিত মামা সোহেল রানাকে আটকের পর তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আজ শুক্রবার সকালে পাটখেত থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটির মায়ের সঙ্গে বিরোধের জেরে সোহেল রানা শিশুটিকে হত্যা করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দেওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

এ ঘটনায় সোহেল রানাকে একমাত্র আসামি করে বিকেলে গঙ্গাচড়া থানায় হত্যা মামলা করেছেন শিশুটির মা জেসমিন আরা বেগম। তিনি উপজেলার চেংমারি উত্তরপাড়া গ্রামে বাবার বাড়িতে থাকেন। ওই বাড়িতে একসময় কাজ করতেন সোহেল রানা। তাঁর বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার সুন্দ্রাহবি গ্রামে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেসমিন একসময় ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। সেখানে বেলাল হোসেন নামের একজনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে তাঁরা বিয়ে করেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান জিসান হোসেন। বছর পাঁচেক আগে বেলাল ভারতে পাড়ি জমান। তখন জেসমিন চাকরি ছেড়ে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে গঙ্গাচড়ার চেংমারি উত্তরপাড়া গ্রামে বাবার বাড়ি চলে আসেন। পরে শিশুসন্তান জিসানকে গঙ্গাচড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদিকুল ইসলাম এতিমখানা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসার আবাসিক শাখায় ভর্তি করে দেন। শিশুটি মাদ্রাসায় থেকে নুরানি বিভাগে পড়ত।

মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, প্রায় এক ব্যক্তি মাদ্রাসায় এসে জিসানকে খাবার কিনে দিয়ে যেত। জিসান বলত, লোকটি তার মামা। বৃহস্পতিবার সন্ধায় ওই ব্যক্তি জুতা কিনে দেওয়ার কথা বলে জিসানকে মহিপুর বাজারে নিয়ে যান। রাতে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা জিসানকে খুঁজলে সহপাঠীরা জানায়, জিসানকে তাঁর মামা বাজারে নিয়ে গেছেন। শিক্ষকেরা বিষয়টি জিসানের মাকে জানান। পরে মাদ্রাসা থেকে জিসানের এক সহপাঠীকে নিয়ে স্বজনেরা গভীর রাতে কথিত মামা সোহেল রানার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে যান। তখন জিসানের কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন। পরে কালিগঞ্জ থানা-পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।

পুলিশ এসে সোহেল রানাকে আটক করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় সোহেল রানা জিসানকে হত্যা করে গঙ্গাচড়ার একটি পাটখেতে লাশ পুঁতে রাখার কথা জানান। আজ সকালে তাঁকে নিয়ে গঙ্গাচড়ায় এসে থানা-পুলিশের সহায়তায় উপজেলার লক্ষীটারি ইউনিয়ন পরিষদের মানাসপাড়া গ্রামের অদূরে একটি পাটখেত থেকে জিসানের লাশ উদ্ধার করা হয়।

গঙ্গাচড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু হানিফ বলেন, জিসানের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। লাশ উদ্ধারের সময় দুই হাত ভাঙা এবং মুখে ঘাস ও মাটিচাপা দেওয়া ছিল। প্রাথমিকভাবে সোহেল রানা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, শিশুটির মায়ের কাছে সোহেল রানা ৫০ হাজার টাকা পেতেন। না দেওয়ায় তিনি পরিকল্পনা করে জিসানকে বাজারে ডেকে নিয়ে নতুন জুতা কিনে দেন। হোটেলে খাওয়ান। পরে মাদ্রাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়ার পথে পাটখেতে নিয়ে হত্যা করেন। পরে লাশ ফেলে লালমনিরহাটের কালিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে চলে যান।

শিশুটির মা জেসমিন আরা বেগম বলেন, সোহেল তাঁর বাবার বাড়িতে কাজ করতেন। তাঁর সন্তানসহ পরিবারের সবাই তাঁকে চিনতেন। বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি কাজ করেন না। তাঁর কাছে কোনো টাকাও পাবেন না। একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। জেসমিন আরা বেগম বলেন, ‘কী অপরাধ করেছিল আমার একমাত্র বুকের ধন? তাকে কেন হত্যা করল? আল্লাহ ওর (সোহেল) বিচার করবেন।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: একম ত র উপজ ল র

এছাড়াও পড়ুন:

মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে

ইউভাল নোয়াহ হারারি তাঁর বহুল আলোচিত হোমো ডিউস বইয়ে যুক্তি দিয়েছেন, মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে তিনটি প্রধান বিপদ। এক. মহামারি, দুই. দুর্ভিক্ষ, এবং তিন. যুদ্ধ।

হারারির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে আমরা প্রথম দুটি বিপদ (মহামারি ও দুর্ভিক্ষ) অনেকটাই জয় করেছি।

মহামারির ইতিহাস নিঃসন্দেহে ভয়ংকর ও বিভীষিকাময়। কিন্তু আশার কথা হলো, আধুনিক মাইক্রোবায়োলজির সাফল্যে আমরা কোভিড-১৯-এর মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসকে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।

ম্যালেরিয়া মশার কামড়ে ছড়ায়—রোনাল্ড রস ও তাঁর সহকর্মীরা কীভাবে তা আবিষ্কার করেন, ছেলেবেলায় আমরা সেই গল্প পাঠ্যবইয়ে পড়েছি। তার আগে বহু মানুষ ম্যালেরিয়ার জন্য সন্ধ্যার বাতাস বা অলৌকিক কারণকে দায়ী করতেন। কুসংস্কার ছিল মানুষের একমাত্র ব্যাখ্যা। অথচ প্রকৃতিতেই ছিল প্রতিষেধক—দক্ষিণ আমেরিকার সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে তৈরি কুইনাইন।

আরও পড়ুনগাজা থেকে ইউক্রেন—যে কারণে এত যুদ্ধ২১ জুলাই ২০২৫

কলেরাকে একসময় বলা হতো ‘ওলা ওঠা’; শরৎচন্দ্রের রচনায় ‘ওলাদেবী’র মতো পৌরাণিক চরিত্রের কথা আমরা পড়েছি, যিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে প্রাণ হরণ করেন। অথচ এই মরণব্যাধির মূল কারণ ছিল দূষিত পানি। আজ এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড় ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বানানো ওরস্যালাইনই সেই ‘ওলাদেবী’কে হার মানিয়েছে।

টাইফয়েড, প্লেগ, ব্ল্যাক ফিভার, সিফিলিস ইত্যাদি বহু রোগ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল স্মলপক্স বা বসন্ত, যা দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী জনপদকে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।

আজ বিজ্ঞান সে রোগকেও চিরতরে বিলুপ্ত করেছে—বসন্ত এখন কেবল গবেষণাগারের বিষয়।

হারারির দ্বিতীয় শত্রু—দুর্ভিক্ষ। মানব ইতিহাসে হাজারো দুর্ভিক্ষ নথিবদ্ধ  আছে। কিন্তু গত ১৫০ বছরে দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭ থেকে ১২ কোটি মানুষ। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল একটির কারণ, তবে যুদ্ধ, প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক অবহেলা ছিল আরও বড় কারণ।

আরও পড়ুনমহামারি ও যুদ্ধ অপুষ্টি বাড়িয়েছে৩১ জানুয়ারি ২০২৪

আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্যশস্যের অধিক উৎপাদন, গুদামজাতকরণ ও বৈজ্ঞানিক বিতরণব্যবস্থা আজ দুর্ভিক্ষকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছে।

তৃতীয় বিপদ—যুদ্ধ। ১৮০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। হারারি মনে করেন, যুদ্ধের পেছনের যুক্তিগুলো আজকাল আর তেমন কার্যকর নয়। একসময় যুদ্ধ হতো জমি, সম্পদ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য। কিন্তু আধুনিক যুগে সেই প্রয়োজন অনেকটাই বিলুপ্ত।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি চীন আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি সামরিক শক্তি দিয়ে দখল করতে চায়, তবে তার খরচ হবে বিপুল। বরং সেখানে বিনিয়োগ করলে লাভ হবে বহুগুণ। আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ‘মানব মেধা’, যা অস্ত্র দিয়ে জবরদস্তিমূলকভাবে দখল করা যায় না।

এই যুক্তিতে হারারি আশাবাদী যে হোমো স্যাপিয়েন্স একসময় রূপ নেবে ‘হোমো ডিউস’ বা এক প্রকার দেবতুল্য প্রজাতিতে। তারা বিজ্ঞানের সহায়তায় শত শত বছর বাঁচবে এবং শুধু বড় দুর্ঘটনাতেই তাদের মৃত্যু হবে।

আরও পড়ুনগাজা নিয়ে ‘গণহত্যামূলক সাংবাদিকতা’ করছে নিউইয়র্ক টাইমস২৬ জুলাই ২০২৫

কিন্তু বাস্তবতা এই আশাবাদের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে না। বইটি প্রকাশের পরপরই শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস সংঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি এখন আর অলীক নয়, বাস্তবতার অংশ। রাশিয়া পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, তাদের অস্তিত্ব যদি হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে তারা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।

এমন কিছু ঘটে গেলে, হারারির পূর্বাভাস যে ভুল প্রমাণিত হবে, তা বলাই বাহুল্য। যদিও তা দেখার মতো তখন কেউ থাকবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

ইরান যদি ইসরায়েলের ওপর বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে না—এমন নিশ্চয়তা নেই। হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধে ইসরায়েলের গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারা মিসরের ওপর পারমাণবিক হামলার চিন্তা করছিল।

সেই পরিস্থিতিতে তিনি জরুরি ভিত্তিতে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও বিমান সরবরাহ করেন।
বিশ্ব রাজনীতির আরেক উদ্বেগজনক দিক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় পরিবর্তন। ৯/১১-পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বিখ্যাত ঘোষণা ছিল—‘যদি তুমি আমাদের সঙ্গে না থাকো, তাহলে তুমি আমাদের শত্রু’। এটি শুধু রাজনৈতিক বার্তা নয়, বরং একধরনের বৈশ্বিক দম্ভ ও আধিপত্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

অর্থনৈতিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের দৈন্য এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক আগ্রাসী ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে ইউক্রেন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে চলছে অস্থিরতা, সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়। শান্তি যেন এখন শুধুই এক কৌশলগত বিলাসিতা।

মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ—মানব ইতিহাসের এই তিন মহাশত্রুর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম এবং বিজ্ঞানের সাহায্যে মানবজাতির অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে অনন্য এক অধ্যায়। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে কৌশলগত স্থিতিশীলতা ও টেকসই শান্তির ভিত্তি রচনা করাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

নইলে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া হোমো ইরেক্টাস, হোমো হ্যাবিলিস কিংবা নিয়ান্ডারথালের মতো আমরাও, মানে আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্স একদিন হারিয়ে যেতে পারি সময়ের গর্ভে, অসীম শূন্যতায়।

তুষার কান্তি চাকমা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মহামারি, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধ, সভ্যতার তিন শত্রুকে ঠেকাব কী করে